ঢাকা ০১:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫
এলো সজল শ্যামল বর্ষাঋতু

কদম ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ আষাঢ়

  • আপডেট সময় : ০৪:১৯:৩৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫
  • ২৬ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

  • সুখদেব কুমার সানা
  • আজ পহেলা আষাঢ়। ১৪৩২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসের প্রথম দিন আনুষ্ঠানিক সূচনা হবে প্রিয় ঋতু বর্ষার। এ মাসের মধ্য দিয়েই সাধারণত বাংলার প্রকৃতিতে বর্ষা প্রবেশ করে। পুষ্প-বৃক্ষে, পত্রপল্লবে, নতুন প্রাণের সঞ্চার করে, নতুন সুরের বারতা নিয়ে সবুজের সমারোহে হাজির হয় বাংলা ষড়ঋতুর সবচেয়ে রোমাঞ্চর ঋতু বর্ষা।

দীর্ঘ দাবদাহে প্রাণ অতিষ্ঠ করার পর হাজির কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ কবিকুলের বন্দিত ঋতু বর্ষাকাল। আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবস। ‘বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে’ দুয়ারে উপস্থিত সজল শ্যামল বর্ষা। গত বেশ কিছু দিনের আবহাওয়াই জানান দিচ্ছিল, বর্ষা এবার পঞ্জিকার জন্য অপেক্ষা করেনি। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় প্রকৃতিমাতার মতিগতি বেশ উল্টেপাল্টে গেছে। মাঠে-ঘাটে, বনে-বাদাড়ে ঘুরে প্রকৃতির খোঁজখবর রাখেন এমন অনেকে অবশ্য বললেন, আগেভাগে এক দফা ব্যাপক ফুটে অনেক কদমগাছ এখনো নাকি ফুলশূন্য! যাইহোক, ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত–সেই প্রবাদের মতো কদম ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ আষাঢ়-সজল শ্যামল বর্ষাঋতু শুরু।

আষাঢ় বাংলা সনের তৃতীয় মাস। এটি বর্ষা মৌসুমে অন্তর্ভুক্ত দুই মাসের প্রথম মাস। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে জুন-জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আষাঢ় মাস। আষাঢ় নামটি এসেছে পূর্বাষাঢ়া ও উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। এমাসে প্রচুর বৃষ্টি হয়। গ্রীস্মের দাবদাহ শেষে আষাঢ়ে বৃষ্টির ছোঁয়ায় বাংলার প্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পায়। নতুন আনন্দে জেগে উঠে প্রকৃতি। গ্রীষ্মের রুদ্র প্রকৃতির গ্লানি আর জরাকে ধুয়ে মুছে প্রশান্তি স্নিগ্ধতা আর সবুজে ভরে তোলে বর্ষা।

বর্ষায় গ্রীষ্মের ধুলোমলিন জীর্নতাকে ধুয়ে ফেলে গাঢ় সবুজের সমারোহে প্রকৃতি সাজে পূর্ণতায়। নদীতে উপচেপড়া জল, আকাশে থাকে ঘন মেঘের ঘনঘটা। গ্রীষ্মের দাবদাহে মানুষ যখন পুড়ে তখন বর্ষার ঝুম ঝুম বৃষ্টির বরণডালা প্রশান্তি এনে দেয় মানুষের মনে। বর্ষার সতেজ বাতাসে জুঁই, কামিনি, বেলি, রজনীগন্ধা, দোলনচাঁপা আরও কত ফুলের সুবাস। লেবু পাতার বনেও যেন অন্য আয়োজন। উপচে পড়া পদ্মপুকুর রঙিন হয়ে ফোটে বর্ষাকে পাওয়ার জন্য। কেয়ার বনেও কেতকীর মাতামাতি।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে, আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে। এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি, পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি।’ কবিগুরু ‘আষাঢ় কবিতায় বলেছেন, ‘বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর, আউশের ক্ষেত জলে ভরভর, কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিছে দেখ্ চাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’

বাঙালি মননে সবচেয়ে বেশি রোমান্টিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সুর বেজেছে এই বর্ষায়। সাহিত্যজুড়ে তারই প্রতিফলন ঘটেছে নানা ভাবে। বহুকাল আগে কালিদাস তাঁর ‘মেঘদূত’ কাব্যে বর্ষা বন্দনা করেছিলেন এভাবে ‘আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবসে মেঘমাসৃষ্টসানুং/বপ্রক্রীড়াপরিণতগজ প্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।’ আরও আগে বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি লিখেছিলেন: এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর। /এ ভরা ভাদর/মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর…।

বাংলা সাহিত্যের দুই স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের রচনায়, বিশেষ করে গানে বর্ষা নিয়ে মুগ্ধতার শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথ তো বর্ষার প্রতি পক্ষপাত লিখিতভাবেই ঘোষণা করেছেন, ‘ঋতুর মধ্যে বর্ষাই কেবল একা একমাত্র। তার জুড়ি নাই।’ এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের বর্ষা নিয়ে লেখা গানের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ‘ঋতুরাজ’ ‘ঋতুরাজ’ বলে যাকে নিয়ে আমাদের মাতামাতির শেষ নেই, সেই বসন্ত পরিসংখ্যানে অনেকটাই পিছিয়ে। অগোছালো নজরুলের ক্ষেত্রে কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব হাতের কাছে মজুদ না থাকলেও বর্ষার মাহাত্ম্যকীর্তনে তিনিও কম যাননি। কেউ কেউ বলছেন, বর্ষা নিয়ে নজরুলেরও দেড় শর বেশি গান রয়েছে।

অনেকেই মনে করেন, বর্ষা যেমন আনন্দের, তেমনি হঠাৎ বিষাদে ভরিয়ে তোলে জনপদ। তবু বর্ষা বাঙালি জীবনে নতুনের আবাহন। সবুজের সমারোহে, মাটিতে নতুন পলির আস্তরণে আনে জীবনেরই বারতা। সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা বাঙলা মায়ের নবজন্ম এই বর্ষাতেই। সারা বছরের খাদ্য-শস্য-বীজের উন্মেষ তো ঘটবে বর্ষার ফেলে যাওয়া অফুরন্ত সম্ভাবনার পলিমাটি থেকে।

বছরভর বাংলার প্রকৃতি হাজির হয় ভিন্ন ভিন্ন অপরূপ সাজে। তার মধ্যে বর্ষার সজল, শ্যামল রূপ অনন্যতায় ভরপুর। দিনমান নানা ছন্দের বৃষ্টি আর মেঘের ডমরু। প্রেমিকের বিরহকাতরতা। ময়ূরের পেখম মেলা। খিচুড়ি-ইলিশ। গ্রামে নৌকাবাইচ, নতুন পানির তরতাজা সুস্বাদু মাছ। ধানের ক্ষেতে রৌদ্র-হাওয়ার লুকোচুরির মতো অপার্থিব দৃশ্য আর কখন মেলে! আষাঢ় আর শ্রাবণ দুই মাসজুড়ে ব্যাপ্তি বর্ষার। মাস দুয়েক নানা মাত্রায় বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর। টিপটিপ, ঝিরিঝিরি, ইলশেগুঁড়ি, মুষলধার-বর্ষার বারিধারার কতই না নাম! কবিরা তার মধ্যে শোনেন নূপুর, মৃদঙ্গ আর মাদলের বোল। আকাশের চেহারারও সে কী বৈচিত্র্য! সারা দিন ঘোলাটে থেকে শুরু করে ছাইরঙা হয়ে মোষের মতো কালো। বর্ষার প্রকৃতিতে ডাকাতের মতোই দৌরাত্ম্য চলে মেঘেদের। কখনো কখনো বর্ষণ শেষে সেই মেঘের ফাঁকে হঠাৎ উঁকি দেয় আকাশজোড়া স্বর্গীয় রঙধনু।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বর্ষা ঋতু ‘ছুটির ঋতু। অবিরল বর্ষণে আউশের ক্ষেত জলে ভর ভর অবস্থা হলে তিনি সবাইকে ঘরের বাইরে যেতে মানা করেছেন। আবার বাদল টুটে যাওয়ার পর মেঘের কোলে রোদ হাসলে উৎসাহ দিয়েছেন ছুটির আনন্দে মাততে। কবির কল্পনার রাজ্যের বাইরের জগৎটা সাধারণত অত স্বপ্নের মতো নির্ভার আর রঙিন হয় না।

গ্রীষ্মের খরতাপে অতিষ্ঠ প্রাণকে শীতলতা দানে জুড়ি নেই বর্ষাকালের। প্রকৃতি প্রেমিক মানুষের কাছে তাই বর্ষা নিয়ে আসে অভিনব ব্যঞ্জনা। আর কবিদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। বাংলার প্রকৃতি ও জনজীবনে এই ঋতুর প্রভাবের শেষ নেই। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বর্ষার রয়েছে উজ্জ্বল উপস্থিতি। গানে-কবিতায় বাংলার কবিরা করেছেন বর্ষা-বন্দনা। তাই ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ দিয়ে প্রণয় নিবেদন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ-বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান। জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কাছে বর্ষাকে মনে হয়েছে ‘বাদলের পরী’। তিনি লিখেছেন: রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে; কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে… রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে।

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

এলো সজল শ্যামল বর্ষাঋতু

কদম ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ আষাঢ়

আপডেট সময় : ০৪:১৯:৩৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫
  • সুখদেব কুমার সানা
  • আজ পহেলা আষাঢ়। ১৪৩২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসের প্রথম দিন আনুষ্ঠানিক সূচনা হবে প্রিয় ঋতু বর্ষার। এ মাসের মধ্য দিয়েই সাধারণত বাংলার প্রকৃতিতে বর্ষা প্রবেশ করে। পুষ্প-বৃক্ষে, পত্রপল্লবে, নতুন প্রাণের সঞ্চার করে, নতুন সুরের বারতা নিয়ে সবুজের সমারোহে হাজির হয় বাংলা ষড়ঋতুর সবচেয়ে রোমাঞ্চর ঋতু বর্ষা।

দীর্ঘ দাবদাহে প্রাণ অতিষ্ঠ করার পর হাজির কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ কবিকুলের বন্দিত ঋতু বর্ষাকাল। আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবস। ‘বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে’ দুয়ারে উপস্থিত সজল শ্যামল বর্ষা। গত বেশ কিছু দিনের আবহাওয়াই জানান দিচ্ছিল, বর্ষা এবার পঞ্জিকার জন্য অপেক্ষা করেনি। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় প্রকৃতিমাতার মতিগতি বেশ উল্টেপাল্টে গেছে। মাঠে-ঘাটে, বনে-বাদাড়ে ঘুরে প্রকৃতির খোঁজখবর রাখেন এমন অনেকে অবশ্য বললেন, আগেভাগে এক দফা ব্যাপক ফুটে অনেক কদমগাছ এখনো নাকি ফুলশূন্য! যাইহোক, ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত–সেই প্রবাদের মতো কদম ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ আষাঢ়-সজল শ্যামল বর্ষাঋতু শুরু।

আষাঢ় বাংলা সনের তৃতীয় মাস। এটি বর্ষা মৌসুমে অন্তর্ভুক্ত দুই মাসের প্রথম মাস। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে জুন-জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আষাঢ় মাস। আষাঢ় নামটি এসেছে পূর্বাষাঢ়া ও উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। এমাসে প্রচুর বৃষ্টি হয়। গ্রীস্মের দাবদাহ শেষে আষাঢ়ে বৃষ্টির ছোঁয়ায় বাংলার প্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পায়। নতুন আনন্দে জেগে উঠে প্রকৃতি। গ্রীষ্মের রুদ্র প্রকৃতির গ্লানি আর জরাকে ধুয়ে মুছে প্রশান্তি স্নিগ্ধতা আর সবুজে ভরে তোলে বর্ষা।

বর্ষায় গ্রীষ্মের ধুলোমলিন জীর্নতাকে ধুয়ে ফেলে গাঢ় সবুজের সমারোহে প্রকৃতি সাজে পূর্ণতায়। নদীতে উপচেপড়া জল, আকাশে থাকে ঘন মেঘের ঘনঘটা। গ্রীষ্মের দাবদাহে মানুষ যখন পুড়ে তখন বর্ষার ঝুম ঝুম বৃষ্টির বরণডালা প্রশান্তি এনে দেয় মানুষের মনে। বর্ষার সতেজ বাতাসে জুঁই, কামিনি, বেলি, রজনীগন্ধা, দোলনচাঁপা আরও কত ফুলের সুবাস। লেবু পাতার বনেও যেন অন্য আয়োজন। উপচে পড়া পদ্মপুকুর রঙিন হয়ে ফোটে বর্ষাকে পাওয়ার জন্য। কেয়ার বনেও কেতকীর মাতামাতি।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে, আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে। এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি, পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি।’ কবিগুরু ‘আষাঢ় কবিতায় বলেছেন, ‘বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর, আউশের ক্ষেত জলে ভরভর, কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিছে দেখ্ চাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’

বাঙালি মননে সবচেয়ে বেশি রোমান্টিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সুর বেজেছে এই বর্ষায়। সাহিত্যজুড়ে তারই প্রতিফলন ঘটেছে নানা ভাবে। বহুকাল আগে কালিদাস তাঁর ‘মেঘদূত’ কাব্যে বর্ষা বন্দনা করেছিলেন এভাবে ‘আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবসে মেঘমাসৃষ্টসানুং/বপ্রক্রীড়াপরিণতগজ প্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।’ আরও আগে বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি লিখেছিলেন: এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর। /এ ভরা ভাদর/মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর…।

বাংলা সাহিত্যের দুই স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের রচনায়, বিশেষ করে গানে বর্ষা নিয়ে মুগ্ধতার শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথ তো বর্ষার প্রতি পক্ষপাত লিখিতভাবেই ঘোষণা করেছেন, ‘ঋতুর মধ্যে বর্ষাই কেবল একা একমাত্র। তার জুড়ি নাই।’ এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের বর্ষা নিয়ে লেখা গানের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ‘ঋতুরাজ’ ‘ঋতুরাজ’ বলে যাকে নিয়ে আমাদের মাতামাতির শেষ নেই, সেই বসন্ত পরিসংখ্যানে অনেকটাই পিছিয়ে। অগোছালো নজরুলের ক্ষেত্রে কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব হাতের কাছে মজুদ না থাকলেও বর্ষার মাহাত্ম্যকীর্তনে তিনিও কম যাননি। কেউ কেউ বলছেন, বর্ষা নিয়ে নজরুলেরও দেড় শর বেশি গান রয়েছে।

অনেকেই মনে করেন, বর্ষা যেমন আনন্দের, তেমনি হঠাৎ বিষাদে ভরিয়ে তোলে জনপদ। তবু বর্ষা বাঙালি জীবনে নতুনের আবাহন। সবুজের সমারোহে, মাটিতে নতুন পলির আস্তরণে আনে জীবনেরই বারতা। সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা বাঙলা মায়ের নবজন্ম এই বর্ষাতেই। সারা বছরের খাদ্য-শস্য-বীজের উন্মেষ তো ঘটবে বর্ষার ফেলে যাওয়া অফুরন্ত সম্ভাবনার পলিমাটি থেকে।

বছরভর বাংলার প্রকৃতি হাজির হয় ভিন্ন ভিন্ন অপরূপ সাজে। তার মধ্যে বর্ষার সজল, শ্যামল রূপ অনন্যতায় ভরপুর। দিনমান নানা ছন্দের বৃষ্টি আর মেঘের ডমরু। প্রেমিকের বিরহকাতরতা। ময়ূরের পেখম মেলা। খিচুড়ি-ইলিশ। গ্রামে নৌকাবাইচ, নতুন পানির তরতাজা সুস্বাদু মাছ। ধানের ক্ষেতে রৌদ্র-হাওয়ার লুকোচুরির মতো অপার্থিব দৃশ্য আর কখন মেলে! আষাঢ় আর শ্রাবণ দুই মাসজুড়ে ব্যাপ্তি বর্ষার। মাস দুয়েক নানা মাত্রায় বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর। টিপটিপ, ঝিরিঝিরি, ইলশেগুঁড়ি, মুষলধার-বর্ষার বারিধারার কতই না নাম! কবিরা তার মধ্যে শোনেন নূপুর, মৃদঙ্গ আর মাদলের বোল। আকাশের চেহারারও সে কী বৈচিত্র্য! সারা দিন ঘোলাটে থেকে শুরু করে ছাইরঙা হয়ে মোষের মতো কালো। বর্ষার প্রকৃতিতে ডাকাতের মতোই দৌরাত্ম্য চলে মেঘেদের। কখনো কখনো বর্ষণ শেষে সেই মেঘের ফাঁকে হঠাৎ উঁকি দেয় আকাশজোড়া স্বর্গীয় রঙধনু।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বর্ষা ঋতু ‘ছুটির ঋতু। অবিরল বর্ষণে আউশের ক্ষেত জলে ভর ভর অবস্থা হলে তিনি সবাইকে ঘরের বাইরে যেতে মানা করেছেন। আবার বাদল টুটে যাওয়ার পর মেঘের কোলে রোদ হাসলে উৎসাহ দিয়েছেন ছুটির আনন্দে মাততে। কবির কল্পনার রাজ্যের বাইরের জগৎটা সাধারণত অত স্বপ্নের মতো নির্ভার আর রঙিন হয় না।

গ্রীষ্মের খরতাপে অতিষ্ঠ প্রাণকে শীতলতা দানে জুড়ি নেই বর্ষাকালের। প্রকৃতি প্রেমিক মানুষের কাছে তাই বর্ষা নিয়ে আসে অভিনব ব্যঞ্জনা। আর কবিদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। বাংলার প্রকৃতি ও জনজীবনে এই ঋতুর প্রভাবের শেষ নেই। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বর্ষার রয়েছে উজ্জ্বল উপস্থিতি। গানে-কবিতায় বাংলার কবিরা করেছেন বর্ষা-বন্দনা। তাই ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ দিয়ে প্রণয় নিবেদন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ-বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান। জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কাছে বর্ষাকে মনে হয়েছে ‘বাদলের পরী’। তিনি লিখেছেন: রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে; কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে… রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে।