প্রত্যাশা ডেস্ক : ধর্ম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কথিত আপত্তিকর পোস্টটিকে কেন্দ্র করে রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দুপল্লিতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। কথিত ওই পোস্ট নিয়ে গত রোববার দিনভর আলোচনা ছিল এলাকায়।
পোস্টটি করেছিলেন উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের করিমপুর দক্ষিণপাড়ার এক তরুণ। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে পুলিশ তাঁর বাড়িতে পাহারা বসায়। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে গ্রামটি ঘিরে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়। রাত নয়টায় তারা অতর্কিতে হামলা চালায়।
রাতের তা-বের পর মাঝিপাড়ায় আতঙ্ক : সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের একটি রাত পেরিয়ে এসে রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া-বটতলা ও হাতিবান্ধা গ্রামে এখন সবার মাঝে আতঙ্ক।
ফেসবুকে এক তরুণের ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ তুলে মাঝিপাড়া জেলেপল্লীতে হিন্দুদের ২৯টি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রোববার রাতে। পুলিশ আর বিজিবি এখন পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে; সন্দেহভাজন হিসেবে ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার জানিয়েছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের লোকজন এসে পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু এক রাতে সব হারানো মানুষগুলো যেন বুঝে উঠতে পারছেন না, কীভাবে কী হল।
রংপুরের সহকারী পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান রাতে বলেছিলেন, ফেসবুকে এক হিন্দু তরুণ ‘ধর্মীয় অবমাননাকর’ পোস্ট দিয়েছেন অভিযোগ তুলে গ্রামের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ানো হয়।
“খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই তরুণের বসতবাড়ির আশপাশে অবস্থান নেয়। শেষ পর্যন্ত সেই বাড়িটি রক্ষা করা গেলেও হামলাকারীরা দূর থেকে কিছু বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়।”
সকালে ঘটনাস্থলে পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, “ওই বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে হিন্দুদের বাড়ি আর দোকানপাটে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সেখানে ফাঁকা গুলি ও রাবারবুলেট নিক্ষেপ করে পুলিশ। রাত ১টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।” স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কয়েকশ লোক আধা ঘণ্টা ধরে সেখানে তা-ব চালায়। ঘর আর দোকানপাটে আগুন দেওয়ার পাশাপাশি একটি মন্দির তারা ভাংচুর করে। লুট করে নিয়ে যায় গবাদিপশু ও নগদ টাকা। তাদের মারধরে কয়েকজন আহতও হন। হামলায় সর্বস্ব হারানো বাসন্তি রানী বলেন, “চাউল নাই বাবা আজ একনা খই মুড়ি খেয়ে আছি চাউল এ্যালা হামাক কে দিয়ে যাইবে। হামরা এ্যালা কি খেয়ে থাকমো বাবা।”
রোববার রাতেই জগদীশ রায়ের মেয়ের বিয়ে পাকা হওয়ার কথা ছিল। পাত্রপক্ষ আসার আগে হামলার ঘটনা ঘটে। বাড়ির সব আসবাব আগুনে পুড়ে গেছে। এক লাখ টাকা ও এক ভরি সোনাও লুট হয়ে গেছে। দুটি গরু ছিল। তা–ও নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। করিমপুরে ৬০টি পরিবারের বাস। তাদের ৫০টি গরু লুট হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। দুটি গরু আগুনে পুড়ে গেছে। লক্ষ্মী রানী বললেন, তাঁদের তিনটি গরু লুট হয়েছে। ভবেষ রায়ের চারটি গরু নিয়ে গেছে। কণিকা রানী বললেন, মুদিদোকানে দেড় লাখ টাকার মালামাল ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেই ছাই হাতড়ে বেড়াচ্ছেন, যদি কিছু মেলে সেই আশায়। কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘সব শেষ! কী নিয়ে বেঁচে থাকব, সেই চিন্তায় মাথা খারাপ হওয়া ছাড়া আর কী বাকি থাকিল!’
নন্দ রানীর ঘরের সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাঁর স্বামী প্রদীপ চন্দ্র রায়ের একমাত্র অটোরিকশাটিও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজনেরা আসছেন দেখতে। স্বজনদের জড়িয়ে তাঁর কান্না যেন আর থামে না।
হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, আশপাশের লোকজনের সঙ্গে আগুন দেওয়ার জন্য বাইরে থেকেও অনেকে এসেছিল। তাদের মধ্যে তরুণ ও যুবকদের সংখ্যা ছিল বেশি। প্রায় সবার হাতে ছিল লাঠি, রামদা, ছুরি। কারও কাছে ছিল কেরোসিন। হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের অনেকে পরিচিত মুখ।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ। প্রতি পরিবারকে দুই হাজার টাকা দিয়েছেন দলের নেতারা। সোমবার দুপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিউর রহমান ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেন। বেলা ১১টার দিকে করিমপুর গ্রামটি পরিদর্শনে আসেন বিভাগীয় কমিশনার আবদুল ওয়াব ভূঁঞা, পুলিশের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য, পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার, জেলা প্রশাসক আসিব আহসান ও র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা। পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ইতিমধ্যে ৪৫ জনকে আটক করা হয়েছে। নারকীয় এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কেউ ছাড় পাবে না। এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। এর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক বিষয় দেখছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজনীতির কথা বলতে পারব না। তবে উগ্র একটি গোষ্ঠী এ তা-ব চালিয়েছে।’
দুর্গাপূজা চলাকালে কুমিল্লার একটি পূজাম-পে কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে সহিংসতা শুরুর পর গত কয়েকদিনে তা ছড়িয়েছিল চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, ফেনীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। সেই সাম্প্রদায়িক আগুনেই রোববার রাতে পুড়ল পীরগঞ্জের মাঝিপাড়া।
ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানিয়েছে, রাত পৌনে ৯টার দিকে আগুনের খবর পেয়ে পীরগঞ্জ থেকে দুটি, মিঠাপুকুর থেকে দুটি ও রংপুর থেকে একটি ইউনিট সেখানে আগুন নেভাতে যায়। ভোর ৪টা ১০ মিনিটে আগুন নেভানো সম্ভব হয়। তার আগেই ১৫জন মালিকের ২৯টি বসতঘর, দুটি রান্নাঘর, দুটি গোয়াল ঘর এবং ২০টি খড়ের গাদা আগুনে পুড়ে যায়। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরকে দায়ী করে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্রলীগ। পীরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র এএসএম তাজিমুল ইসলাম শামীম বলেন, “এই ঘটনার সাথে যেই জড়িত হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। আমি আমার পৌরসভার পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাথমিক সহয়তা দিয়েছি।”
রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিফ আহসান বলেন, “জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সকল ধরনের সহযোগিতা তাদের করা হবে।”
রংপুর ও ফেনীর এসপিসহ সাত কর্মকর্তা বদলি : দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িত হামলা ও সহিংসতার মধ্যেই ফেনী ও রংপুরের পুলিশ সুপার এবং চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনারসহ এসপি মর্যাদার সাত কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এর মধ্যে রংপুর জেলার পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকারকে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ কমিশনারের দায়িত্বে পাঠানো হয়েছে। রংপুরের পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পেয়েছেন পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. ফেরদৌস আলী চৌধুরী। ফেনীর পুলিশ সুপার খোন্দকার নুরুন্নবীকে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি করে ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে। পুলিশ সদরদপ্তরের আরেক এআইজি আব্দুল্লাহ আল মামুনকে এসপি হিসেবে ফেনীতে পাঠানো হচ্ছে।
এর আগে বিজয়া দশমীর দিন শুক্রবার চট্টগ্রামের জেএম সেন হলের পূজাম-পে হামলার পর ওই এলাকার দায়িত্বে থাকা উপকমিশনার (চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ দক্ষিণ) বিজয় বসাককে ঢাকা জেলা সিআইডিতে পাঠিয়ে পুলিশ সদরের এআইজি সোহেল রানাকে উপকমিশনার হিসেবে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়েছে। এছাড়া সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার সঞ্জয় সরকারকে বদলি করা হয়েছে চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশে।
গতকাল সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এই সাত কর্মকর্তার দায়িত্বে রদবদল আনার কথা জানানো হয়।
কথিত ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে হামলা, লুটপাট
জনপ্রিয় সংবাদ