ঢাকা ১২:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কমলাকান্ত ও প্রেত

  • আপডেট সময় : ০১:৩৫:০৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ৩৪ বার পড়া হয়েছে

ইহজগতের কোনো নেশার সাধ্যি নেই কমলাকান্তকে ভাবনা হইতে বিচ্যুত করে; তেমনই এক মধ্যরাত্রিরে একা বসিয়া বঙ্গীয় দেশের ঐতিহ্যবাহী বাংলামদ (চুয়ানি) খাইয়া চৌকির কোণে বসিয়া ঝিম ধরিয়া তারা দেখিতেছিল। ভাবিতেছিল তাহার ঘর ইন্দ্রদেবের ঘরের সন্নিকটে এবং মেঘনাদ তা জয় করিতে আসিতেছে। আফিমের কৌটো হাতে লইয়া একটু নড়িয়াচড়িয়া নিজ স্থানে আরও বেশি আড়ষ্ট হইয়া বসিল সে।
হঠাৎ করিয়া সে দেখিলো জানালার নিকট প্রকাণ্ড এক অশরীরী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। আকস্মিকতায় চকিত হইয়া সে যখন কাঁপিতে কাঁপিতে দৌড় আরম্ভ করিবে, তাহার আগেই সেই অশরীরীর চোখ জ্বলিয়া উঠিল। কহিল: নেশাখোর আইজে আর তোর রক্ষে নেই।
কমলাকান্ত কহিল, ‘আমি কী করিয়াছি? আমি কোনো ক্ষতি করি নাই, কেন আমাকে ভয় দেখাইতেছো প্রেত?’
প্রেত কহিল, ‘আমাদিগের কার্য হইলো ভয় দেখানো, ইহা করিয়া আমরা উৎকর্ষ লাভ করি। তোমাদিগকে ভয় দেখাইয়া, ঘাড়ে চড়িয়া তাহা মটকাইয়া, রক্ত চুষিয়া কিংবা ভয় দেখাইয়া নানা কাজ করিয়া লই। ইহাতে তো দোষের কিছু দেখিতেছি না।’
কমলাকান্তর হাত-পা অবশ হইবার উপক্রম, তাহার পরেও সে কহিল, ‘তা ঠিক বটে, তাই বলিয়া নির্দোষ মানুষে ভয় দেখাইয়া কী-বা মজা লাভ হইবে? তাহার চেয়ে বরং তোমরা আলাদা থাকো প্রেত জগতে।’
‘তাহা কী করিয়া সম্ভব? আমার বংশ হইলো রাজবংশ এবং আমার পিতা শ্রেষ্ঠ প্রেত দৈত্যরাজ। সে এই দেশের মানুষকে ভয় দেখাইয়া শ্রেষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল, ফাউন্ডার প্রেত। ভয় দেখানোর ক্ষমতা সকলের কাছে থাকে না, এই দেখো না, মামদোভূতের দল আমাদের চিরশত্রু, তাহারা নির্দোষের উপরে জুলুম করিয়া ভয় দেখায় না। আবার ধরো, গেছোভূতেরা মানুষদের ভয় দেখাইতে পারে কিন্তু ঘাড় মটকাইতে পারে না। হা হা হা হা!’
কমলাকান্ত কম্পিত কণ্ঠে কহিল, ‘তুমি কোন বংশের হে প্রেত?’
‘আমি শাকচুন্নি, আমার ছেলে আমার পরে ভূতরাজ্যের নেতা হইবে। আমার পিতাকে ওঝা মানুষের দল মারিয়া ফেলিয়াছিল পরিবারের সহিত, ইহার বদলা লইবো আমি।’
‘তাহা হইলে কহিতেছো একা তুমি এত মানুষকে মারিয়া ফেলিবে? স্বার্থের জন্য?’
‘হা হা হা! মানুষ মারিবার চেয়ে আনন্দদায়ক কিছু আছে? আমি একা মারিবো কে কহিল? আমার অনেক সেক্টর রহিয়াছে, জোলাভূত, নিশিভূত, পোড়াভূত, আত্মা, তাহাতে আবার তোদের মতো মানুষও রহিয়াছে, যাহারা আমার পূজো করিতে থাকে। একত্রে মিলিয়া আমার আদেশে সকলকে মারিবে।’
‘সে মারিবে! তাহাতে লাভ কী হইবে? আর আমাকেই কেন শুনাইতেছো সেসব?’
‘যাহাতে বলিতে পারি, সকলকে মারিবার কথা আগেই জানাইয়া দিয়েছিলাম। নির্বিচারে মারিবো সকলকে।’
কথা শেষ হইতেই আবারো দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল চোখ। তাহাতে দেখা গেল শাড়ি পরিয়া, চুল ছাড়িয়া দিয়া হাতে চুড়ি পরিয়া তাহার দিকে তাকাইয়া আছে প্রেত। প্রেতের অবশ্যি জানা ছিল না কমলাকান্ত নেশাখোর হইতে পারে কিন্তু সে জাত ব্রাহ্মণ। কমলা তাহার চারপায়া হইতে গঙ্গাজল লইয়া তাহা প্রেতের দিকে ছুড়িয়া মারিতে লাগিল।
প্রেত ভয় পাইল, সে কখনোই ইহা ভাবিয়া আসে নাই, কমলাকান্ত তাহাকে প্রতিহত করিতে পারে। ভয়ে সে পালাইয়া যাইতে আরম্ভ করিলো এবং পেছন মাথা ঘুড়িয়ে কহিয়া গেল, ‘প্রেতপাড়া হইতে আবারো ফিরিয়া আসিবো, সেইখানে আমার জাত ভাইরা থাকে, তাহাদিগের সাহায্য লইয়া আসিবো।’
‘তুই যতবার আসিবি, ততবার তোকে মারিয়া বিদায় করিবো, কহিয়া রাখিলাম, নেশাখোর হইতে পারি, ভয় পাইনে।’
এমতাবস্থায় নেশার ঘোর কাটিতে আরম্ভ করিল। কমলাকান্ত দেখিল সে জানালার বাহিরে আমগাছকে প্রেত এবং মদকে গঙ্গাজল ভাবিয়া জানালা দিয়ে ছিটাইতেছে, চিৎকার করিতেছে।
নেশাখোর কমলাকান্ত ভাবিল, তাহা হইলে এ মনের ভ্রম, প্রেত নহে কিন্তু যদি প্রেত কখনো চলিয়া আসে? তখন কী হইবে?
অতঃপর আরও একটি বাংলামদের বোতল খোলা হইল…
(কথাসাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

কমলাকান্ত ও প্রেত

আপডেট সময় : ০১:৩৫:০৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ইহজগতের কোনো নেশার সাধ্যি নেই কমলাকান্তকে ভাবনা হইতে বিচ্যুত করে; তেমনই এক মধ্যরাত্রিরে একা বসিয়া বঙ্গীয় দেশের ঐতিহ্যবাহী বাংলামদ (চুয়ানি) খাইয়া চৌকির কোণে বসিয়া ঝিম ধরিয়া তারা দেখিতেছিল। ভাবিতেছিল তাহার ঘর ইন্দ্রদেবের ঘরের সন্নিকটে এবং মেঘনাদ তা জয় করিতে আসিতেছে। আফিমের কৌটো হাতে লইয়া একটু নড়িয়াচড়িয়া নিজ স্থানে আরও বেশি আড়ষ্ট হইয়া বসিল সে।
হঠাৎ করিয়া সে দেখিলো জানালার নিকট প্রকাণ্ড এক অশরীরী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। আকস্মিকতায় চকিত হইয়া সে যখন কাঁপিতে কাঁপিতে দৌড় আরম্ভ করিবে, তাহার আগেই সেই অশরীরীর চোখ জ্বলিয়া উঠিল। কহিল: নেশাখোর আইজে আর তোর রক্ষে নেই।
কমলাকান্ত কহিল, ‘আমি কী করিয়াছি? আমি কোনো ক্ষতি করি নাই, কেন আমাকে ভয় দেখাইতেছো প্রেত?’
প্রেত কহিল, ‘আমাদিগের কার্য হইলো ভয় দেখানো, ইহা করিয়া আমরা উৎকর্ষ লাভ করি। তোমাদিগকে ভয় দেখাইয়া, ঘাড়ে চড়িয়া তাহা মটকাইয়া, রক্ত চুষিয়া কিংবা ভয় দেখাইয়া নানা কাজ করিয়া লই। ইহাতে তো দোষের কিছু দেখিতেছি না।’
কমলাকান্তর হাত-পা অবশ হইবার উপক্রম, তাহার পরেও সে কহিল, ‘তা ঠিক বটে, তাই বলিয়া নির্দোষ মানুষে ভয় দেখাইয়া কী-বা মজা লাভ হইবে? তাহার চেয়ে বরং তোমরা আলাদা থাকো প্রেত জগতে।’
‘তাহা কী করিয়া সম্ভব? আমার বংশ হইলো রাজবংশ এবং আমার পিতা শ্রেষ্ঠ প্রেত দৈত্যরাজ। সে এই দেশের মানুষকে ভয় দেখাইয়া শ্রেষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল, ফাউন্ডার প্রেত। ভয় দেখানোর ক্ষমতা সকলের কাছে থাকে না, এই দেখো না, মামদোভূতের দল আমাদের চিরশত্রু, তাহারা নির্দোষের উপরে জুলুম করিয়া ভয় দেখায় না। আবার ধরো, গেছোভূতেরা মানুষদের ভয় দেখাইতে পারে কিন্তু ঘাড় মটকাইতে পারে না। হা হা হা হা!’
কমলাকান্ত কম্পিত কণ্ঠে কহিল, ‘তুমি কোন বংশের হে প্রেত?’
‘আমি শাকচুন্নি, আমার ছেলে আমার পরে ভূতরাজ্যের নেতা হইবে। আমার পিতাকে ওঝা মানুষের দল মারিয়া ফেলিয়াছিল পরিবারের সহিত, ইহার বদলা লইবো আমি।’
‘তাহা হইলে কহিতেছো একা তুমি এত মানুষকে মারিয়া ফেলিবে? স্বার্থের জন্য?’
‘হা হা হা! মানুষ মারিবার চেয়ে আনন্দদায়ক কিছু আছে? আমি একা মারিবো কে কহিল? আমার অনেক সেক্টর রহিয়াছে, জোলাভূত, নিশিভূত, পোড়াভূত, আত্মা, তাহাতে আবার তোদের মতো মানুষও রহিয়াছে, যাহারা আমার পূজো করিতে থাকে। একত্রে মিলিয়া আমার আদেশে সকলকে মারিবে।’
‘সে মারিবে! তাহাতে লাভ কী হইবে? আর আমাকেই কেন শুনাইতেছো সেসব?’
‘যাহাতে বলিতে পারি, সকলকে মারিবার কথা আগেই জানাইয়া দিয়েছিলাম। নির্বিচারে মারিবো সকলকে।’
কথা শেষ হইতেই আবারো দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল চোখ। তাহাতে দেখা গেল শাড়ি পরিয়া, চুল ছাড়িয়া দিয়া হাতে চুড়ি পরিয়া তাহার দিকে তাকাইয়া আছে প্রেত। প্রেতের অবশ্যি জানা ছিল না কমলাকান্ত নেশাখোর হইতে পারে কিন্তু সে জাত ব্রাহ্মণ। কমলা তাহার চারপায়া হইতে গঙ্গাজল লইয়া তাহা প্রেতের দিকে ছুড়িয়া মারিতে লাগিল।
প্রেত ভয় পাইল, সে কখনোই ইহা ভাবিয়া আসে নাই, কমলাকান্ত তাহাকে প্রতিহত করিতে পারে। ভয়ে সে পালাইয়া যাইতে আরম্ভ করিলো এবং পেছন মাথা ঘুড়িয়ে কহিয়া গেল, ‘প্রেতপাড়া হইতে আবারো ফিরিয়া আসিবো, সেইখানে আমার জাত ভাইরা থাকে, তাহাদিগের সাহায্য লইয়া আসিবো।’
‘তুই যতবার আসিবি, ততবার তোকে মারিয়া বিদায় করিবো, কহিয়া রাখিলাম, নেশাখোর হইতে পারি, ভয় পাইনে।’
এমতাবস্থায় নেশার ঘোর কাটিতে আরম্ভ করিল। কমলাকান্ত দেখিল সে জানালার বাহিরে আমগাছকে প্রেত এবং মদকে গঙ্গাজল ভাবিয়া জানালা দিয়ে ছিটাইতেছে, চিৎকার করিতেছে।
নেশাখোর কমলাকান্ত ভাবিল, তাহা হইলে এ মনের ভ্রম, প্রেত নহে কিন্তু যদি প্রেত কখনো চলিয়া আসে? তখন কী হইবে?
অতঃপর আরও একটি বাংলামদের বোতল খোলা হইল…
(কথাসাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ