ঢাকা ০৬:০৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ওয়াসার ‘নিয়ম ভাঙার সুবিধায়’ বদলে গেল বস্তিবাসীদের জীবন

  • আপডেট সময় : ১২:৫৮:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
  • ১৯০ বার পড়া হয়েছে

মহানগর প্রতিবেদন: ঢাকায় যাদের জমি বা ভবনের মালিকানা নেই, নিয়ম অনুযায়ী তাদের বৈধ পানির সংযোগ দিতে পারে না ওয়াসা। এ নিয়মের কারণে সুপেয় পানির অভাবে নানা রকম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছিল ঢাকার বস্তিবাসীদের। তবে এ নিয়ম পাশ কাটিয়ে বস্তিগুলোতে পানির সংযোগ দেওয়ার পর বদলে গেছে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান।
ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, বৈধ উপায়ে সংযোগ দেওয়ার সুযোগ না থাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা সিন্ডিকেট করে ওয়াসার পানি চুরি করে অনেক দামে বিক্রি করছিল। এ সমস্যা সমাধানে লো ইনকাম কমিউনিটি (এলআইসি) নামে শাখা খুলে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় ২০১৩ সাল থেকে বস্তিগুলোতে পানি সরবরাহ শুরু করে ওয়াসা। এখন পর্যন্ত এ শাখার অধীনে ৯ হাজারের বেশি সংযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি সংযোগ থেকে ছয় থেকে আটটি পরিবার পানি পায়।
ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার রায় জানান, স্বল্প আয়ের এই মানুষের রাজধানীর যেসব এলাকায় থাকছেন, সেসব জায়গার মালিক সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। তাদের যায়গায় তো আমরা পানির লাইন দিতে পারি না। এ কারণে আমরা ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটারি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) সঙ্গে একটা চ্যানেল করে প্রথমে তাদের পানি দেওয়ার চেষ্টা করি।
বস্তিতে পানি সরবরাহ করার প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে উত্তম কুমার জানান, তখন আমরা এনজিওগুলোর সহযোগিতা নিলাম, ইউনিসেফ অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিল। প্রথমে সরাসরি সংযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। পরে দেখলাম এই পদ্ধতি ফিট না। পরে কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশন দাঁড় করিয়ে তাদের নেতৃত্বে সংযোগ দিলাম। তারা নেতৃত্ব দেয় এবং পাশাপাশি এনজিওর লোক আছে, তারা কাজ করে। আর আমরা সরকারের পক্ষে সাপোর্ট দেই। যার ফলে জিও-এনজিও-সিবিও মডেলের মাধ্যমে মূলত চলছে।
সরেজমিনে রাজধানীর কড়াইল বস্তি ঘুরে দেখা গেছে, বস্তির বিভিন্ন ব্লকে ক্লাস্টারভিত্তিক পনির সংযোগ দেওয়া হয়েছে যেখানে প্রতিটি সংযোগ থেকে ছয় থেকে আটটি পরিবার পানি নিতে পারে। এতে করে পানির জন্য দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়ানো বা কোনো প্রকার ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে না তাদের।
বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে মহল্লার মাস্তানেরা চোরাই লাইনের পানি এনে বিক্রি করতো। তখন প্রতি কলসি পানি পাঁচ টাকা করে কিনতে হতো। সেখানে পানি কেনার জন্যও বিশাল লাইন পড়ে যেতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় যেতো সেখানে। ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে মায়েরা নানান বিপদে পড়তে হতো। এই পানির জন্য যৌন হয়রানির মতো ঘটনাও ঘটেছে।
কড়াইল বস্তির বউ বাজারসংলগ্ন ক-ব্লকের বাসিন্দা মৌসুমি আক্তার বলেন, পানির জন্য একসময় প্রতিদিন মারামারি করা লাগতো। কলসে করে পানি এনে ড্রামে জমাতে হতো। এমনও সময় ছিল পানির জন্য রান্না, বাথরুমে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেত। এখন আমার ঘরের সামনেই পানির লাইন। তখনকার জীবন আর এখনকার জীবন একদম আলাদা মনে হয়।
সিবিও নেতা এবং বস্তিতে কাজ করা এনজিওগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুপেয় পানির সংযোগ আসার পর থেকে বস্তি এলাকায় নানাবিধ রোগ বালাই কমে আসতে শুরু করলো। এক সময় দূষিত পানির কারণে বস্তির রোগী দিয়ে কলেরা হাসপাতাল ভরে যেতো। বস্তির খোলা যায়গায় বেড দিয়েও চিকিৎসা করতে হয়েছে। পচা পানি, ময়লা পানি, লাইন লিকেজ করে ময়লা পানি দেওয়ার কারণে এসব পানি থেকে সংক্রমণ দেখা দিত। বেসরকারি সংস্থা দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের (ডিএসকে) পরিচালক (ওয়াশ) মো. আবদুল হাকিম বলেন, এসব বসতির লোকেরা যখন বৈধ পানি পেল তাদের পানিবাহিত রোগ কমে গেলো। তারপরে এসব ফ্যামিলির ইনকাম বেড়ে গেলো। খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো যেই নারী এখানে কয়েক ঘণ্টা কলস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, তিনি ঘরের কাছে পানি পাওয়ার কারণে এই সময়ে কোনো একটা বাসায় কাজ করতে পারছেন। গার্মেন্টসে কাজ করতে পারছেন। বসতির অনেক ছেলেমেয়ে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এগুলোর সবকিছুর পেছনে কিন্তু এই পানির লাইনের ভূমিকা আছে।
পানির সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) এ কে এম শহীদ উদ্দিন জানান, বস্তি এলাকায় আমরা পানির সংযোগ দেওয়ার কয়েক বছর পর কয়েকটা এনজিও আসছে তারা গ্যাস দিতে চায়, বিদ্যুৎ দিতে চায়। তারা বলছে ওয়াসা যেভাবে পানি দিচ্ছে কীভাবে সম্ভব। এটাতো বেআইনি। আবার তারা ঠিকভাবে বিলও পাচ্ছে, টাকা আদায় হচ্ছে, বকেয়া পড়ছে না। এই একই মডেলে বসতির লোকজন এখন বিদ্যুৎও পেয়েছে, গ্যাসও পেয়েছে। এর ফলে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে ব্যাপক আকারে।

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

সমুদ্রের জীবন্ত ইতিহাস ভ্যাকিটা এখন কঠিন সংকটে

ওয়াসার ‘নিয়ম ভাঙার সুবিধায়’ বদলে গেল বস্তিবাসীদের জীবন

আপডেট সময় : ১২:৫৮:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

মহানগর প্রতিবেদন: ঢাকায় যাদের জমি বা ভবনের মালিকানা নেই, নিয়ম অনুযায়ী তাদের বৈধ পানির সংযোগ দিতে পারে না ওয়াসা। এ নিয়মের কারণে সুপেয় পানির অভাবে নানা রকম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছিল ঢাকার বস্তিবাসীদের। তবে এ নিয়ম পাশ কাটিয়ে বস্তিগুলোতে পানির সংযোগ দেওয়ার পর বদলে গেছে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান।
ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, বৈধ উপায়ে সংযোগ দেওয়ার সুযোগ না থাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা সিন্ডিকেট করে ওয়াসার পানি চুরি করে অনেক দামে বিক্রি করছিল। এ সমস্যা সমাধানে লো ইনকাম কমিউনিটি (এলআইসি) নামে শাখা খুলে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় ২০১৩ সাল থেকে বস্তিগুলোতে পানি সরবরাহ শুরু করে ওয়াসা। এখন পর্যন্ত এ শাখার অধীনে ৯ হাজারের বেশি সংযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি সংযোগ থেকে ছয় থেকে আটটি পরিবার পানি পায়।
ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার রায় জানান, স্বল্প আয়ের এই মানুষের রাজধানীর যেসব এলাকায় থাকছেন, সেসব জায়গার মালিক সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। তাদের যায়গায় তো আমরা পানির লাইন দিতে পারি না। এ কারণে আমরা ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটারি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) সঙ্গে একটা চ্যানেল করে প্রথমে তাদের পানি দেওয়ার চেষ্টা করি।
বস্তিতে পানি সরবরাহ করার প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে উত্তম কুমার জানান, তখন আমরা এনজিওগুলোর সহযোগিতা নিলাম, ইউনিসেফ অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিল। প্রথমে সরাসরি সংযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। পরে দেখলাম এই পদ্ধতি ফিট না। পরে কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশন দাঁড় করিয়ে তাদের নেতৃত্বে সংযোগ দিলাম। তারা নেতৃত্ব দেয় এবং পাশাপাশি এনজিওর লোক আছে, তারা কাজ করে। আর আমরা সরকারের পক্ষে সাপোর্ট দেই। যার ফলে জিও-এনজিও-সিবিও মডেলের মাধ্যমে মূলত চলছে।
সরেজমিনে রাজধানীর কড়াইল বস্তি ঘুরে দেখা গেছে, বস্তির বিভিন্ন ব্লকে ক্লাস্টারভিত্তিক পনির সংযোগ দেওয়া হয়েছে যেখানে প্রতিটি সংযোগ থেকে ছয় থেকে আটটি পরিবার পানি নিতে পারে। এতে করে পানির জন্য দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়ানো বা কোনো প্রকার ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে না তাদের।
বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে মহল্লার মাস্তানেরা চোরাই লাইনের পানি এনে বিক্রি করতো। তখন প্রতি কলসি পানি পাঁচ টাকা করে কিনতে হতো। সেখানে পানি কেনার জন্যও বিশাল লাইন পড়ে যেতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় যেতো সেখানে। ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে মায়েরা নানান বিপদে পড়তে হতো। এই পানির জন্য যৌন হয়রানির মতো ঘটনাও ঘটেছে।
কড়াইল বস্তির বউ বাজারসংলগ্ন ক-ব্লকের বাসিন্দা মৌসুমি আক্তার বলেন, পানির জন্য একসময় প্রতিদিন মারামারি করা লাগতো। কলসে করে পানি এনে ড্রামে জমাতে হতো। এমনও সময় ছিল পানির জন্য রান্না, বাথরুমে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেত। এখন আমার ঘরের সামনেই পানির লাইন। তখনকার জীবন আর এখনকার জীবন একদম আলাদা মনে হয়।
সিবিও নেতা এবং বস্তিতে কাজ করা এনজিওগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুপেয় পানির সংযোগ আসার পর থেকে বস্তি এলাকায় নানাবিধ রোগ বালাই কমে আসতে শুরু করলো। এক সময় দূষিত পানির কারণে বস্তির রোগী দিয়ে কলেরা হাসপাতাল ভরে যেতো। বস্তির খোলা যায়গায় বেড দিয়েও চিকিৎসা করতে হয়েছে। পচা পানি, ময়লা পানি, লাইন লিকেজ করে ময়লা পানি দেওয়ার কারণে এসব পানি থেকে সংক্রমণ দেখা দিত। বেসরকারি সংস্থা দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের (ডিএসকে) পরিচালক (ওয়াশ) মো. আবদুল হাকিম বলেন, এসব বসতির লোকেরা যখন বৈধ পানি পেল তাদের পানিবাহিত রোগ কমে গেলো। তারপরে এসব ফ্যামিলির ইনকাম বেড়ে গেলো। খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো যেই নারী এখানে কয়েক ঘণ্টা কলস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, তিনি ঘরের কাছে পানি পাওয়ার কারণে এই সময়ে কোনো একটা বাসায় কাজ করতে পারছেন। গার্মেন্টসে কাজ করতে পারছেন। বসতির অনেক ছেলেমেয়ে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এগুলোর সবকিছুর পেছনে কিন্তু এই পানির লাইনের ভূমিকা আছে।
পানির সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) এ কে এম শহীদ উদ্দিন জানান, বস্তি এলাকায় আমরা পানির সংযোগ দেওয়ার কয়েক বছর পর কয়েকটা এনজিও আসছে তারা গ্যাস দিতে চায়, বিদ্যুৎ দিতে চায়। তারা বলছে ওয়াসা যেভাবে পানি দিচ্ছে কীভাবে সম্ভব। এটাতো বেআইনি। আবার তারা ঠিকভাবে বিলও পাচ্ছে, টাকা আদায় হচ্ছে, বকেয়া পড়ছে না। এই একই মডেলে বসতির লোকজন এখন বিদ্যুৎও পেয়েছে, গ্যাসও পেয়েছে। এর ফলে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে ব্যাপক আকারে।