ঢাকা ০৬:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কবিতার প্রতি তরুণদের অনিহার কারণ কী

  • আপডেট সময় : ০৯:৪৭:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ নভেম্বর ২০২১
  • ৯২ বার পড়া হয়েছে

মাজহার মান্নান : সাহিত্যের অতি পুরাতন এবং অভিজাত শাখা হচ্ছে কাব্য। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল কাব্যকে সমাজ বদলের এক বড় হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং কাব্যকলার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। সাহিত্যের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাব্যের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে মানুষের জীবনে। কাব্যিক ছন্দ একদিকে যেমন মানবহৃদয়ে দোলা দেয়, অন্যদিকে জীবনবোধের এক ধ্রুপদি শিক্ষার উন্মেষ ঘটায়। গ্রিক কাব্যে পোয়েটিক জাস্টিস খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। যুগে যুগে বিভিন্ন কবি তাঁদের অনন্য কাব্যসৃষ্টির মাধ্যমে মানবজাতিকে আলোকিত করেছেন এবং অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে কাব্য সেই প্রাচীনকাল থেকেই ভূমিকা রেখে আসছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুধু সাহিত্য নয়, ইতিহাসেরও এক অনন্য সম্পদ। উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এমন কালজয়ী কবিতা লিখে নজরুল যেমন খ্যাতি পেয়েছিলেন, তেমনি এটি অপশাসনের শিকড় উপড়ে ফেলতেও কালজয়ী ভূমিকা রেখেছিল। সাহসী কবিরা সমাজ বদলে বিশেষ অবদান রাখেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখনীতে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। কাব্য সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের কথা বলে। কবিতা মানবতাবাদের কথা বলে। জসীমউদ্দীনের কবিতায় ফুটে উঠেছে মানবতাবাদের দারুণ বহিঃপ্রকাশ।
‘আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা
আমি বাঁধি তার ঘর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই
যে মোরে করেছে পর।’
কবির কল্পনা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, সমাজচেতনা জাগ্রত করে। মানুষের জটিল চরিত্র কাব্যে ফুটে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যে ফুটে উঠেছে মানুষের চরিত্রের কিছু নেতিবাচক দিক।
‘কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে
ভাই বলে ডাকো যদি, দেব গলা টিপে
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা
কেরোসিন শিখা বলে, এসো মোর দাদা।’
সামাজিক মূল্যবোধ জাগাতে কবিরা সর্বজনীন ভূমিকা রাখেন। ভাষা ভাব প্রকাশের সংকেত। কাব্যিক ভাষা ভাবের এক সর্বজনীন প্রকাশ। কাব্যিক ভাষা অলংকরণে সমৃদ্ধ থাকে। প্লেটো বলেছেন, কাব্য উচ্চতর প্রজ্ঞাকে আরও বেশি বেগবান করে। মানুষের সঙ্গে মানুষের ভেদাভেদকে কাব্য বর্জন করে। লালন তাঁর কাব্যে মানুষকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন।
একটি কবিতা একজন কবির জীবন খেয়ে বেঁচে থাকে। প্রতীকধর্মিতা, বিষয়ের গভীরতা ও ব্যঞ্জনা, শিল্প প্রকরণ, নান্দনিকতা, সাহিত্যরস কবিতাকে অমর করে রাখে। একটি ভালো কবিতা বহু সময় ধরে পাঠকের মননশীল মানসিকতা তৈরিতে অবদান রাখে। এটাই কাব্যশিল্পের অনন্য দিক। কাব্যকে শিল্পের সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। কাব্যশিল্প কোন মাত্রায় বিকশিত হবে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অনেক কবি সাম্যবাদী সমাজ গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন। কাজী নজরুল ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। একসময় তরুণেরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমানের কবিতার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তরুণদের সেই আগ্রহে ভাটা পড়ছে।
সাহিত্যের একটি ধ্রুপদি মাধ্যম কবিতা। সাহিত্যের পাঠক মানেই কবিতার পাঠক নন। একুশে বইমেলায় কবিতার বই বিক্রির হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। প্রচুর কবিতার বই তৈরি হচ্ছে, কিন্তু পাঠকের সমাদর মিলছে না। জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে কবিতা টনিক হিসেবে কাজ করে। তবে সেই কবিতা যদি পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দিতে না পারে, তবে তা কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণি থাকে, যারা কবিতা ভালোবাসে। কিন্তু সেই শ্রেণিও এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কেননা তাদের মনপযোগী কাব্যের আজ বড় আকাল। বিখ্যাত কবিদের বাইরেও বহু কাব্য রচিত হয়। কিন্তু পরিবেশ ও সুযোগের অভাবে সেগুলো হারিয়ে যায়। এ দায় কি শুধু কবির বা পাঠকের? রাষ্ট্রেরও এ ক্ষেত্রে কিছু দায় আছে। কাব্যশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বড় প্রয়োজন। অনেক ভালো কবিতা আছে, যেগুলো পরিবেশ ও সুযোগের অভাবে আলোর মুখ দেখে না। আজ তরুণ প্রজন্মের হাতে মাদক উঠেছে, অথচ তাদের হাতে কাব্যের বই শোভা পাওয়ার কথা ছিল। কবিতার বই তরুণদের মধ্যে জীবনবোধ, পরিমিতিবোধ, দায়িত্ববোধ ও সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি করে। কিন্তু কেন তাঁদের হাতে কাব্যের বই ওঠে না? এটা কি শুধু তাঁদের দায়, নাকি রাষ্ট্রেরও বড় দায় আছে?
রাষ্ট্রীয়ভাবে কাব্য সম্মেলন তেমন একটা চোখে পড়ে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেটুকু হচ্ছে, তা দিয়ে কাব্যের বিস্তার সম্ভব নয়। বর্তমানেও অনেক নাম না জানা কবি ভালো কবিতা লিখছেন। তাঁদের এই লেখা যদি পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই করে দেওয়া যায়, তাহলে তাঁরা আরও উৎসাহিত হবেন, আরও সৃষ্টিশীল কাব্য তৈরি হবে। তরুণ প্রজন্মকেও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে। মা–বাবার কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে মাদক না কিনে একটি ভালো কবিতার বই কিনলে তাঁরা উপকৃত হবেন, সমৃদ্ধ হবে কাব্যশিল্প। ১০০ বা ২০০ টাকায় একটি কবিতার বই কেনা যায়। অভিভাবকেরা যদি তাঁদের সন্তানদের বই কিনে দেন, তাহলে তারা বিপথগামী হবে না। অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে যে কবিতা একজন তরুণের মনে বিশেষ প্রভাব ফেলে এবং মার্জিত রুচিবোধ তৈরি করে।
বেশ কিছু একাডেমিক গ্রন্থ আমি লিখেছি ইংরেজি ব্যাকরণ ও সাহিত্যের ওপর। কাজেই প্রকাশনাজগৎ সম্পর্কে আমার কমবেশি ধারণা আছে। একাডেমিক গ্রন্থ শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ক্রয় করে। বুকে বড় আশা নিয়ে আমার এক পরিচিত প্রকাশকের কাছে গেলাম একটি কবিতার বই ছাপাব বলে। তাঁর কথা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ। তিনি আমাকে যা শোনালেন, তা রীতিমতো ভয়ংকর। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, কবিতার বই মানুষ কেনে না, তাই তিনি ছাপাতে রাজি নন। তিনি নিজ খরচে ছাপানো ও বিক্রির পরামর্শ দিলেন। হতাশ হয়ে ফিরে এলাম বাসায়। কিন্তু কেন মানুষ কবিতার বই কেনে না, সেই প্রশ্ন আমার মনে ঘুরপাক খেতে লাগল। জরিপ শুরু করলাম। যেহেতু আমি কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াই, তাই জরিপের কাজটি আমার জন্য সহজ ছিল। ছাত্র–ছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কবিতার বই পড়ে কি না বা কেনে কি না। বেশির ভাগই উত্তর দিল, কবিতা পড়তে তাদের ভালো লাগে না। হেতু হিসেবে তারা আমাকে জানাল যে আধুনিক কবিতা পড়ে তারা কোনো মজা পায় না, কোনো ছন্দ খুঁজে পায় না, কবিতার ভাষা তারা বোঝে না। তাদের যুক্তিগুলো আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। তাদের কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। কেননা, কেউ যদি কোনো কিছু পড়ে বুঝতে না পারে, তাহলে কেন সে টাকা দিয়ে তা কিনবে! অনুসন্ধানের আগ্রহ আমার আরও বেড়ে গেল। শুরু করলাম আধুনিক কিছু কাব্য নিয়ে গবেষণা। অনেক বিষয় আমার নজরে এল। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। অন্যের চিন্তার সঙ্গে না–ও মিলতে পারে। পাঠক সরে যাওয়ার পেছনে আমি নি¤েœাক্ত হেতুগুলো খুঁজে পেয়েছি।
১. মানহীন লেখা
২. ভাষার জটিলতা
৩. ছন্দের অভাব
৪. সঠিক মাত্রাবিন্যাসের অভাব
৫. অন্তঃসারশূন্য বিষয়বস্তু
৭. লেখার মান যাচাই না করেই নির্বিচার কবিতার বই ছাপানো
৮. মিডিয়া কাভারেজ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না পাওয়া
৯. যেনতেন লিখে বড় কবি হওয়ার বাসনা
১০. লেখার মৌলিকত্বের দিকে নজর না দেওয়া
১১. কাব্য আন্দোলন তৈরিতে ব্যর্থ হওয়া
১২. যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাব্য রচনা করতে না পারা।
১৩. কবিতা পড়ে নয়, শুধু লিখে কবিপরিচিতি পাওয়ার বাসনা।
১৪. ছাপানো সব বই সৌজন্য দিয়ে নিজেকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থ চেষ্টা
১৫. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কবিতা লিখে রাতারাতি কবি হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন।
আরও অনেক কারণ আছে। সেগুলোর দিকে না–ই বা গেলাম। ডরষষরধস ডড়ৎফংড়িৎঃয রোমান্টিক যুগের শুরু করলেন, যা সাহিত্যে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল। তাঁর মূল কথা ছিল, কাব্যের ভাষা হবে সহজ–সরল, যেন সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারে। তাল নেই, লয় নেই, ভাষার মাধুর্য নেই, সারসত্তা নেই—এমন কবিতা কেউ রচনা করলে তা কবিতা হয়ে উঠবে না। যে কবিতা পাঠকহৃদয়ে নাড়া দিতে পারে না, সে কবিতা মানুষ বর্জন করে। আজ কাব্যজগতে খরা চলছে। কবিদের কর্মকা- দেখে কী বলব, তা ভেবে পাই না।
বর্তমানে হাজারো অনলাইন কাব্য পরিষদ। সহজভাবে বললে, প্রতি কবি (কবি কি না, তা বিধাতা জানেন) একটি গ্রুপ সৃষ্টি করছেন। কেউ কেউ আবার তিন–চারটিও করছেন। বাহারি পদের নাম আর রংচঙে কাব্যের কতটুকু চর্চা হয়, তা বলা মুশকিল।
যৌথভাবেও অনেক কাব্যগ্রন্থ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এতে কবির কী লাভ হচ্ছে? নিজের বই নিজেকেই কিনতে হয়। অর্থাৎ কিছু কবির হাতেই বই ঘোরাফেরা করে, পাঠক সেটা কিনে পড়ে না। তবে মানুষ যে একেবারেই কবিতার বই কেনে না, তা কিন্তু নয়। ভালো মানের লেখা হলে কিনে পড়ে। প্রশ্ন হলো, লেখার মানের দিকে কজন নজর দিতে পারছেন!
এবার আসি মিডিয়া কাভারেজ নিয়ে। অনেক কবির মানসম্মত লেখাও কালের গর্ভে হারিয়ে যায় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। মিডিয়া কাভারেজ না থাকলে পরিচিতি বাড়ে না। পাঠকেরা ঐ লেখকের লেখা সম্পর্কে জানতে পারেন না। কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণসহ অনেক কবি আছেন, যাঁরা তাঁদের মৌলিক লেখার গুণে খ্যাতি পেয়েছেন। আবার তাঁরা সাংবাদিক হওয়ায় সহজেই মিডিয়া কাভারেজ পেয়েছেন। পাঠ্যবইতে কারও একটি কবিতা যুক্ত হলে তো কথাই নেই।
পাঠককে আবার সেই পূর্বের মতো মনোযোগী করে তুলতে হলে কবিদের কিছু কাজ করতে হবে—
১. মৌলিক লেখা উপহার দিতে হবে।
২. ছন্দে লেখার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, ছন্দকবিতা পড়তে সবার ভালো লাগে।
৩. সঠিক মাত্রাজ্ঞান নিয়ে কবিতা লিখতে হবে।
৪. সৌজন্য কপি দিয়ে কবি হওয়ার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
৫. পাঠকদের মধ্যে কাব্য আন্দোলন তৈরি করতে হবে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

কবিতার প্রতি তরুণদের অনিহার কারণ কী

আপডেট সময় : ০৯:৪৭:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ নভেম্বর ২০২১

মাজহার মান্নান : সাহিত্যের অতি পুরাতন এবং অভিজাত শাখা হচ্ছে কাব্য। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল কাব্যকে সমাজ বদলের এক বড় হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং কাব্যকলার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। সাহিত্যের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাব্যের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে মানুষের জীবনে। কাব্যিক ছন্দ একদিকে যেমন মানবহৃদয়ে দোলা দেয়, অন্যদিকে জীবনবোধের এক ধ্রুপদি শিক্ষার উন্মেষ ঘটায়। গ্রিক কাব্যে পোয়েটিক জাস্টিস খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। যুগে যুগে বিভিন্ন কবি তাঁদের অনন্য কাব্যসৃষ্টির মাধ্যমে মানবজাতিকে আলোকিত করেছেন এবং অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে কাব্য সেই প্রাচীনকাল থেকেই ভূমিকা রেখে আসছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুধু সাহিত্য নয়, ইতিহাসেরও এক অনন্য সম্পদ। উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এমন কালজয়ী কবিতা লিখে নজরুল যেমন খ্যাতি পেয়েছিলেন, তেমনি এটি অপশাসনের শিকড় উপড়ে ফেলতেও কালজয়ী ভূমিকা রেখেছিল। সাহসী কবিরা সমাজ বদলে বিশেষ অবদান রাখেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখনীতে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। কাব্য সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের কথা বলে। কবিতা মানবতাবাদের কথা বলে। জসীমউদ্দীনের কবিতায় ফুটে উঠেছে মানবতাবাদের দারুণ বহিঃপ্রকাশ।
‘আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা
আমি বাঁধি তার ঘর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই
যে মোরে করেছে পর।’
কবির কল্পনা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, সমাজচেতনা জাগ্রত করে। মানুষের জটিল চরিত্র কাব্যে ফুটে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যে ফুটে উঠেছে মানুষের চরিত্রের কিছু নেতিবাচক দিক।
‘কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে
ভাই বলে ডাকো যদি, দেব গলা টিপে
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা
কেরোসিন শিখা বলে, এসো মোর দাদা।’
সামাজিক মূল্যবোধ জাগাতে কবিরা সর্বজনীন ভূমিকা রাখেন। ভাষা ভাব প্রকাশের সংকেত। কাব্যিক ভাষা ভাবের এক সর্বজনীন প্রকাশ। কাব্যিক ভাষা অলংকরণে সমৃদ্ধ থাকে। প্লেটো বলেছেন, কাব্য উচ্চতর প্রজ্ঞাকে আরও বেশি বেগবান করে। মানুষের সঙ্গে মানুষের ভেদাভেদকে কাব্য বর্জন করে। লালন তাঁর কাব্যে মানুষকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন।
একটি কবিতা একজন কবির জীবন খেয়ে বেঁচে থাকে। প্রতীকধর্মিতা, বিষয়ের গভীরতা ও ব্যঞ্জনা, শিল্প প্রকরণ, নান্দনিকতা, সাহিত্যরস কবিতাকে অমর করে রাখে। একটি ভালো কবিতা বহু সময় ধরে পাঠকের মননশীল মানসিকতা তৈরিতে অবদান রাখে। এটাই কাব্যশিল্পের অনন্য দিক। কাব্যকে শিল্পের সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। কাব্যশিল্প কোন মাত্রায় বিকশিত হবে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অনেক কবি সাম্যবাদী সমাজ গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন। কাজী নজরুল ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। একসময় তরুণেরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমানের কবিতার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তরুণদের সেই আগ্রহে ভাটা পড়ছে।
সাহিত্যের একটি ধ্রুপদি মাধ্যম কবিতা। সাহিত্যের পাঠক মানেই কবিতার পাঠক নন। একুশে বইমেলায় কবিতার বই বিক্রির হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। প্রচুর কবিতার বই তৈরি হচ্ছে, কিন্তু পাঠকের সমাদর মিলছে না। জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে কবিতা টনিক হিসেবে কাজ করে। তবে সেই কবিতা যদি পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দিতে না পারে, তবে তা কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণি থাকে, যারা কবিতা ভালোবাসে। কিন্তু সেই শ্রেণিও এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কেননা তাদের মনপযোগী কাব্যের আজ বড় আকাল। বিখ্যাত কবিদের বাইরেও বহু কাব্য রচিত হয়। কিন্তু পরিবেশ ও সুযোগের অভাবে সেগুলো হারিয়ে যায়। এ দায় কি শুধু কবির বা পাঠকের? রাষ্ট্রেরও এ ক্ষেত্রে কিছু দায় আছে। কাব্যশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বড় প্রয়োজন। অনেক ভালো কবিতা আছে, যেগুলো পরিবেশ ও সুযোগের অভাবে আলোর মুখ দেখে না। আজ তরুণ প্রজন্মের হাতে মাদক উঠেছে, অথচ তাদের হাতে কাব্যের বই শোভা পাওয়ার কথা ছিল। কবিতার বই তরুণদের মধ্যে জীবনবোধ, পরিমিতিবোধ, দায়িত্ববোধ ও সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি করে। কিন্তু কেন তাঁদের হাতে কাব্যের বই ওঠে না? এটা কি শুধু তাঁদের দায়, নাকি রাষ্ট্রেরও বড় দায় আছে?
রাষ্ট্রীয়ভাবে কাব্য সম্মেলন তেমন একটা চোখে পড়ে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেটুকু হচ্ছে, তা দিয়ে কাব্যের বিস্তার সম্ভব নয়। বর্তমানেও অনেক নাম না জানা কবি ভালো কবিতা লিখছেন। তাঁদের এই লেখা যদি পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই করে দেওয়া যায়, তাহলে তাঁরা আরও উৎসাহিত হবেন, আরও সৃষ্টিশীল কাব্য তৈরি হবে। তরুণ প্রজন্মকেও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে। মা–বাবার কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে মাদক না কিনে একটি ভালো কবিতার বই কিনলে তাঁরা উপকৃত হবেন, সমৃদ্ধ হবে কাব্যশিল্প। ১০০ বা ২০০ টাকায় একটি কবিতার বই কেনা যায়। অভিভাবকেরা যদি তাঁদের সন্তানদের বই কিনে দেন, তাহলে তারা বিপথগামী হবে না। অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে যে কবিতা একজন তরুণের মনে বিশেষ প্রভাব ফেলে এবং মার্জিত রুচিবোধ তৈরি করে।
বেশ কিছু একাডেমিক গ্রন্থ আমি লিখেছি ইংরেজি ব্যাকরণ ও সাহিত্যের ওপর। কাজেই প্রকাশনাজগৎ সম্পর্কে আমার কমবেশি ধারণা আছে। একাডেমিক গ্রন্থ শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ক্রয় করে। বুকে বড় আশা নিয়ে আমার এক পরিচিত প্রকাশকের কাছে গেলাম একটি কবিতার বই ছাপাব বলে। তাঁর কথা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ। তিনি আমাকে যা শোনালেন, তা রীতিমতো ভয়ংকর। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, কবিতার বই মানুষ কেনে না, তাই তিনি ছাপাতে রাজি নন। তিনি নিজ খরচে ছাপানো ও বিক্রির পরামর্শ দিলেন। হতাশ হয়ে ফিরে এলাম বাসায়। কিন্তু কেন মানুষ কবিতার বই কেনে না, সেই প্রশ্ন আমার মনে ঘুরপাক খেতে লাগল। জরিপ শুরু করলাম। যেহেতু আমি কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াই, তাই জরিপের কাজটি আমার জন্য সহজ ছিল। ছাত্র–ছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কবিতার বই পড়ে কি না বা কেনে কি না। বেশির ভাগই উত্তর দিল, কবিতা পড়তে তাদের ভালো লাগে না। হেতু হিসেবে তারা আমাকে জানাল যে আধুনিক কবিতা পড়ে তারা কোনো মজা পায় না, কোনো ছন্দ খুঁজে পায় না, কবিতার ভাষা তারা বোঝে না। তাদের যুক্তিগুলো আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। তাদের কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। কেননা, কেউ যদি কোনো কিছু পড়ে বুঝতে না পারে, তাহলে কেন সে টাকা দিয়ে তা কিনবে! অনুসন্ধানের আগ্রহ আমার আরও বেড়ে গেল। শুরু করলাম আধুনিক কিছু কাব্য নিয়ে গবেষণা। অনেক বিষয় আমার নজরে এল। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। অন্যের চিন্তার সঙ্গে না–ও মিলতে পারে। পাঠক সরে যাওয়ার পেছনে আমি নি¤েœাক্ত হেতুগুলো খুঁজে পেয়েছি।
১. মানহীন লেখা
২. ভাষার জটিলতা
৩. ছন্দের অভাব
৪. সঠিক মাত্রাবিন্যাসের অভাব
৫. অন্তঃসারশূন্য বিষয়বস্তু
৭. লেখার মান যাচাই না করেই নির্বিচার কবিতার বই ছাপানো
৮. মিডিয়া কাভারেজ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না পাওয়া
৯. যেনতেন লিখে বড় কবি হওয়ার বাসনা
১০. লেখার মৌলিকত্বের দিকে নজর না দেওয়া
১১. কাব্য আন্দোলন তৈরিতে ব্যর্থ হওয়া
১২. যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাব্য রচনা করতে না পারা।
১৩. কবিতা পড়ে নয়, শুধু লিখে কবিপরিচিতি পাওয়ার বাসনা।
১৪. ছাপানো সব বই সৌজন্য দিয়ে নিজেকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থ চেষ্টা
১৫. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কবিতা লিখে রাতারাতি কবি হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন।
আরও অনেক কারণ আছে। সেগুলোর দিকে না–ই বা গেলাম। ডরষষরধস ডড়ৎফংড়িৎঃয রোমান্টিক যুগের শুরু করলেন, যা সাহিত্যে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল। তাঁর মূল কথা ছিল, কাব্যের ভাষা হবে সহজ–সরল, যেন সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারে। তাল নেই, লয় নেই, ভাষার মাধুর্য নেই, সারসত্তা নেই—এমন কবিতা কেউ রচনা করলে তা কবিতা হয়ে উঠবে না। যে কবিতা পাঠকহৃদয়ে নাড়া দিতে পারে না, সে কবিতা মানুষ বর্জন করে। আজ কাব্যজগতে খরা চলছে। কবিদের কর্মকা- দেখে কী বলব, তা ভেবে পাই না।
বর্তমানে হাজারো অনলাইন কাব্য পরিষদ। সহজভাবে বললে, প্রতি কবি (কবি কি না, তা বিধাতা জানেন) একটি গ্রুপ সৃষ্টি করছেন। কেউ কেউ আবার তিন–চারটিও করছেন। বাহারি পদের নাম আর রংচঙে কাব্যের কতটুকু চর্চা হয়, তা বলা মুশকিল।
যৌথভাবেও অনেক কাব্যগ্রন্থ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এতে কবির কী লাভ হচ্ছে? নিজের বই নিজেকেই কিনতে হয়। অর্থাৎ কিছু কবির হাতেই বই ঘোরাফেরা করে, পাঠক সেটা কিনে পড়ে না। তবে মানুষ যে একেবারেই কবিতার বই কেনে না, তা কিন্তু নয়। ভালো মানের লেখা হলে কিনে পড়ে। প্রশ্ন হলো, লেখার মানের দিকে কজন নজর দিতে পারছেন!
এবার আসি মিডিয়া কাভারেজ নিয়ে। অনেক কবির মানসম্মত লেখাও কালের গর্ভে হারিয়ে যায় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। মিডিয়া কাভারেজ না থাকলে পরিচিতি বাড়ে না। পাঠকেরা ঐ লেখকের লেখা সম্পর্কে জানতে পারেন না। কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণসহ অনেক কবি আছেন, যাঁরা তাঁদের মৌলিক লেখার গুণে খ্যাতি পেয়েছেন। আবার তাঁরা সাংবাদিক হওয়ায় সহজেই মিডিয়া কাভারেজ পেয়েছেন। পাঠ্যবইতে কারও একটি কবিতা যুক্ত হলে তো কথাই নেই।
পাঠককে আবার সেই পূর্বের মতো মনোযোগী করে তুলতে হলে কবিদের কিছু কাজ করতে হবে—
১. মৌলিক লেখা উপহার দিতে হবে।
২. ছন্দে লেখার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, ছন্দকবিতা পড়তে সবার ভালো লাগে।
৩. সঠিক মাত্রাজ্ঞান নিয়ে কবিতা লিখতে হবে।
৪. সৌজন্য কপি দিয়ে কবি হওয়ার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
৫. পাঠকদের মধ্যে কাব্য আন্দোলন তৈরি করতে হবে।