ঢাকা ০৪:৪৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫

ওএমএসের লাইনে মধ্যবিত্ত

  • আপডেট সময় : ০২:১৬:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
  • ৭৩ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ। আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়ায় জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় কিছুটা কম দামে খোলা বাজারের (ওএমএস) পণ্য পেতে নিরুপায় হয়ে নি¤œবিত্তদের সঙ্গে অনেক মধ্যবিত্তও লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে এ লাইন। নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে ক্রেতা বেশি হওয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে পণ্য পাচ্ছেন না। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকায় ওএমএসের ট্রাকের লাইনে দাঁড়ানো বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া যায়। তারা জানান, খাদ্যপণ্য কিনতে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে নিয়মিত বাজার থেকে কিনে সংসার চালানো সম্ভব না। তাই কম দামে পণ্য পাওয়ার আশায় ওএমএসের ট্রাকের সামনে লাইন ধরতে হয়। তবে ওএমএসের দীর্ঘ লাইনে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন বয়স্করা। ষাটোর্ধ্ব সুফিয়া বানু বলেন, ‘জামাই নাই- কে নিব, বয়স হইয়া গেছে ৬০। মাজায় ব্যথা, হার্টের রোগী। ঠেলাঠেলির মধ্যে ঢুকতে পারি না, বইসা থাকি, ভিড় কমলে যদি কিছু থাকে নিমু।’ তিনি জানান, ঘরে দুই মেয়ে আর এক ছেলে আছে। ছেলেটা ছোট, স্কুলে যায়, কাজে লাগেনি এখনও। স্বামী গত হয়েছেন আগেই। তাই খাদ্যপণ্য কিনতে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ঝক্কি পোহানোর মত শরীরের অবস্থা নেই। সাহাদুল হক নামে একজন বলেন, ‘সপ্তাহে দুইদিন এখানে চাল নিতে আসি। আমার শ্বাসের ব্যারাম, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াইলে মাথা ঘুরায়, এইজন্য এখানে এসে বসছি।’ শেওড়াপাড়ায় ওএমএসের ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ফাহিম খান। বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের একসময়ের এই শিক্ষক সেখানে দাঁড়িয়েছেন সকাল পৌনে ৯টায়, বেলা ১১টার সময়ও তিনি ট্রাক ছুঁতে পারেননি। অসহায় কণ্ঠে ফাহিম খান বললেন, ‘আমার ফ্যামিলিতে ১৫ জন মানুষ। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে আমার পক্ষে নিয়মিত বাজার থেকে কিনে সংসার চালানো সম্ভব না। লাইনে দাঁড়িয়ে যা পাই তা যে যথেষ্ট- তাও না, কিন্তু খরচ কিছুটা কমে। সমস্যা হচ্ছে, অনেক মানুষেরই আমার মত দরকার, তাও যদি পাওয়া যায়, তাহলে ভালো।’ টিসিবির ওই ট্রাকের দায়িত্বে থাকা ঢাকা রেশনিংয়ের তদারক কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বললেন, ‘আজকে (গতকাল) এখানে উপকারভোগী ৪০০ জন। চাল বরাদ্দ আছে ২ টন আর আটা ১ টন। চাল প্রতি কেজি ৩০ টাকা, আটা ২৪ টাকা, ২ কেজি ৫৫ টাকা। এখানে একজন সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি চাল ও দুই কেজির দুই প্যাকেট মানে চার কেজি আটা পাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘সকাল ৯টা থেকে আমরা দেওয়া শুরু করেছি। ৫টা পর্যন্ত চলার কথা, কিন্তু ৩টার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে; কিছুই থাকবে না। মানুষ তো অনেক। চাল হয়ত লাইনের সবাই পাবে, আটা সবাই নাও পেতে পারে, আটার বরাদ্দ কম।’ আঙ্গুরী বেগম নামে এক নারী জানান, ‘যাদের শক্তি-সামর্থ্য বেশি তারা লাইন মানে না, ঠেলে সামনে চলে যায়। আমি সকাল সাড়ে ৭টায় আসছি। আমার হাই প্রেশার। এখনও পাই নাই। লাইন থেকে ঠেলে বের করে দেয়।’
কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া সবখানেই দীর্ঘ লাইন জানিয়ে তবারুন নিছা নামের আরেকজন বললেন, ‘কোথাও লাইনে দাঁড়াতে পারি না। মাজায় ব্যথা, ভয়ে দাঁড়াইতে পারি না। আবার মাজা নিয়ে বিছানায় পড়লে ওষুধ দেবে কে?’
সিরাজগঞ্জের মিলি আক্তার স্বামীর সঙ্গে থাকেন মিরপুরে। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে লাইন দাঁড়িয়ে তার ব্যাগে চাল-আটা মিলেছে সাড়ে ১১টায়। ততক্ষণে মাথা ঘুরে পড়ার উপক্রম। পাশের দোকানে বসিয়ে তাকে পানি খাওয়ালেন আরেক নারী।

কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মিলি বললেন, ‘মানসম্মান হানি কইরা আসি তো পেটের দায়ে, কালকে এসে ফিরে গেছি। লাইনে এমন চাপ দিছে- আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।’
তদারক কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বললেন, ‘নারীদের লাইনে বেশি সমস্যা হয়। তারা অনেকেই মনে করেন তারা পাবেন না, যেভাবেই হোক সামনে থাকতে হবে। এজন্য ঠেলাঠেলি হয়। লাইন ধরে সুন্দর করে দাঁড়ালে কিন্তু সবাই আরও আগে মালামাল নিয়ে বাসায় চলে যেতে পারে।’
শাহানা আক্তার নামে এক নারী বলেন, ‘যা দেবার কথা তাই দেয়, এ নিয়ে অসুবিধা নাই। তবে আরও আগে দেওয়া শুরু করলে ভালো হতো। তাহলে এত ভিড় হয় না। যার আসলেই দরকার, সে আসবে, লাইনে দাঁড়াবে। আর ৯টার পর আমাদের কাজে যাওয়া লাগে, ঘরের কাজ থাকে। লাইনে দাঁড়ালে কাজ মিস হয়।’ গতকাল ৭০টি ট্রাক, ওএমএসভুক্ত ১৪৬টি দোকান এবং সচিবালয় এলাকাসহ আরও চারটি স্থানে চাল-আটা বিক্রি করা হয়। দোকানগুলোতে ৪০৯ টন চাল ও ২৯২ টন আটা বিক্রি হয়; আর ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে বিক্রি হয় ১৪০ টন চাল ও ৭০ টন আটা। ঢাকা রেশনিংয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুন বলেন, ‘মানুষের চাহিদা আছে বলেই ভিড় বেশি। আমাদের কর্মকর্তারা নিয়মিত তদারক করছে।’

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

ওএমএসের লাইনে মধ্যবিত্ত

আপডেট সময় : ০২:১৬:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক : নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ। আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়ায় জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় কিছুটা কম দামে খোলা বাজারের (ওএমএস) পণ্য পেতে নিরুপায় হয়ে নি¤œবিত্তদের সঙ্গে অনেক মধ্যবিত্তও লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে এ লাইন। নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে ক্রেতা বেশি হওয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে পণ্য পাচ্ছেন না। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকায় ওএমএসের ট্রাকের লাইনে দাঁড়ানো বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া যায়। তারা জানান, খাদ্যপণ্য কিনতে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে নিয়মিত বাজার থেকে কিনে সংসার চালানো সম্ভব না। তাই কম দামে পণ্য পাওয়ার আশায় ওএমএসের ট্রাকের সামনে লাইন ধরতে হয়। তবে ওএমএসের দীর্ঘ লাইনে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন বয়স্করা। ষাটোর্ধ্ব সুফিয়া বানু বলেন, ‘জামাই নাই- কে নিব, বয়স হইয়া গেছে ৬০। মাজায় ব্যথা, হার্টের রোগী। ঠেলাঠেলির মধ্যে ঢুকতে পারি না, বইসা থাকি, ভিড় কমলে যদি কিছু থাকে নিমু।’ তিনি জানান, ঘরে দুই মেয়ে আর এক ছেলে আছে। ছেলেটা ছোট, স্কুলে যায়, কাজে লাগেনি এখনও। স্বামী গত হয়েছেন আগেই। তাই খাদ্যপণ্য কিনতে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ঝক্কি পোহানোর মত শরীরের অবস্থা নেই। সাহাদুল হক নামে একজন বলেন, ‘সপ্তাহে দুইদিন এখানে চাল নিতে আসি। আমার শ্বাসের ব্যারাম, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াইলে মাথা ঘুরায়, এইজন্য এখানে এসে বসছি।’ শেওড়াপাড়ায় ওএমএসের ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ফাহিম খান। বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের একসময়ের এই শিক্ষক সেখানে দাঁড়িয়েছেন সকাল পৌনে ৯টায়, বেলা ১১টার সময়ও তিনি ট্রাক ছুঁতে পারেননি। অসহায় কণ্ঠে ফাহিম খান বললেন, ‘আমার ফ্যামিলিতে ১৫ জন মানুষ। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে আমার পক্ষে নিয়মিত বাজার থেকে কিনে সংসার চালানো সম্ভব না। লাইনে দাঁড়িয়ে যা পাই তা যে যথেষ্ট- তাও না, কিন্তু খরচ কিছুটা কমে। সমস্যা হচ্ছে, অনেক মানুষেরই আমার মত দরকার, তাও যদি পাওয়া যায়, তাহলে ভালো।’ টিসিবির ওই ট্রাকের দায়িত্বে থাকা ঢাকা রেশনিংয়ের তদারক কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বললেন, ‘আজকে (গতকাল) এখানে উপকারভোগী ৪০০ জন। চাল বরাদ্দ আছে ২ টন আর আটা ১ টন। চাল প্রতি কেজি ৩০ টাকা, আটা ২৪ টাকা, ২ কেজি ৫৫ টাকা। এখানে একজন সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি চাল ও দুই কেজির দুই প্যাকেট মানে চার কেজি আটা পাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘সকাল ৯টা থেকে আমরা দেওয়া শুরু করেছি। ৫টা পর্যন্ত চলার কথা, কিন্তু ৩টার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে; কিছুই থাকবে না। মানুষ তো অনেক। চাল হয়ত লাইনের সবাই পাবে, আটা সবাই নাও পেতে পারে, আটার বরাদ্দ কম।’ আঙ্গুরী বেগম নামে এক নারী জানান, ‘যাদের শক্তি-সামর্থ্য বেশি তারা লাইন মানে না, ঠেলে সামনে চলে যায়। আমি সকাল সাড়ে ৭টায় আসছি। আমার হাই প্রেশার। এখনও পাই নাই। লাইন থেকে ঠেলে বের করে দেয়।’
কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া সবখানেই দীর্ঘ লাইন জানিয়ে তবারুন নিছা নামের আরেকজন বললেন, ‘কোথাও লাইনে দাঁড়াতে পারি না। মাজায় ব্যথা, ভয়ে দাঁড়াইতে পারি না। আবার মাজা নিয়ে বিছানায় পড়লে ওষুধ দেবে কে?’
সিরাজগঞ্জের মিলি আক্তার স্বামীর সঙ্গে থাকেন মিরপুরে। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে লাইন দাঁড়িয়ে তার ব্যাগে চাল-আটা মিলেছে সাড়ে ১১টায়। ততক্ষণে মাথা ঘুরে পড়ার উপক্রম। পাশের দোকানে বসিয়ে তাকে পানি খাওয়ালেন আরেক নারী।

কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মিলি বললেন, ‘মানসম্মান হানি কইরা আসি তো পেটের দায়ে, কালকে এসে ফিরে গেছি। লাইনে এমন চাপ দিছে- আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।’
তদারক কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বললেন, ‘নারীদের লাইনে বেশি সমস্যা হয়। তারা অনেকেই মনে করেন তারা পাবেন না, যেভাবেই হোক সামনে থাকতে হবে। এজন্য ঠেলাঠেলি হয়। লাইন ধরে সুন্দর করে দাঁড়ালে কিন্তু সবাই আরও আগে মালামাল নিয়ে বাসায় চলে যেতে পারে।’
শাহানা আক্তার নামে এক নারী বলেন, ‘যা দেবার কথা তাই দেয়, এ নিয়ে অসুবিধা নাই। তবে আরও আগে দেওয়া শুরু করলে ভালো হতো। তাহলে এত ভিড় হয় না। যার আসলেই দরকার, সে আসবে, লাইনে দাঁড়াবে। আর ৯টার পর আমাদের কাজে যাওয়া লাগে, ঘরের কাজ থাকে। লাইনে দাঁড়ালে কাজ মিস হয়।’ গতকাল ৭০টি ট্রাক, ওএমএসভুক্ত ১৪৬টি দোকান এবং সচিবালয় এলাকাসহ আরও চারটি স্থানে চাল-আটা বিক্রি করা হয়। দোকানগুলোতে ৪০৯ টন চাল ও ২৯২ টন আটা বিক্রি হয়; আর ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে বিক্রি হয় ১৪০ টন চাল ও ৭০ টন আটা। ঢাকা রেশনিংয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুন বলেন, ‘মানুষের চাহিদা আছে বলেই ভিড় বেশি। আমাদের কর্মকর্তারা নিয়মিত তদারক করছে।’