ঢাকা ০৮:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫
শহর ভাবনা

কংক্রিটের জঙ্গল আর সিলিকন স্বপ্ন: ঢাকার বিশৃঙ্খল আধুনিকতা

  • আপডেট সময় : ০৭:৪৪:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ৭ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

ড. মাহবুবুর রহমান

ঢাকা বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। মোগল আমলের ঐশ্বর্যবান নগরী তখনো ছিল লন্ডনের পর পরই সেরা। ঢাকা বিশ্বের এমন এক নগরী- যা বারবার রাজধানী হয়েছে। তবে ঔপনিবেশিক আমলে এর পতনের শুরু। জার্মান ভূগোলবিদ ওয়াল্টার ক্রিস্টালার ১৯৩৩ সালে ভূদৃশ্যজুড়ে শহরগুলোর স্থানিক বণ্টন ব্যাখ্যা করার জন্য সেন্ট্রাল প্লেস থিওরি বিশ্লেষণ করেছিলেন। তত্ত্বটি ব্যবহার করে ওয়েন্ডওভার প্রডাকশনস- যা আকর্ষণীয় ব্যাখ্যামূলক ভিডিও তৈরি করে, শহরগুলো কেন আজকের অবস্থানে রয়েছে তার কারণগুলো অনুসন্ধান করে। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে রাজনীতি ও ইতিহাস বাদ দিয়ে একটি শহর নির্মাণের জন্য পৃথিবীর সেরা স্থান হলো ঢাকা। ভৌগোলিকভাবে বলতে গেলে বাংলাদেশের বৃহত্তম শহর এবং রাজধানী ঢাকা ‘মানবসভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু’ হওয়ার সব মানদণ্ড পূরণ করে। প্রকৃতপক্ষে মোগলরা এর অবস্থানগত সুবিধাগুলো দেখেই এ জায়গাকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছিল।

ঢাকা আদর্শভাবে অবস্থিত এবং একটি উন্নত শহর হওয়ার সব উপাদান এর রয়েছে। কিন্তু এটি এখন একটি বিশৃঙ্খল ও অসম্পূর্ণ নগরী বটে। এটি মনোজগতে একটি ঘাত যার বাতাস ভেজা ধুলো এবং ডিজেলের গন্ধে ভারী, যেখানে শব্দকল্প তৈরি হয় হর্নের অবিরাম হাহাকারে; যেখানে নগরচিত্র হচ্ছে রিকশার গায়ে আঁকা এক ক্যালিডোস্কোপ, চকচকে গ্লাস টাওয়ার আর একটি ভয়ংকর পশুর পাকতন্ত্রের মতো তারের জট। ঢাকার রাস্তায় হাঁটলেই মনে হবে শহরটি তার নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছে যা অপরিকল্পিত বিস্তারের খোলস ঝেড়ে একটি আধুনিক মেগাসিটি হয়ে উঠতে মরিয়া সংগ্রাম করছে। ঢাকা নগরীতে এমন একটি ‘বিশৃঙ্খল আধুনিকতা’ দেখা যায়- যেখানে স্বপ্নালি আর সামন্তবাদী, ডিজিটাল এবং ক্ষয়িষ্ণুতা, বিএমডব্লিউ এবং গরুর গাড়ি, একে অন্যের ওপর উপচে পড়ছে। এ বিশৃঙ্খল আধুনিকতা অবকাঠামো, আর্থসামাজিক স্তরবিন্যাস, পরিবেশগত অবক্ষয় এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছে একটি ক্লান্তিকর কিন্তু আনন্দদায়ক শহর। কয়েক দশক ধরে ঢাকার চিত্র ছিল যানজট নামের ধাতু এবং মানবতার এক অবিচল স্তূপ যেখানে ১০ কিলোমিটার রাস্তা সহজেই দিনের ৩ ঘণ্টা গ্রাস করতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে আকাশরেখা বদলাচ্ছে; মেট্রো ও এক্সপ্রেসওয়ে শহরের যানজটকে দুইতলায় ভাগ করে ফেলেছে।

আধা ঘণ্টার কমে উত্তর থেকে কেন্দ্রে চলা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেট্রোর জানালা থেকে ঢাকা দেখতে লাগে সংগঠিত আর শান্ত। উঁচু ভবন, বিলবোর্ড, বাড়িঘরের ছাদ, সবুজ, আর একঝলক ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। মেট্রো হলো আধুনিকতার একটি বিশুদ্ধ, দক্ষ বুদ্বুদ, ডিজিটাল পাস এবং সুশৃঙ্খল কিউ- একটি লোকাল বাসে চড়ার জন্য অবশ্যম্ভাবী ঝগড়ার থেকে হাজার যোজন দূর। তবে এ কংক্রিট ধমনীর নিচে ধরণীর বিশৃঙ্খলা আগের মতোই। দ্রুতগামী লেনগুলোর স্তম্ভগুলো সরু রাস্তাগুলোকে কামড়ে ধরে তৈরি করেছে অন্ধকার, ধুলোময় করিডোর যেখানে রিকশা, সিএনজি এবং ভাঙা বাসগুলো কয়েক ইঞ্চি অ্যাসফলটের জন্য লড়াই করে। এটি উন্নত অবকাঠামোর প্যারাডক্স: ট্রাফিকের সমাধান একটি শ্রেণীকে ওপরে আলাদা করে দিয়েছে। ধনীরা নিজের গাড়িতে টোলওয়ালা এক্সপ্রেসওয়েতে ছুটে চলে, আর মধ্যবিত্তরা চড়ে মেট্রোতে। অন্যদিকে পোশাক শ্রমিক, দিনমজুর এবং ফেরিওয়ালা নিচে লড়াই করে দম ফেলতে। ঢাকার অবকাঠামোর আধুনিকতা একরকম জগাখিচুড়ি। এটি প্রাথমিকভাবে বাধা সৃষ্টিকারী মৌলিক নাগরিক বিপর্যয়গুলোকে উপেক্ষা করে ভাগ্যবানদের চলাচলপ্রবাহের নিশ্চয়তা দেয়। যদিও শহরটি কখনো গাড়ির জন্য বানানো হয়নি, তবুও এটি এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করে। খাল-বিল ব-দ্বীপীয় শহরটি খাল-বিল-নালা ভরাট করে ভূগর্ভস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি করে যা খানিক বৃষ্টিতেই আটকে যায়। প্রকৃতি ও পরিকল্পনার মধ্যে এ বিচ্ছিন্নতাই ঢাকা শহরের বিশৃঙ্খল আধুনিকতার ভিত্তি।

ঢাকার আর্থসামাজিক ভূগোলের চেয়ে এই স্কিজোফ্রেনিয়া আর কোথাও বেশি দেখা যায় না। বনানী লেকের ধারে আছে বৈষম্যের রেখা। একদিকে করপোরেট কাচের ফ্যাসাদ এবং বিলাসবহুল হাইরাইজ আর বহুজাতিক ব্যাংকগুলো চকচক করছে; ছাদের ফিউশন রেস্তোরাঁগুলো নিউইয়র্কসম দাম হাঁকাচ্ছে। আর অ্যাপার্টমেন্টগুলো হাত বদলাচ্ছে ন্যূনতম ৪০ লাখ ডলারে। ঢাকার ‘আধুনিকতা’ যেন ঘষামাজা, কসম্যাটিক আর ভোগ্য—আমদানি করা কফি, এয়ার পিউরিফাইয়ার। আর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীবেষ্টিত একটি প্রাচীরঘেরা নিরাপদ অস্তিত্ব। এর কয়েকশ মিটার দূরেই আছে বিশ্বের বৃহত্তম বস্তি—টিন, বাঁশ এবং সংঘাতসহনীয় এক ঘন, জৈব গোলকধাঁধা। এটি শহরের ইঞ্জিন রুম—আপনার গৃহকর্মী, বিলাসবহুল গাড়ির ড্রাইভার এবং অফিস স্টাফের চড়া রিকশাওয়ালা—নিষ্ঠুর ‘আধুনিকতার’ পাশে সবার সহাবস্থান।

উঁচু ভবনগুলোয় রয়েছে উচ্চগতির ফাইবার ইন্টারনেট ও জেনারেটর ব্যাকআপ, আর বস্তিগুলো নিরন্তর লড়াই করে বেআইনি ও বিপজ্জনক বিদ্যুৎ সংযোগ, স্যানিটেশনের অনুপস্থিতি আর অগ্নিঝুঁকির সঙ্গে। বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও বস্তিগুলোয় একটি অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়া কাজ করে। এগুলো আধুনিক শহর থেকে আলাদা নয়; শহরই একে লালন করে। এ বিশাল সস্তা, অনানুষ্ঠানিক শ্রমের ওপর নির্ভর করেই তো ঢাকার দ্রুত আধুনিক হয়ে ওঠা। ঝামেলা দেখা দেয় তখনই- যখন নগর পরিকল্পনা এ সম্প্রদায়গুলোকে একীভূত করার পরিবর্তে; যা প্রায়ই হয়, ‘দৃষ্টিক্ষত’ হিসেবে বিবেচনা করে। ‘সৌন্দর্যকরণ’ প্রকল্পগুলোয় হকারদের উচ্ছেদ করা হয় এবং চা-সিগারেটের টংগুলোকে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় যাতে পরিষ্কার হাঁটার পথ তৈরি করা যায়। আধুনিকতার আখ্যান থেকে দরিদ্রদের এই বাদ দেয়া নিশ্চিত করে যে শহরটি অস্থির ও শুধু ক্ষমতাবানদের থাকে, চকচকে ও ধবধবে নতুন উন্নয়ন অপরাধ, যা সব কুশ্রী এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতাকে ঢেকে রাখে।

আধুনিকতার দিকে ঢাকার অগ্রযাত্রায় একে মূল্য দিতে হয়েছে অনেক। একে একে সবুজ গেছে হারিয়ে। প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থার অংশ প্রাচ্যের ভেনিসের খাল এবং নদীগুলোকে ভরাট করে রিয়েল এস্টেট তৈরি করা হয়েছে। ফলে ‘হিট আইল্যান্ডের প্রভাবে আশপাশের এলাকা চুল্লিতে পরিণত হয়েছে। পুরান ঢাকার প্রাণভ্রমরা বুড়িগঙ্গা ওই আধুনিকীকরণের বলি-রাসায়নিক কাদার একটি সান্দ্র প্রবাহ; যা অপরিশোধিত বর্জ্যপ্রসূত কালোতে রাঙানো। আধুনিক’ চামড়া শিল্প, যা এখন অনেক উজানে আর কোটি কোটি টাকা আয়কারী, তারা বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি লাখ লাখ মানুষের ব্যবহৃত জলে ফেলে দেয়। ঢাকা বায়ুদূষণেও প্রায়ই বিশ্ব তালিকার শীর্ষে থাকে। শহরকে বাঁচানোর জন্য তৈরি প্রকল্পগুলোর নির্মাণ ধুলো, যানবাহনের নির্গমন, এবং ইটভাটার ধোঁয়া একাকার হয়ে একটি বিষাক্ত ধূসর ধোঁয়াশা তৈরি করে।

ঢাকাবাসী দূষণকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে- যা অন্য দেশে জীবনের জন্য বিপজ্জনক ধরা হয়। মুখোশ পরে জগিং আর বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়া ‘আধুনিক স্বাস্থ্য সচেতনতার’ অযৌক্তিকতারই প্রমাণ। এ পরিবেশগত অবক্ষয় অস্তিত্বগত বিশৃঙ্খলাকে আরেকটি মাত্রা দেয়। শহরটি ক্রমাগত ভেঙে পড়া ভিত্তির ওপর ফুলেফেঁপে উঠছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমে নেমে যাচ্ছে। এ অপরিকল্পিত কংক্রিট জঙ্গলে ভূমিকম্প একটি ভয়াবহ ঝুঁকি যা বেশির ভাগই উপেক্ষা করে, কারণ দৈনন্দিন জীবনের তাৎক্ষণিক সংগ্রামই তাদের অগ্রাধিকার।

ঢাকার একটি ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটছে। ঐতিহ্যগতভাবে দৈনন্দিন জীবন আবর্তিত হতো পাড়া ঘিরে- যা ছিল একটি সমষ্টিগত অস্তিত্ব; যেখানে গোপনীয়তার চেয়ে প্রতিবেশীর নৈকট্য ও সামাজিক সমর্থন ছিল বেশি। চাওয়ালা, মোড়ের ফার্মেসি মালিক ও পাড়ার যে কারো কাজ সম্পর্কে মানুষ জানত। পাড়ানির্ভর সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে অ্যাপার্টমেন্টচালিত আধুনিকতা। টানা বারান্দাসহ একতলা বাড়ির বিস্তৃতির বদলে আমরা পেয়েছি কংক্রিক ধূসর সাইলো। একই দেয়ালের দু’পাশের প্রতিবেশীরা বছরের পর বছর বিচ্ছিন্নভাবে সময় কাটায়। এটি বিশ্বব্যাপী আধুনিক নগর জীবনের একটি সমস্যা এবং সামাজিক আতিথেয়তা ও সাংস্কৃতিক পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষভাবে বিরক্তিকর।

একটি ডিজিটাল সংস্কৃতি ক্রমান্বয়ে আমাদের গ্রাস করছে। ঢাকাবাসীর মধ্যম বয়স ৩০- যারা অনলাইনে থাকে। রাস্তাঘাটের বিশৃঙ্খলা—হয়রানি, যানজট, ধুলো—আমাদেরকে ডিজিটাল জগতে ঠেলে দিয়েছে। ই-কমার্স ও ফুড ডেলিভারি শহরে বিপ্লব এনে দিয়েছে। বিশৃঙ্খল আধুনিকতার স্বরূপ হলো একজন ফুডপান্ডা রাইডার যিনি পুরান ঢাকার উনিশ শতকের একটি গলিতে ঘুরছেন ৫জি স্মার্টফোন ব্যবহার করে ক্লাউড কিচেন থেকে একজন মার্কিন ক্লায়েন্টের জন্য কর্মরত ফ্রিল্যান্সারের কাছে বার্গার পৌঁছে দিতে। এ ডিজিটাল ধারাটি এক নতুন ধরনের অর্থনৈতিক গতিশীলতাও তৈরি করেছে। তরুণদের দ্বারা ‘স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের’ উত্থান হচ্ছে যারা শহরের সমস্যাগুলো হ্যাক করার চেষ্টা করছে, অ্যাপ তৈরি করছে বাস টিকিটিং আর অ্যাম্বুলেন্স খুঁজতে, মুদিখানা থেকে বাজার নিতে। এটি একটি শেকড় থেকে গজানো আধুনিকীকরণ যা ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া উদ্যোগের চেয়ে ভালো কাজ করে।

আমরা পুরান ঢাকার পুনরুত্থান দেখতে পাচ্ছি- যা বিশৃঙ্খল, প্রাণবন্ত আকর্ষণকেই পুঁজি করেছে। তরুণ প্রভাবশালীরা ভোররাতে নাজিরাবাজারে বিরিয়ানির জন্য ভিড় জমায়। পরিকল্পনাকারীরা যে ভিড় ও জঞ্জাল উপেক্ষা করে, তাকে তারা রোমান্টিক করে তোলে। নতুন শহরের ঝকঝক, মলকেন্দ্রিক সংস্কৃতি এবং পুরনো শহরের কাঁচা, সংবেদনশীল-ওভারলোড সংস্কৃতির মধ্যে এক টানাপড়েন চলছে। ঢাকার বিশৃঙ্খল আধুনিকতার সবচেয়ে গভীর প্রকাশ হলো এটি মানুষের মনকে যেভাবে প্রভাবিত করছে। ঢাকায় বসবাসের জন্য অনেক বুদ্ধি খরচ করতে হয়, রাস্তা বাছতে হিসাব করতে হয় কতটা যানজট থাকবে, জলাবদ্ধতা হবে কিনা, মিছিলে আটকে পড়বে কিনা, বাতাসে নিশ্বাস নেয়া যাবে কি? এই অতিসতর্কতা মগজকে ঝুঁকিতে রাখে। ‘

সহিষ্ণু ঢাকাইয়া’ যে যে কোনো কিছু সহ্য করতে পারে তা মানসিক ঘাতের জন্য একটি আবেদনময়ী কিন্তু বিপজ্জনক শব্দ। বিশৃঙ্খল আধুনিকতা মানুষকে অস্বাভাবিকতাকেই স্বাভাবিক ভাবতে বাধ্য করে। যেমন- ৪ ঘণ্টা ট্রাফিকের মধ্যে ব্যয় করা, অধিকার আদায়ের জন্য ঘুস দেয়া, অন্য দেশে অগ্রহণীয় অতি কোলাহল মেনে নেয়া। এই জ্বালাপোড়া-কায়ক্লেশের মধ্যে একটি অনস্বীকার্য শক্তি রয়েছে। ঢাকা একটি ব্যস্ততার শহর; এর বিশৃঙ্খলতা প্রতিভাবানদের জন্য সুযোগ তৈরি করে। আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে ছাতা বা মুখোশ বিক্রি করা ফেরিওয়ালা থেকে বিশ্বব্যাপী ব্যস্ত বায়িং হাউজের নির্বাহী পর্যন্ত, সবাই বেঁচে থাকতে আর এবং উন্নতি করতে একই অবিরাম প্রচেষ্টায় নিয়োজিত।

ওই ‘বিশৃঙ্খল শক্তি’ আসক্তিকর। যারা ঢাকা ছেড়ে উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমাচ্ছেন, তাদের অনেকেই প্রায়ই এ জাদুর শহরের স্পন্দন-ঘূর্ণায়মাণ ঘূর্ণির কেন্দ্রে থাকার অনুভূতি, যেখানে প্রতিদিন কিছু না কিছু ঘটছে, ভুলতে পারেন না। রৈখিক অগ্রগতির পরিবর্তে ঢাকার আধুনিকতা একটি অস্থির বিস্ফোরণ। এটি এমন একটি শহর- যা উনবিংশ শতাব্দী থেকে প্রায়ই বিংশ শতাব্দীর প্রয়োজনীয় ধাপগুলো (যেমন- নীল-সবুজের সমারোহ বা নাগরিক আচরণ) এড়িয়ে একবিংশ শতাব্দীতে ঝাঁপিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।

ঢাকা হয়ে উঠছে একটি চরম প্রান্তিক শহর; যেখানে বিশ্বমানের মেট্রো ট্রেনে চড়ে এমন একটি বাজারে যাওয়া যাবে; যেখানে চোখের সামনেই মুরগি জবাই করে বিক্রি হয় অথবা উবার ডেকে গিয়ে খোলা আকাশের নিচে ফুচকা খাওয়া যাবে। এটি এমন একটি জায়গা- যেখানে ধনী ও দরিদ্রতমরা একে অন্যের কাছ থেকে এক পলক দূরত্বে বাস করে, যা শুধু পুঁজি দ্বারা তৈরি একটি প্রাচীর দ্বারা পৃথক। এ বিশৃঙ্খল আধুনিকতা কি টেকসই? পরিবেশগত সীমা প্রতিনিয়ত পরীক্ষিত হচ্ছে এবং সামাজিক কাঠামো ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু আপাতত এ গ্রহের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ঢাকা, তার জনগণের একনিষ্ঠ ইচ্ছাশক্তি এবং একে একত্র করে রাখা উন্মত্ত, অগোছালো সংস্কারের মাধ্যমে কাজ করছে। এটি একটি সুন্দর, ভয়ানক, ক্লান্তিকর এবং চৌম্বকীয় বিপর্যয়- গ্লোবাল সাউথের বিশৃঙ্খল যন্ত্রণার একটি নিখুঁত কেস স্টাডি।

লেখক: স্থপতি ও নগরবিদ
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

শহর ভাবনা

কংক্রিটের জঙ্গল আর সিলিকন স্বপ্ন: ঢাকার বিশৃঙ্খল আধুনিকতা

আপডেট সময় : ০৭:৪৪:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫

ড. মাহবুবুর রহমান

ঢাকা বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। মোগল আমলের ঐশ্বর্যবান নগরী তখনো ছিল লন্ডনের পর পরই সেরা। ঢাকা বিশ্বের এমন এক নগরী- যা বারবার রাজধানী হয়েছে। তবে ঔপনিবেশিক আমলে এর পতনের শুরু। জার্মান ভূগোলবিদ ওয়াল্টার ক্রিস্টালার ১৯৩৩ সালে ভূদৃশ্যজুড়ে শহরগুলোর স্থানিক বণ্টন ব্যাখ্যা করার জন্য সেন্ট্রাল প্লেস থিওরি বিশ্লেষণ করেছিলেন। তত্ত্বটি ব্যবহার করে ওয়েন্ডওভার প্রডাকশনস- যা আকর্ষণীয় ব্যাখ্যামূলক ভিডিও তৈরি করে, শহরগুলো কেন আজকের অবস্থানে রয়েছে তার কারণগুলো অনুসন্ধান করে। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে রাজনীতি ও ইতিহাস বাদ দিয়ে একটি শহর নির্মাণের জন্য পৃথিবীর সেরা স্থান হলো ঢাকা। ভৌগোলিকভাবে বলতে গেলে বাংলাদেশের বৃহত্তম শহর এবং রাজধানী ঢাকা ‘মানবসভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু’ হওয়ার সব মানদণ্ড পূরণ করে। প্রকৃতপক্ষে মোগলরা এর অবস্থানগত সুবিধাগুলো দেখেই এ জায়গাকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছিল।

ঢাকা আদর্শভাবে অবস্থিত এবং একটি উন্নত শহর হওয়ার সব উপাদান এর রয়েছে। কিন্তু এটি এখন একটি বিশৃঙ্খল ও অসম্পূর্ণ নগরী বটে। এটি মনোজগতে একটি ঘাত যার বাতাস ভেজা ধুলো এবং ডিজেলের গন্ধে ভারী, যেখানে শব্দকল্প তৈরি হয় হর্নের অবিরাম হাহাকারে; যেখানে নগরচিত্র হচ্ছে রিকশার গায়ে আঁকা এক ক্যালিডোস্কোপ, চকচকে গ্লাস টাওয়ার আর একটি ভয়ংকর পশুর পাকতন্ত্রের মতো তারের জট। ঢাকার রাস্তায় হাঁটলেই মনে হবে শহরটি তার নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছে যা অপরিকল্পিত বিস্তারের খোলস ঝেড়ে একটি আধুনিক মেগাসিটি হয়ে উঠতে মরিয়া সংগ্রাম করছে। ঢাকা নগরীতে এমন একটি ‘বিশৃঙ্খল আধুনিকতা’ দেখা যায়- যেখানে স্বপ্নালি আর সামন্তবাদী, ডিজিটাল এবং ক্ষয়িষ্ণুতা, বিএমডব্লিউ এবং গরুর গাড়ি, একে অন্যের ওপর উপচে পড়ছে। এ বিশৃঙ্খল আধুনিকতা অবকাঠামো, আর্থসামাজিক স্তরবিন্যাস, পরিবেশগত অবক্ষয় এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছে একটি ক্লান্তিকর কিন্তু আনন্দদায়ক শহর। কয়েক দশক ধরে ঢাকার চিত্র ছিল যানজট নামের ধাতু এবং মানবতার এক অবিচল স্তূপ যেখানে ১০ কিলোমিটার রাস্তা সহজেই দিনের ৩ ঘণ্টা গ্রাস করতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে আকাশরেখা বদলাচ্ছে; মেট্রো ও এক্সপ্রেসওয়ে শহরের যানজটকে দুইতলায় ভাগ করে ফেলেছে।

আধা ঘণ্টার কমে উত্তর থেকে কেন্দ্রে চলা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেট্রোর জানালা থেকে ঢাকা দেখতে লাগে সংগঠিত আর শান্ত। উঁচু ভবন, বিলবোর্ড, বাড়িঘরের ছাদ, সবুজ, আর একঝলক ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। মেট্রো হলো আধুনিকতার একটি বিশুদ্ধ, দক্ষ বুদ্বুদ, ডিজিটাল পাস এবং সুশৃঙ্খল কিউ- একটি লোকাল বাসে চড়ার জন্য অবশ্যম্ভাবী ঝগড়ার থেকে হাজার যোজন দূর। তবে এ কংক্রিট ধমনীর নিচে ধরণীর বিশৃঙ্খলা আগের মতোই। দ্রুতগামী লেনগুলোর স্তম্ভগুলো সরু রাস্তাগুলোকে কামড়ে ধরে তৈরি করেছে অন্ধকার, ধুলোময় করিডোর যেখানে রিকশা, সিএনজি এবং ভাঙা বাসগুলো কয়েক ইঞ্চি অ্যাসফলটের জন্য লড়াই করে। এটি উন্নত অবকাঠামোর প্যারাডক্স: ট্রাফিকের সমাধান একটি শ্রেণীকে ওপরে আলাদা করে দিয়েছে। ধনীরা নিজের গাড়িতে টোলওয়ালা এক্সপ্রেসওয়েতে ছুটে চলে, আর মধ্যবিত্তরা চড়ে মেট্রোতে। অন্যদিকে পোশাক শ্রমিক, দিনমজুর এবং ফেরিওয়ালা নিচে লড়াই করে দম ফেলতে। ঢাকার অবকাঠামোর আধুনিকতা একরকম জগাখিচুড়ি। এটি প্রাথমিকভাবে বাধা সৃষ্টিকারী মৌলিক নাগরিক বিপর্যয়গুলোকে উপেক্ষা করে ভাগ্যবানদের চলাচলপ্রবাহের নিশ্চয়তা দেয়। যদিও শহরটি কখনো গাড়ির জন্য বানানো হয়নি, তবুও এটি এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করে। খাল-বিল ব-দ্বীপীয় শহরটি খাল-বিল-নালা ভরাট করে ভূগর্ভস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি করে যা খানিক বৃষ্টিতেই আটকে যায়। প্রকৃতি ও পরিকল্পনার মধ্যে এ বিচ্ছিন্নতাই ঢাকা শহরের বিশৃঙ্খল আধুনিকতার ভিত্তি।

ঢাকার আর্থসামাজিক ভূগোলের চেয়ে এই স্কিজোফ্রেনিয়া আর কোথাও বেশি দেখা যায় না। বনানী লেকের ধারে আছে বৈষম্যের রেখা। একদিকে করপোরেট কাচের ফ্যাসাদ এবং বিলাসবহুল হাইরাইজ আর বহুজাতিক ব্যাংকগুলো চকচক করছে; ছাদের ফিউশন রেস্তোরাঁগুলো নিউইয়র্কসম দাম হাঁকাচ্ছে। আর অ্যাপার্টমেন্টগুলো হাত বদলাচ্ছে ন্যূনতম ৪০ লাখ ডলারে। ঢাকার ‘আধুনিকতা’ যেন ঘষামাজা, কসম্যাটিক আর ভোগ্য—আমদানি করা কফি, এয়ার পিউরিফাইয়ার। আর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীবেষ্টিত একটি প্রাচীরঘেরা নিরাপদ অস্তিত্ব। এর কয়েকশ মিটার দূরেই আছে বিশ্বের বৃহত্তম বস্তি—টিন, বাঁশ এবং সংঘাতসহনীয় এক ঘন, জৈব গোলকধাঁধা। এটি শহরের ইঞ্জিন রুম—আপনার গৃহকর্মী, বিলাসবহুল গাড়ির ড্রাইভার এবং অফিস স্টাফের চড়া রিকশাওয়ালা—নিষ্ঠুর ‘আধুনিকতার’ পাশে সবার সহাবস্থান।

উঁচু ভবনগুলোয় রয়েছে উচ্চগতির ফাইবার ইন্টারনেট ও জেনারেটর ব্যাকআপ, আর বস্তিগুলো নিরন্তর লড়াই করে বেআইনি ও বিপজ্জনক বিদ্যুৎ সংযোগ, স্যানিটেশনের অনুপস্থিতি আর অগ্নিঝুঁকির সঙ্গে। বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও বস্তিগুলোয় একটি অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়া কাজ করে। এগুলো আধুনিক শহর থেকে আলাদা নয়; শহরই একে লালন করে। এ বিশাল সস্তা, অনানুষ্ঠানিক শ্রমের ওপর নির্ভর করেই তো ঢাকার দ্রুত আধুনিক হয়ে ওঠা। ঝামেলা দেখা দেয় তখনই- যখন নগর পরিকল্পনা এ সম্প্রদায়গুলোকে একীভূত করার পরিবর্তে; যা প্রায়ই হয়, ‘দৃষ্টিক্ষত’ হিসেবে বিবেচনা করে। ‘সৌন্দর্যকরণ’ প্রকল্পগুলোয় হকারদের উচ্ছেদ করা হয় এবং চা-সিগারেটের টংগুলোকে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় যাতে পরিষ্কার হাঁটার পথ তৈরি করা যায়। আধুনিকতার আখ্যান থেকে দরিদ্রদের এই বাদ দেয়া নিশ্চিত করে যে শহরটি অস্থির ও শুধু ক্ষমতাবানদের থাকে, চকচকে ও ধবধবে নতুন উন্নয়ন অপরাধ, যা সব কুশ্রী এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতাকে ঢেকে রাখে।

আধুনিকতার দিকে ঢাকার অগ্রযাত্রায় একে মূল্য দিতে হয়েছে অনেক। একে একে সবুজ গেছে হারিয়ে। প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থার অংশ প্রাচ্যের ভেনিসের খাল এবং নদীগুলোকে ভরাট করে রিয়েল এস্টেট তৈরি করা হয়েছে। ফলে ‘হিট আইল্যান্ডের প্রভাবে আশপাশের এলাকা চুল্লিতে পরিণত হয়েছে। পুরান ঢাকার প্রাণভ্রমরা বুড়িগঙ্গা ওই আধুনিকীকরণের বলি-রাসায়নিক কাদার একটি সান্দ্র প্রবাহ; যা অপরিশোধিত বর্জ্যপ্রসূত কালোতে রাঙানো। আধুনিক’ চামড়া শিল্প, যা এখন অনেক উজানে আর কোটি কোটি টাকা আয়কারী, তারা বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি লাখ লাখ মানুষের ব্যবহৃত জলে ফেলে দেয়। ঢাকা বায়ুদূষণেও প্রায়ই বিশ্ব তালিকার শীর্ষে থাকে। শহরকে বাঁচানোর জন্য তৈরি প্রকল্পগুলোর নির্মাণ ধুলো, যানবাহনের নির্গমন, এবং ইটভাটার ধোঁয়া একাকার হয়ে একটি বিষাক্ত ধূসর ধোঁয়াশা তৈরি করে।

ঢাকাবাসী দূষণকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে- যা অন্য দেশে জীবনের জন্য বিপজ্জনক ধরা হয়। মুখোশ পরে জগিং আর বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়া ‘আধুনিক স্বাস্থ্য সচেতনতার’ অযৌক্তিকতারই প্রমাণ। এ পরিবেশগত অবক্ষয় অস্তিত্বগত বিশৃঙ্খলাকে আরেকটি মাত্রা দেয়। শহরটি ক্রমাগত ভেঙে পড়া ভিত্তির ওপর ফুলেফেঁপে উঠছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমে নেমে যাচ্ছে। এ অপরিকল্পিত কংক্রিট জঙ্গলে ভূমিকম্প একটি ভয়াবহ ঝুঁকি যা বেশির ভাগই উপেক্ষা করে, কারণ দৈনন্দিন জীবনের তাৎক্ষণিক সংগ্রামই তাদের অগ্রাধিকার।

ঢাকার একটি ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটছে। ঐতিহ্যগতভাবে দৈনন্দিন জীবন আবর্তিত হতো পাড়া ঘিরে- যা ছিল একটি সমষ্টিগত অস্তিত্ব; যেখানে গোপনীয়তার চেয়ে প্রতিবেশীর নৈকট্য ও সামাজিক সমর্থন ছিল বেশি। চাওয়ালা, মোড়ের ফার্মেসি মালিক ও পাড়ার যে কারো কাজ সম্পর্কে মানুষ জানত। পাড়ানির্ভর সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে অ্যাপার্টমেন্টচালিত আধুনিকতা। টানা বারান্দাসহ একতলা বাড়ির বিস্তৃতির বদলে আমরা পেয়েছি কংক্রিক ধূসর সাইলো। একই দেয়ালের দু’পাশের প্রতিবেশীরা বছরের পর বছর বিচ্ছিন্নভাবে সময় কাটায়। এটি বিশ্বব্যাপী আধুনিক নগর জীবনের একটি সমস্যা এবং সামাজিক আতিথেয়তা ও সাংস্কৃতিক পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষভাবে বিরক্তিকর।

একটি ডিজিটাল সংস্কৃতি ক্রমান্বয়ে আমাদের গ্রাস করছে। ঢাকাবাসীর মধ্যম বয়স ৩০- যারা অনলাইনে থাকে। রাস্তাঘাটের বিশৃঙ্খলা—হয়রানি, যানজট, ধুলো—আমাদেরকে ডিজিটাল জগতে ঠেলে দিয়েছে। ই-কমার্স ও ফুড ডেলিভারি শহরে বিপ্লব এনে দিয়েছে। বিশৃঙ্খল আধুনিকতার স্বরূপ হলো একজন ফুডপান্ডা রাইডার যিনি পুরান ঢাকার উনিশ শতকের একটি গলিতে ঘুরছেন ৫জি স্মার্টফোন ব্যবহার করে ক্লাউড কিচেন থেকে একজন মার্কিন ক্লায়েন্টের জন্য কর্মরত ফ্রিল্যান্সারের কাছে বার্গার পৌঁছে দিতে। এ ডিজিটাল ধারাটি এক নতুন ধরনের অর্থনৈতিক গতিশীলতাও তৈরি করেছে। তরুণদের দ্বারা ‘স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের’ উত্থান হচ্ছে যারা শহরের সমস্যাগুলো হ্যাক করার চেষ্টা করছে, অ্যাপ তৈরি করছে বাস টিকিটিং আর অ্যাম্বুলেন্স খুঁজতে, মুদিখানা থেকে বাজার নিতে। এটি একটি শেকড় থেকে গজানো আধুনিকীকরণ যা ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া উদ্যোগের চেয়ে ভালো কাজ করে।

আমরা পুরান ঢাকার পুনরুত্থান দেখতে পাচ্ছি- যা বিশৃঙ্খল, প্রাণবন্ত আকর্ষণকেই পুঁজি করেছে। তরুণ প্রভাবশালীরা ভোররাতে নাজিরাবাজারে বিরিয়ানির জন্য ভিড় জমায়। পরিকল্পনাকারীরা যে ভিড় ও জঞ্জাল উপেক্ষা করে, তাকে তারা রোমান্টিক করে তোলে। নতুন শহরের ঝকঝক, মলকেন্দ্রিক সংস্কৃতি এবং পুরনো শহরের কাঁচা, সংবেদনশীল-ওভারলোড সংস্কৃতির মধ্যে এক টানাপড়েন চলছে। ঢাকার বিশৃঙ্খল আধুনিকতার সবচেয়ে গভীর প্রকাশ হলো এটি মানুষের মনকে যেভাবে প্রভাবিত করছে। ঢাকায় বসবাসের জন্য অনেক বুদ্ধি খরচ করতে হয়, রাস্তা বাছতে হিসাব করতে হয় কতটা যানজট থাকবে, জলাবদ্ধতা হবে কিনা, মিছিলে আটকে পড়বে কিনা, বাতাসে নিশ্বাস নেয়া যাবে কি? এই অতিসতর্কতা মগজকে ঝুঁকিতে রাখে। ‘

সহিষ্ণু ঢাকাইয়া’ যে যে কোনো কিছু সহ্য করতে পারে তা মানসিক ঘাতের জন্য একটি আবেদনময়ী কিন্তু বিপজ্জনক শব্দ। বিশৃঙ্খল আধুনিকতা মানুষকে অস্বাভাবিকতাকেই স্বাভাবিক ভাবতে বাধ্য করে। যেমন- ৪ ঘণ্টা ট্রাফিকের মধ্যে ব্যয় করা, অধিকার আদায়ের জন্য ঘুস দেয়া, অন্য দেশে অগ্রহণীয় অতি কোলাহল মেনে নেয়া। এই জ্বালাপোড়া-কায়ক্লেশের মধ্যে একটি অনস্বীকার্য শক্তি রয়েছে। ঢাকা একটি ব্যস্ততার শহর; এর বিশৃঙ্খলতা প্রতিভাবানদের জন্য সুযোগ তৈরি করে। আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে ছাতা বা মুখোশ বিক্রি করা ফেরিওয়ালা থেকে বিশ্বব্যাপী ব্যস্ত বায়িং হাউজের নির্বাহী পর্যন্ত, সবাই বেঁচে থাকতে আর এবং উন্নতি করতে একই অবিরাম প্রচেষ্টায় নিয়োজিত।

ওই ‘বিশৃঙ্খল শক্তি’ আসক্তিকর। যারা ঢাকা ছেড়ে উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমাচ্ছেন, তাদের অনেকেই প্রায়ই এ জাদুর শহরের স্পন্দন-ঘূর্ণায়মাণ ঘূর্ণির কেন্দ্রে থাকার অনুভূতি, যেখানে প্রতিদিন কিছু না কিছু ঘটছে, ভুলতে পারেন না। রৈখিক অগ্রগতির পরিবর্তে ঢাকার আধুনিকতা একটি অস্থির বিস্ফোরণ। এটি এমন একটি শহর- যা উনবিংশ শতাব্দী থেকে প্রায়ই বিংশ শতাব্দীর প্রয়োজনীয় ধাপগুলো (যেমন- নীল-সবুজের সমারোহ বা নাগরিক আচরণ) এড়িয়ে একবিংশ শতাব্দীতে ঝাঁপিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।

ঢাকা হয়ে উঠছে একটি চরম প্রান্তিক শহর; যেখানে বিশ্বমানের মেট্রো ট্রেনে চড়ে এমন একটি বাজারে যাওয়া যাবে; যেখানে চোখের সামনেই মুরগি জবাই করে বিক্রি হয় অথবা উবার ডেকে গিয়ে খোলা আকাশের নিচে ফুচকা খাওয়া যাবে। এটি এমন একটি জায়গা- যেখানে ধনী ও দরিদ্রতমরা একে অন্যের কাছ থেকে এক পলক দূরত্বে বাস করে, যা শুধু পুঁজি দ্বারা তৈরি একটি প্রাচীর দ্বারা পৃথক। এ বিশৃঙ্খল আধুনিকতা কি টেকসই? পরিবেশগত সীমা প্রতিনিয়ত পরীক্ষিত হচ্ছে এবং সামাজিক কাঠামো ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু আপাতত এ গ্রহের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ঢাকা, তার জনগণের একনিষ্ঠ ইচ্ছাশক্তি এবং একে একত্র করে রাখা উন্মত্ত, অগোছালো সংস্কারের মাধ্যমে কাজ করছে। এটি একটি সুন্দর, ভয়ানক, ক্লান্তিকর এবং চৌম্বকীয় বিপর্যয়- গ্লোবাল সাউথের বিশৃঙ্খল যন্ত্রণার একটি নিখুঁত কেস স্টাডি।

লেখক: স্থপতি ও নগরবিদ
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ