নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে সরকার। বিধিনিষেধে বলা হয়েছে, অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হতে পারবেন না। বের হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই বিধিনিষেধ চলবে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত।
গতকাল বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন সমন্বয় অধিশাখা থেকে এই সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
উপসচিব মো. রেজাউল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, লকডাউন চলাকালে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। মোতায়েন থাকবে সেনাবাহিনী। এছাড়া জেলা বিজিবি, পুলিশ, র্যা ব ও আনসার সদস্যরা টহলে থাকবেন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিধিনিষেধ চলাকালে সব সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সব ধরনের যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। বন্ধ থাকবে শপিংমল, মার্কেটসহ সব ধরনের দোকানপাট। পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্রের দুয়ার খুলবে না। বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি, রাজনৈতিক, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। জনসমাবেশ হয় এমন কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। আদালত পাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট থেকে দেয়া হবে। ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দেবে। বিধিনিষেধ অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা যেমন- কৃষি পণ্য ও উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিরতণ, স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড-১৯ টিকা দেওয়া, রাজস্ব আদায় বিষয়ে কাজ, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবা, ব্যাংক, ফার্মেসি ও ফার্মাসিটিক্যালসসহ অন্যান্য জরুরি বা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মচারী ও যানবাহন প্রতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র দেখিয়ে চলাচল করতে পারবে।
এছাড়া পণ্য পরিবহণের জন্য ট্রাক, লরি, কভার্ড ভ্যান, কার্গো ভেসেল এই বিধিনিষেধের বাইরে থাকবে। বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল বন্দরগুলো এবং তাদের অফিস বিধিনিষেধের বাইরে থাকবে। শিল্প-কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে।
কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কেনাবেচার জন্য সময় ঠিক করে দিয়েছে সরকার। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিত্যপণ্য কেনাবেচা করা যাবে। সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন, বাজার কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। এই নির্দেশনা না মানলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অতি জরুরি প্রয়োজন বলতে বোঝানো হয়েছে, ওষুধ ও নিত্যা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা, চিকিৎসা সেবা, মৃত মানুষের দাফন বা সৎকার ইত্যাদি।
যারা করোনা ভাইরাসের টিকা নিতে বের হবেন তারা টিকা কার্ড দেখিয়ে চলাচল করতে পারবেন।
খাবারের দোকান, হোটল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অনলাইনে বা পার্সেলে খাবার বিক্রি করতে পারবে। কেউ দোকানে বসে খেতে পারবে না। বিধিনিষেধ চলাকালে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে। বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের বিমান টিকিট দেখিয়ে বিমানবন্দরে যেতে পারবেন। মসজিদে নামাজ আদায়ের বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দেবে বলে জানানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে লকডাউন কার্যকর করার জন্য মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহলের বিষয় সম্পর্কেও বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের অধীনে মাঠ পর্যায়ে কার্যকর টহল নিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সেনা কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করে বিষিয়টি নিশ্চিত করবেন।
এছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যা ব ও আনসার নিয়োগ এবং টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি ও সময় ঠিক করে দেবেন। সেই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বিশেষ কোনো কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সে বিষয় পদক্ষেপ নিবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করবে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তার পক্ষে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেবেন।
মসজিদে নামাজ আদায়ে ৯ নির্দেশনা : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় আজ বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) থেকে সাত দিনের কঠোর লকডাউন দিয়েছে সরকার। এ সময়ে প্রত্যেক মুসল্লিকে নিজ নিজ বাসা থেকে ওজু করে, সুন্নত নামাজ ঘরে আদায় করে মসজিদে আসতে হবে। এছাড়া মসজিদে আগত মুসল্লিদের অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) সকাল ৬টা থেকে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে জরুরি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবজনিত কারণে সারা দেশে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ৩০ জুন কতিপয় বিধি-নিষেধ আরোপ করে নির্দেশনা জারি করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সকল ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং মসজিদে জামায়াতের নামাজের জন্য আবশ্যিকভাবে ৯টি শর্ত পালনের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
১. মসজিদের প্রবেশদ্বারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার/হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ সাবান-পানি রাখতে হবে এবং আগত মুসল্লিদেরকে অবশ্যই মাস্ক পরে মসজিদে আসতে হবে।
২. প্রত্যেককে নিজ নিজ বাসা থেকে ওজু করে, সুন্নত নামাজ ঘরে আদায় করে মসজিদে আসতে হবে এবং ওজু করার সময় কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
৩. মসজিদে কারপেট বিছানো যাবে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে সম্পূর্ণ মসজিদ জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। মুসল্লিরা প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্বে জায়নামাজ নিয়ে আসতে হবে।
৪. কাতারে নামাজে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
৫. শিশু, বৃদ্ধ, যে কোনো অসুস্থ ব্যক্তি এবং অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি জামায়াতে অংশগ্রহণ করা হতে বিরত থাকবে।
৬. সংক্রমণ রোধ নিশ্চিতকল্পে মসজিদের ওজুখানায় সাবান/হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে। মসজিদে সংরক্ষিত জায়নামাজ ও টুপি ব্যবহার করা যাবে না।
৭. সর্বসাধারণের সুরক্ষা নিশ্চিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীর নির্দেশনা অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
৮. করোনাভাইরাস মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নামাজ শেষে মহান রব্বুল আ’লামিনের দরবারে খতিব, ইমাম ও মুসল্লিরা দোয়া করবেন।
৯. সম্মানিত খতিব, ইমাম এবং মসজিদ পরিচালনা কমিটি বিষয়গুলো বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবেন।
অন্যান্য সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা উপাসনালয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাস্ক পরিধান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার/সাবান দিয়ে হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। এসব নির্দেশনা লঙ্ঘিত হলে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনী, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট মসজিদের পরিচালনা কমিটিকে উল্লিখিত নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলাচল স্থগিত : আজ থেকে শুরু হতে যাওয়া সরকারি বিধিনিষেধের কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলাচল স্থগিত ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। গতকাল বুধবার এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বেবিচক। বেবিচকের ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগের সদস্য গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী এম জিয়াউল কবির স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী ১ জুলাই ভোর ৬টা থেকে ৭ জুলাই রাত ১১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রুটের সব ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে। তবে ত্রাণ-সাহায্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফ্লাইটগুলো অনুমতি নিয়ে চলতে পারবে।’ এছাড়াও বিমানবন্দরগুলোতে যেসব আন্তর্জাতিক ও বিশেষ ফ্লাইট চলবে, সেগুলোকে সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত সোমবার সকাল ৬টা থেকে দেশে সীমিতকারে লকডাউন চলছে। এর আওতায় বন্ধ রাখা হয়েছে গণপরিবহন চলাচল। এছাড়া সুনির্র্দিষ্ট বিধিনিষেধও দিয়েছে সরকার।
কঠোর লকডাউনে দেশ,বাইরে বেরোলেই শাস্তি
ট্যাগস :
কঠোর লকডাউনে দেশ
জনপ্রিয় সংবাদ