নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনা তদন্তে এখন পর্যন্ত বিশেষ অগ্রগতি হয়েছে। প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুলের বাসাসহ অন্তত পাঁচটি জায়গা শনাক্ত করা হয়েছে। তবে সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি।
শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের এক কর্মকর্তা এসব তথ্য জানিয়েছেন। সন্দেহভাজন ফয়সাল দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন- এমন তথ্য নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ফয়সাল পালাতে পারেননি। বিভিন্ন স্থানে অভিযান ও খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে।’
আততায়ীকে ধরিয়ে দিতে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা
এই কর্মকর্তা আরো জানান, ফয়সাল একাধিক মোবাইল ফোন ও নম্বর ব্যবহার এবং বারবার নম্বর পরিবর্তন করেছেন। এসব তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালানো হলেও এখনো তার নিশ্চিত কোনো অবস্থান পাওয়া যায়নি। আজ (শনিবার) নতুন কোনো তথ্য মেলেনি।
তদন্তে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করছে। র্যাব, ডিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ও সমন্বয় রয়েছে।’
এদিকে, এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। তিনি শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, গুলিবিদ্ধ হাদির পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি চলছে। মামলায় মোটরসাইকেল চালক ও তার পেছনে বসে যিনি গুলি করেছে তাদের আসামি করা হবে। জানতে চাইলে ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, ভুক্তভোগীর পরিবার বাদী হয়ে মামলা করবে। তবে তারা হাসপাতালে রয়েছেন, যার কারণে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।
অন্যদিকে, হাদির ওপর হামলাকারীকে ধরিয়ে দিতে পারলে তার জন্য সরকার ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
হাদির অবস্থা এখনো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক: মেডিকেল বোর্ড: দুর্বৃত্তের গুলিতে মারাত্মক আহত ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি বর্তমানে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে ভর্তি। তার শারীরিক অবস্থা এখনো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। মস্তিষ্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ফুসফুসে ইনজুরি বিদ্যমান। তবে তার কিডনির কার্যক্ষমতা বর্তমানে ফিরে এসেছে।
শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) এসব তথ্য জানায় ওসমান হাদির চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড। বিবৃতিতে মেডিকেল বোর্ডের ১২ সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বিবৃতিতে মেডিকেল বোর্ড জানিয়েছে-

১. রোগীর মস্তিষ্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেহেতু সার্জিক্যাল হস্তক্ষেপ সম্পন্ন হয়েছে, তাই বর্তমানে তাকে কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্টে রাখা হয়েছে। ব্রেন প্রোটেকশন প্রটোকল অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় সব সাপোর্ট চালু থাকবে। শারীরিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হলে পুনরায় ব্রেনের সিটি স্ক্যান করা হতে পারে।
২. ফুসফুসে ইনজুরি বিদ্যমান রয়েছে। চেস্ট ড্রেইন টিউব দিয়ে অল্প পরিমাণ রক্ত নির্গত হওয়ায় তা আপাতত চালু রাখা হয়েছে। ফুসফুসে সংক্রমণ ও এআরডিএস (অজউঝ) প্রতিরোধের বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট অব্যাহত রাখা হবে।
৩. কিডনির কার্যক্ষমতা বর্তমানে ফিরে এসেছে। এটি বজায় রাখার জন্য পূর্বনির্ধারিত ফ্লুইড ব্যালেন্স যথাযথভাবে চালিয়ে যাওয়া হবে।
৪. পূর্বে শরীরে রক্ত জমাট বাঁধা ও রক্তক্ষরণের মধ্যকার অসামঞ্জস্যতা (উওঈ) দেখা দিলেও বর্তমানে তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ অবস্থা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী রক্ত ও রক্তজাত উপাদান সঞ্চালন অব্যাহত থাকবে।
৫. ব্রেন স্টেম ইনজুরির কারণে রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দন ওঠানামা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে যে সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে তা চলমান থাকবে। হৃৎস্পন্দন বিপজ্জনকভাবে কমে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে টেম্পোরারি পেসমেকার স্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট টিম সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে।
৬. ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, রেডিওলজি, আইসিইউ, অ্যানেস্থেশিয়া, নিউরোসার্জারি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক ও সাপোর্টিভ স্টাফদের অসাধারণ ও মানবিক অবদানের জন্য এই মেডিকেল বোর্ড তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।
৭. বর্তমানে রোগীর সার্বিক অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।
৮. এই মেডিকেল সামারি রোগীর ভাই ও নিকটাত্মীয়দের বিস্তারিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। তারা চাইলে গণমাধ্যমের মাধ্যমে দেশবাসীকে এ বিষয়ে অবহিত করতে পারেন। মেডিকেল টিমের পক্ষ থেকে সবার প্রিয় শরিফ মো. ওসমান হাদীর জন্য বিনীতভাবে দোয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
৯. অপ্রয়োজনে কেউ হাসপাতালে এসে ভিড় করবেন না। কোনো ধরনের ভিজিটর অনুমোদিত নয়।
১০. কোনো ধরনের অনুমানভিত্তিক বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার না করে মেডিকেল বোর্ডের প্রতি আস্থা রাখার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে। রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হলো।
১১. আমাদের মেডিকেল টিম সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব, সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তার চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। রোগীর দ্রুত আরোগ্যের জন্য মেডিকেল বোর্ড ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে সবার কাছে দোয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ রইলো।
হাদির গ্রামের বাড়িতে চুরি: ঢাকায় গুলিবিদ্ধ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির গ্রামের বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটেছে। গতকাল শুক্রবার রাতে ঝালকাঠির নলছিটিতে শহরের খাসমহল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় তাদের পরিবারের কোনো সদস্য বাড়িতে ছিলেন না। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নলছিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুল আলম।
ওসমান হাদির প্রতিবেশী গোলাম কিবরিয়া বলেন, ভোররাতে নামাজের জন্য বের হলে হাদির বাড়ির পেছনে দুজনকে দেখতে পান তিনি। সন্দেহ হলে দাঁড়াতে বললে তারা দৌড়ে পালিয়ে যায়। শনিবার সকালে বাসা দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা আরেক প্রতিবেশী জান্নাতি আক্তার বলেন, তিনি সকালে বাসার সামনে একটি গামছায় মোড়ানো টাকা পরিত্যক্ত অবস্থায় পান। বিষয়টি ওসমান হাদির বড় বোন ফাতেমা বেগমকে তিনি জানান। খবর পেয়ে তাঁর বড় বোন এসে বাসায় ঢুকে দেখতে পান, ঘরের আলমারি ভাঙা। আলমারিতে থাকা নগদ টাকা চোর নিয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
ওসমান হাদির চাচাতো ভাই সিরাজুল ইসলাম বলেন, কেউ না থাকার সুযোগে জানালা ভেঙে চোর ঘরে ঢুকে। কী পরিমাণ মালামাল চুরি হয়েছে, সেটা তাঁরা জানতে পারেননি।
নলছিটি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুল আলম বলেন, চুরির খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেছে। এখনো প্রাথমিক তদন্ত চলমান আছে। পুলিশ পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছে। এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন আছে।
সীমান্তে কড়া নজরদারি: রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদীকে গুলি করার ঘটনার পর সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এই ঘটনায় জড়িত পলাতক আসামিরা যেন বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে, সে লক্ষ্যেই বেনাপোল সীমান্তে ব্যাপক নজরদারি ও তল্লাশি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
বেনাপোল আইসিপি, আমড়াখালি, সাদীপুর, রঘুনাথপুর, ঘিবা, শিকারপুর, শালকোনা, কাশিপুর, মাসিলা, আন্দুলিয়া ও পাঁচপীরতলা এলাকাসহ সীমান্তসংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) সকাল থেকেই এসব এলাকায় যানবাহন ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশি অব্যাহত রয়েছে।
গত শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুর ২ টা ২০ মিনিটে রাজধানীর বিজয়নগর কালভার্ট এলাকায় হাদিকে গুলি করে আহত করেন অস্ত্রধারীরা। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে জরুরি বিভাগে চিকিৎসার পর রাতে তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
সানা/আপ্র/১৩/১২/২০২৫

























