ঢাকা ০৫:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫

ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্কের নতুন টানাপোড়েন

  • আপডেট সময় : ১০:১৯:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ অগাস্ট ২০২২
  • ৫৭ বার পড়া হয়েছে

অলোক আচার্য : যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে শুরু থেকেই ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয় ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের মধ্যে। এ ঘটনায় গত কয়েক বছরের মধ্যে দুই পরাশক্তির উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। বাণিজ্য যুদ্ধের সময় এবং করোনার উৎসস্থল নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয়। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। পেলোসির সফরের ঠিক আগে তাইওয়ান থেকে চীনা মূল ভূখ-ে বিভক্তকারী সীমারেখায় চীন যুদ্ধবিমান পাঠায়। চীন ওই এলাকায় সামরিক মহড়াও চালিয়েছে। এটা যে চীনের একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না তা জানান দিতেই এত কিছু। আর এভাবেই তাইওয়ান ইস্যুতে চীন বরাবর তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। ২৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনা একটি নথিতে প্রথমবারের মতো দ্বিপটির নাম দেখা যায়। সেই সময় একজন সম্রাট এই অঞ্চল আবিষ্কারের জন্য অভিযাত্রী বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। আর এই নথিকে বেইজিং তার আঞ্চলিক দাবির সমর্থনে ব্যবহার করে। ১৬২৪ সাল থেকে ১৬৬১ সাল পর্যন্ত উপনিবেশ হিসেবে সংক্ষিপ্ত ডাচ শাসনের অধীনে ছিল তাইওয়ান। এরপর ১৬৮৩ থেকে ১৮৯৫ পর্যন্ত চীনের কিং রাজবংশ শাসন করে ওই অঞ্চল। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার প্রশাসনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়তে থাকে তাইওয়ানের। গত এপ্রিলে আমেরিকান পার্লামেন্টের ছয় সদস্য তাইওয়ান সফর করে। এরপর হলো পেলোসির সফর। যদিও এ জন্য ওয়াশিংটনকে পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে চীন। কিন্তু হুমকি উপেক্ষা করেই মঙ্গলবার তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে পৌঁছেন তিনি।
২৫ বছরের মধ্যে প্রথম কোনো মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তার তাইওয়ান সফর এটি। এ সফর ঘিরে চীনের উত্তেজনার কারণ হলো চীনের কাছে তাইওয়ান কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয় বরং একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল। অপর দিকে তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই দেখে দেশটির জনগণ। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন তাইওয়ানকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। সুতরাং দুই দেশের সম্পর্ক ভবিষ্যতে কতটা নমনীয় হবে ভাবার বিষয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর নানা কারণে বিশ্বের উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি এমন এক সময় যখন উন্নত দেশ থেকে শুরু করে প্রায় সব দেশই অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা পার করছে। এক ইউক্রেন সমস্যা সামাল দিতেই বিশ্ব নেতৃত্ব হিমশিম খাচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত কার্যত কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না, সেখানে আরেকটি নতুন উত্তেজনা বিশ্বকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এক চীন নীতি’ মেনে ওয়াশিংটন এত কাল তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক দূরত্ব বজায় রেখে এসেছে। কিন্তু এ সফর দুই দেশের উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে যা ভবিষ্যৎ সমীকরণের জন্য বেশ কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও দুই দেশের বিপরীত অবস্থান নতুন কিছু নয়। করোনার উৎপত্তিস্থল থেকে শুরু করে এবং তার আগে থেকে চলা বাণিজ্য যুদ্ধ ও সেইসঙ্গে বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের কৌশল- সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে চীন। সুতরাং উভয় দেশের মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতা। বিশ্ব কোনোভাবেই এই প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সেই সদিচ্ছাও আছে বলে মনে হয় না। আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বিশ্বকে বহুবার পুড়তে হয়েছে। অথচ করোনা মহামারীর সময় বিশ্বের একত্রিত হওয়া খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, আধিপত্য বিস্তারের কৌশল, জোট পরিকল্পনা প্রভৃতি সব কিছুই সমানতালে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দ্সুই দেশের উত্তেজনা তীব্র হচ্ছে। এই চলমান দ্বন্দ্বকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে এবং সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই পরাশক্তি। রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার কঠিন সম্পর্ক পৃথিবীকে দুটি বলয়ে ভাগ করেছে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে সবসময় উত্তেজনা বিরাজ করে। আর কে না জানে- ক্ষমতার প্রশ্নে বা প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে আপোস করা প্রায় সময়ই কঠিন। দুই দেশের এই টানাপোড়েন শীতলযুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে বলেও অনেকে মত দিয়েছেন। শীতল যুদ্ধ বা স্নায়ুযুদ্ধ সম্পর্কে পৃথিবী জ্ঞাত। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার স্নায়ুযুদ্ধের কথা আজও স্মরণে আছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই দেশই ছিল সেসময় দুই পরাশক্তি। গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র মতবাদে বিভক্ত দুই পরাশক্তির এই স্নায়ুযুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ৮০’র দশক পর্যন্ত। আজ যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে যে বিভেদ সেখানেও দুই পরাশক্তির মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে বলা যায়। বাণিজ্য বিরোধ ছিল বিরোধের শুরু। এরপর মতভেদ বাড়তে থাকে। বিশ্ব নেতৃত্বে কে থাকবে বা আগামী শতাব্দীর নেতৃত্ব কে দেবে তার জন্য যেন প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ্ব। যদিও বিশ্ব এখন একক কর্তৃত্ব করার সুযোগ হারিয়েছে। এখন বিশ্ব জোটের অন্তর্গত থাকতে পছন্দ করে। সম মতবাদে বিশ্ববাসী দেশগুলো জোট গড়ে তোলে। যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনকে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। পৃথিবীজুড়ে বহু বছর ধরে আধিপত্য বিস্তার করে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটাই এত দিনের দৃশ্যত চিত্র। বলাবাহুল্য, এ ক্ষেত্রে মার্কিন প্রযুক্তি, শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তি এবং দক্ষ রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে প্রভাব বিস্তারের প্রধান নিয়ামক যে ক্ষমতা তা আজ না বোঝালেও চলবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এসব দেশ নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে মরিয়া। এই আধিপত্য ধরে রাখার প্রতিযোগিতা আজ থেকে শুরু হয়নি।
প্রথম শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বিভিন্ন দেশ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলে। সেইসঙ্গে প্রযুক্তির বিকাশ সাধনের ফলে নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে তারা। সেই সময়ে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলো তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে ছিল। প্রথম দিকে এসব খুব বেশি প্রভাব বিস্তার না করলেও ধীরে ধীরে শক্তিমত্তার বিস্তার ঘটতে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নিত্য নতুন অস্ত্র আবিষ্কারের শুরু সেই তখন থেকেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের। এখন রাশিয়া ও চীন এ ক্ষেত্রে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। গত কয়েক বছরে চীন তাই পরাশক্তির কাতারে। ফলশ্রুতিতে কৌশল হিসেবে মিত্রদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নিজ বলয়ের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে চীনের আধিপত্যও ছড়িয়ে পড়ছে। পৃথিবীব্যাপী পণ্যের বিশাল বাজার যা চীনের অর্থনীতিকে ক্রমেই শক্তিশালী করছে, রাশিয়ার সঙ্গেও দেশটির ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে নিয়ে মাথা ঘামাতে বাধ্য হচ্ছে। এই চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেই পেলোসির সফর দুই দেশের সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় তাই এখন দেখার বিষয়।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ড. ইউনূসকে ডি-লিট ডিগ্রি দিলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্কের নতুন টানাপোড়েন

আপডেট সময় : ১০:১৯:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ অগাস্ট ২০২২

অলোক আচার্য : যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে শুরু থেকেই ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয় ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের মধ্যে। এ ঘটনায় গত কয়েক বছরের মধ্যে দুই পরাশক্তির উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। বাণিজ্য যুদ্ধের সময় এবং করোনার উৎসস্থল নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয়। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। পেলোসির সফরের ঠিক আগে তাইওয়ান থেকে চীনা মূল ভূখ-ে বিভক্তকারী সীমারেখায় চীন যুদ্ধবিমান পাঠায়। চীন ওই এলাকায় সামরিক মহড়াও চালিয়েছে। এটা যে চীনের একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না তা জানান দিতেই এত কিছু। আর এভাবেই তাইওয়ান ইস্যুতে চীন বরাবর তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। ২৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনা একটি নথিতে প্রথমবারের মতো দ্বিপটির নাম দেখা যায়। সেই সময় একজন সম্রাট এই অঞ্চল আবিষ্কারের জন্য অভিযাত্রী বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। আর এই নথিকে বেইজিং তার আঞ্চলিক দাবির সমর্থনে ব্যবহার করে। ১৬২৪ সাল থেকে ১৬৬১ সাল পর্যন্ত উপনিবেশ হিসেবে সংক্ষিপ্ত ডাচ শাসনের অধীনে ছিল তাইওয়ান। এরপর ১৬৮৩ থেকে ১৮৯৫ পর্যন্ত চীনের কিং রাজবংশ শাসন করে ওই অঞ্চল। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার প্রশাসনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়তে থাকে তাইওয়ানের। গত এপ্রিলে আমেরিকান পার্লামেন্টের ছয় সদস্য তাইওয়ান সফর করে। এরপর হলো পেলোসির সফর। যদিও এ জন্য ওয়াশিংটনকে পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে চীন। কিন্তু হুমকি উপেক্ষা করেই মঙ্গলবার তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে পৌঁছেন তিনি।
২৫ বছরের মধ্যে প্রথম কোনো মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তার তাইওয়ান সফর এটি। এ সফর ঘিরে চীনের উত্তেজনার কারণ হলো চীনের কাছে তাইওয়ান কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয় বরং একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল। অপর দিকে তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই দেখে দেশটির জনগণ। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন তাইওয়ানকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। সুতরাং দুই দেশের সম্পর্ক ভবিষ্যতে কতটা নমনীয় হবে ভাবার বিষয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর নানা কারণে বিশ্বের উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি এমন এক সময় যখন উন্নত দেশ থেকে শুরু করে প্রায় সব দেশই অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা পার করছে। এক ইউক্রেন সমস্যা সামাল দিতেই বিশ্ব নেতৃত্ব হিমশিম খাচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত কার্যত কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না, সেখানে আরেকটি নতুন উত্তেজনা বিশ্বকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এক চীন নীতি’ মেনে ওয়াশিংটন এত কাল তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক দূরত্ব বজায় রেখে এসেছে। কিন্তু এ সফর দুই দেশের উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে যা ভবিষ্যৎ সমীকরণের জন্য বেশ কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও দুই দেশের বিপরীত অবস্থান নতুন কিছু নয়। করোনার উৎপত্তিস্থল থেকে শুরু করে এবং তার আগে থেকে চলা বাণিজ্য যুদ্ধ ও সেইসঙ্গে বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের কৌশল- সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে চীন। সুতরাং উভয় দেশের মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতা। বিশ্ব কোনোভাবেই এই প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সেই সদিচ্ছাও আছে বলে মনে হয় না। আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বিশ্বকে বহুবার পুড়তে হয়েছে। অথচ করোনা মহামারীর সময় বিশ্বের একত্রিত হওয়া খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, আধিপত্য বিস্তারের কৌশল, জোট পরিকল্পনা প্রভৃতি সব কিছুই সমানতালে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দ্সুই দেশের উত্তেজনা তীব্র হচ্ছে। এই চলমান দ্বন্দ্বকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে এবং সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই পরাশক্তি। রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার কঠিন সম্পর্ক পৃথিবীকে দুটি বলয়ে ভাগ করেছে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে সবসময় উত্তেজনা বিরাজ করে। আর কে না জানে- ক্ষমতার প্রশ্নে বা প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে আপোস করা প্রায় সময়ই কঠিন। দুই দেশের এই টানাপোড়েন শীতলযুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে বলেও অনেকে মত দিয়েছেন। শীতল যুদ্ধ বা স্নায়ুযুদ্ধ সম্পর্কে পৃথিবী জ্ঞাত। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার স্নায়ুযুদ্ধের কথা আজও স্মরণে আছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই দেশই ছিল সেসময় দুই পরাশক্তি। গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র মতবাদে বিভক্ত দুই পরাশক্তির এই স্নায়ুযুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ৮০’র দশক পর্যন্ত। আজ যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে যে বিভেদ সেখানেও দুই পরাশক্তির মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে বলা যায়। বাণিজ্য বিরোধ ছিল বিরোধের শুরু। এরপর মতভেদ বাড়তে থাকে। বিশ্ব নেতৃত্বে কে থাকবে বা আগামী শতাব্দীর নেতৃত্ব কে দেবে তার জন্য যেন প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ্ব। যদিও বিশ্ব এখন একক কর্তৃত্ব করার সুযোগ হারিয়েছে। এখন বিশ্ব জোটের অন্তর্গত থাকতে পছন্দ করে। সম মতবাদে বিশ্ববাসী দেশগুলো জোট গড়ে তোলে। যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনকে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। পৃথিবীজুড়ে বহু বছর ধরে আধিপত্য বিস্তার করে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটাই এত দিনের দৃশ্যত চিত্র। বলাবাহুল্য, এ ক্ষেত্রে মার্কিন প্রযুক্তি, শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তি এবং দক্ষ রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে প্রভাব বিস্তারের প্রধান নিয়ামক যে ক্ষমতা তা আজ না বোঝালেও চলবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এসব দেশ নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে মরিয়া। এই আধিপত্য ধরে রাখার প্রতিযোগিতা আজ থেকে শুরু হয়নি।
প্রথম শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বিভিন্ন দেশ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলে। সেইসঙ্গে প্রযুক্তির বিকাশ সাধনের ফলে নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে তারা। সেই সময়ে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলো তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে ছিল। প্রথম দিকে এসব খুব বেশি প্রভাব বিস্তার না করলেও ধীরে ধীরে শক্তিমত্তার বিস্তার ঘটতে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নিত্য নতুন অস্ত্র আবিষ্কারের শুরু সেই তখন থেকেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের। এখন রাশিয়া ও চীন এ ক্ষেত্রে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। গত কয়েক বছরে চীন তাই পরাশক্তির কাতারে। ফলশ্রুতিতে কৌশল হিসেবে মিত্রদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নিজ বলয়ের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে চীনের আধিপত্যও ছড়িয়ে পড়ছে। পৃথিবীব্যাপী পণ্যের বিশাল বাজার যা চীনের অর্থনীতিকে ক্রমেই শক্তিশালী করছে, রাশিয়ার সঙ্গেও দেশটির ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে নিয়ে মাথা ঘামাতে বাধ্য হচ্ছে। এই চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেই পেলোসির সফর দুই দেশের সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় তাই এখন দেখার বিষয়।