নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ‘কঠোর’ লকডাউনে দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা শিথিলতা দেখা যাচ্ছে। জনসচেতনতা বাড়াতে চলেছে মাইকিং। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরাও মাঠে আছেন। তারপরও রাজধানীর অনেক এলাকায় মানুষের চলাচল বেড়েছে। ‘জীবিকার প্রয়োজনে’ বের হওয়ার কথা বলছেন তারা।
দেশে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরন ছড়িয়ে পড়ায় শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রেও খুব বেশি গরজ নেই মানুষের। এখনও মাস্ক দেখা যাচ্ছে না অনেকের মুখে।
গতকাল বুধবার কঠোর লকডাউনের সপ্তম দিনে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে পুলিশের তল্লাশি থাকলেও বৃষ্টির কারণে তা ছিল কিছুটা শিথিল।
সকাল সাড়ে ৭টা থেকেই রামপুরা, মৌচাক, মালিবাগ, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নিউ মার্কেট, আজিমপুর, লালবাগ, কেল্লারমোড়, বকশিবাজার, পলাশী, লালবাগ চৌরাস্তা এলাকায় বাড়তে থাকে মানুষের আনাগোনা।
রাস্তায় রিকশার উপস্থিতি ছিল বেশ। বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাস, বিভিন্ন অফিসের মিনিবাসও দেখা গেছে। সরকারি-বেসরকারি কিছু হাসপাতালের কর্মীদের বিআরটিসির দ্বিতল বাসে চড়ে নিজ নিজ কর্মস্থলে যেতে দেখা গেছে। নাগরিকদের ঘরে থাকার এবং মাস্ক পরার অনুরোধ জানিয়ে মাইকিং করতে দেখা গেছে রামপুরা বাজার, শান্তিনগর বাজার, কাকরাইলের মোড়ে।
মালিবাগ ও কাকরাইলে পুলিশের তল্লাশি চৌকির সামনে ছিলো রিকশা ও প্রাইভেট কারের জট। অনেককে জরিমানাও করতে দেখা গেছে। শান্তিনগরে বাজার করতে আসা হাবিবুর রহমান বলেন, “মানুষজন সচেতন হচ্ছে না। প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও তাদের মধ্যে কোনো বোধ সৃষ্টি হচ্ছে না। লকডাউনেও যদি এভাবে মানুষজন রাস্তায় বের হলে সরকারের কী করার আছে?”
দিনমজুর কালাম কাজের সন্ধানে শান্তিনগরে একটি শেডের নিচে বসে ছিলেন। জানালেন, গত ৬ দিন ধরে তিনি কর্মহীন। নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় তার উপার্জনের পথও বন্ধ।
মঙ্গলবার ভাড়ায় ঠেলাগাড়ি চালিয়েছিলেন। কিন্তু দোকান-পাট বন্ধ থাকায় দিনের খোরাকিও তুলতে পারেননি। সেজন্য বুধবার আবার জোগালির কাজের সন্ধানে সকাল থেকে বসে আছেন। “কোনো কাজ নাই। খুব কষ্টে আছি পরিবার নিয়া। লকডাউনে কাজ-কর্ম সব বন্ধ কইরা দিলে আমরা বাঁচমু কি কইরা?” সকাল পৌনে ৯টার দিকে মিরপুর শাহ আলী কাঁচাবাজারের দিক থেকে ভ্যানগাড়িতে শাক-সবজি, ফল নিয়ে কয়েকজনকে দেখা গেল বিভিন্ন গন্তেব্যে যেতে। একজন ভ্যান চালক জানালেন, অন্য সময় খুব ভোরে এসব মালামাল পরিবহন করা হয়। এখন লকডাউন থাকায় কিছুটা দেরি হলেও মূল সড়ক ধরে তারা যাতায়াত করতে পারছেন।
মিরপুর-২ নম্বর সেকশন এলাকায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল লাগোয়া ওভার ব্রিজের উত্তর প্রান্তে দাঁড়িয়ে হাল্কা বৃষ্টিতে ভিজছিলেন একজন। কেন দাঁড়িয়ে আছেন জানতে চাইলে বললেন, বনানীতে অফিসে যেতে হবে। অফিসের মাইক্রোবাস আসবে, সেজন্যই দাঁড়িয়ে।
“আমাদের অফিস চলে খুবই সীমিত পরিসরে। এই সপ্তাহে আজ আমি অফিসে যাচ্ছি। সরকার বন্ধ ঘোষণা করলেও কাজ থেমে নেই। কাজ থামিয়ে রাখা যায় না। কাজ না করলে জীবন চলবে কী করে।”
অন্যান্য দিন মিরপুরের ষাট ফুট সড়কে কড়া তল্লাশি থাকলেও বুধবার সকালে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা বৃষ্টির কারণে ছিলেন ছাউনিতে। তাদের একজন বললেন, “এই সকালে যারাই রাস্তায় নামছে, কোনো না কোনো প্রয়োজনেই আসছে। সকালে বৃষ্টির মাত্রা যখন কম ছিল, অনেককে জিজ্ঞাসা করেছি। সবাই প্রয়োজনেই বেরিয়ে এসেছে।” সকালে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেশ কিছু খাবারের হোটেল খোলা পাওয়া যায়। বসার চেয়ারগুলো রাখা হয়েছে উল্টো করে। সকালের নাস্তা তৈরি করে পারসেলের জন্য প্রস্তুত করে রাখছিলেন কর্মীরা। দু-চারটি মুদির দোকানও খোলা দেখা গেছে।
মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে দেখা গেল সারি সারি রিকশা। মিরপুর-১৪ নম্বরের দিক থেকে আসা প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসের লম্বা লাইন পড়ে গেছে তল্লাশির কারণে। পুলিশ সদস্যরা জানালেন, বাইরে বের হওয়ার যেসব কারণে মানুষ দেখাচ্ছে তাতে বেশিরভাগকেই আটকানো যাচ্ছে না। তবে কারও উত্তর সন্তোষজনক না হলে ‘আরও ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ’ করা হচ্ছে। কালশী মোড় ও ক্যান্টিন এলাকা এবং ইসিবি চত্বরে অফিসগামী মানুষকে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেল। অনেকেই প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল চালকদের সঙ্গে দরকষাকষি করছিলেন। উত্তরার যাত্রী আহমেদ কমল বললেন, “মোটরসাইকেলে বেশি ভাড়া চাচ্ছে। এতো দূরের পথে রিকশায় যাওয়াও সম্ভব না। লকডাউনের এই ১৪ দিনে তো বেতনের অর্ধেক টাকা ভাড়া দিতেই চলে যাবে।”
মিরপুরের বিভিন্ন সড়কজুড়ে বহু মানুষকে পায়ে হেঁটে চলাচল করতে দেখা গেল, যাদের বেশিরভাগই পোশাক কর্মী। অনেকে রাস্তার পাশের ভ্যান থেকেও সবজি কিনছিলেন।
সেখানে সবজি বিক্রেতা বিল্লাল বলেন, “আগে তো ভাবছিলাম লকডাউনে আমাদের দাঁড়াইতেই দিব না। খুব চিন্তায় আছিলাম। আবার মানুষ বাইর হইলে পুলিশ ধইরা নিয়া যাইব শুনছিলাম। কিন্তু মোটামুটি ভালই কেনাবেচা হইতেছে।”
সকালে বৃষ্টির কারণে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবর, শেখেরটেক, তাজমহল রোডসহ বিভিন্ন এলাকার পাড়া মহল্লায় গত কয়েকদিনের চেয়ে মানুষের আনাগোনা কম ছিল। রাস্তায় রিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়িও অন্যদিনের চেয়ে কম দেখা গেছে। আছিয়া বেগম নামে এক নারী জানালেন, তিনি বিভিন্ন বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। লকডাউনের প্রথম দুদিন কাজে বের হননি। এখন আবার বাসায় বাসায় যাচ্ছেন। এলাকার ভেতরে পুলিশ কখনও কিছু বলেনি।
শেখেরটেকে মাছ বিক্রেতা আজিজুল ইসলাম বললেন, “গলির ভিতরে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করি। আজ বৃষ্টি দেইখা সকালে বেচাবিক্রি কম।”
লালবাগ চৌরাস্তা, পলাশীর মোড় ও বকশিবাজারে অলিগলিতে মানুষের উপস্থিতি গত কয়েক দিনের চেয়ে বেড়েছে। কেউ মাছ, শাক সবজি, ফল বিক্রি করছেন, কেউ এসেছেন কিনতে। পলাশীর মোড় ও শাহবাগ সড়কে গাড়ি ও রিকশা চলাচল করছে আগের দিনগুলোর চেয়ে বেশি। আজিমপুর কবরস্থান এলাকায় বেশ কিছু নারীকে দলবেঁধে হাঁটতে দেখা গেল। জানতে চাইলে তাদের একজন বললেন, “আমরা দৈনিক রোজে কাজ করি। কাজে যাচ্ছি, কাজ না করলে খামু কী?”
ঢাকায় একদিনে রেকর্ড গ্রেফতার ১১০২ : কঠোর লকডাউনের সপ্তম দিনে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে বাইরে বের হয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হাতে গ্রেফতার হয়েছেন ১১০২ জন। এছাড়া ২৪৫ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা করা হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৯৮০ টাকা। এছাড়া ট্রাফিক বিভাগ ৮০৪টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলায় জরিমানা করেছে ১৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা। এ নিয়ে লকডাউনে আজ পর্যন্ত রাজধানীতে মোট গ্রেফতার হয়েছেন ৪১৮৭ জন।
গতকাল বুধবার লকডাউনের সপ্তম দিনে অভিযানে এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয় ডিএমপির ৮টি বিভাগ। বুধবার বিকেলে এসব তথ্য জানান ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ইফতেখায়রুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘লকডাউনের সপ্তম দিনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিএমপির ৮টি বিভাগের রমনা, লালবাগ, মতিঝিল, ওয়ারী, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান ও উত্তরা এলাকায় সরকারি নিয়ম অমান্য করে বাইরে বের হওয়ায় ১১০২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। লকডাউনে সড়কে যানবাহন নিয়ে বের হওয়ায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত ও ট্রাফিক বিভাগ ৮০৪টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলায় জরিমানা করেছে ১৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা। তিনি আরও বলেন, অকারণে ও নানা অজুহাতে ঘর থেকে বের হওয়ায় ২৪৫ জনকে ১ লাখ ৭১ হাজার ৯৮০ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে লকডাউনের ষষ্ঠ দিন (মঙ্গলবার) সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে বাইরে বের হয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হাতে গ্রেফতার হন ৪৬৭ জন। ৩০৫ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা করা হয় ২ লাখ ২৭ হাজার ৪৮০ টাকা। এছাড়া ট্রাফিক বিভাগ কর্তৃক ১০৮৭টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলায় জরিমানা করা হয় ২৫ লাখ ২৯ হাজার টাকা। আর পঞ্চম দিনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছাড়া বাইরে বের হওয়ায় রাজধানীজুড়ে ৫০৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেদিন ২৮৭ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা করা হয় এক লাখ ৫৭ হাজার ৬০০ টাকা। এছাড়া ট্রাফিক বিভাগ কর্তৃক ৫২৬টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলায় জরিমানা করা হয় ১২ লাখ ২৩ হাজার ৩০০ টাকা।
কঠোর লকডাউনেও মানুষ বাড়ছে রাস্তায়
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ