ঢাকা ০২:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

এ শহর জাদুর শহর, কারোরই নয়!

  • আপডেট সময় : ০৯:৪৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ মে ২০২১
  • ১১৬ বার পড়া হয়েছে

এম এম খালেকুজ্জামান : কবি হাসে, টাকা ভাসে
গঙ্গাবুড়ির শহরে
আসমান তুই কাঁদিস কেন
অট্টালিকার পাহাড়েৃ
এ শহর জাদুর শহর।
চিরকূটের ব্যান্ডের গানের অ্যালিগরি না, ঢাকা সততই এক যাদুর শহর। এ জাদুর শহর সবারই ভাগ্য গড়ে দেয় কোন না কোনভাবে। কোন এক জাদু মন্ত্রে কোটি কোটি লোক কি সুন্দর জড়াজড়ি করে এটে যায় ছোট্ট এক শহরে। আবার সে শহর ছাড়ার সময় কাফেলার মতো ফেরার যান না পেয়ে হেঁটে যায় প্রিয় গন্তব্যে। এদের বেশিরভাগই খেটে খায়। কাপট্য, চাতুরি, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা আর সমূহ নীচতাকে শহরে রেখে সবুজ শুশ্রুষা পাওয়ার জন্য জন্য লাখো মানুষ ছাড়ে এ শহর।

এ শহর কেড়ে নেয় সোনালি সকাল, শুষে নেয় মায়ার বিকেল এপাশ ওপাশ করে রাত পার করে, রোজ সকালের একই যুদ্ধতে যাবে বলে। ওরহান পামুক তার ‘মাই নেম ইজ রেড’ উপন্যাসে ফার্সি শিল্পীদের কথা বলেছিলেন যারা প্রতি বছরই সমান আবেগ নিয়ে আঁকেন ঘোড়ার ছবি, তেমনি আমাদের শহর ছাড়া মানুষেরা প্রতি বছরই সমান আবেগ নিয়ে শহর ছেড়ে বাড়ি যান নির্ভুলভাবে।

জীবন শুষে নেওয়া এ শহর যেন এক প্রাণহীন নির্দয় কংক্রিটের কাঠামো। আর এসব সাধারণরা রুক্ষ্ণ প্রাণহীন শহরে অবস্থান করেও স্থাপন করে রাখেন এমন এক একটি স্থানাঙ্ক যেখানে গেলে তারা ছুঁয়ে ফেলবেন- ‘সবুজের মায়াবী ঝালর যেখানে আছেন মা, বধু, পরিজন’। এ বাড়ি ফেরা আহ্নিক গতির মতোই নিয়মিত। জাতীয় জীবনে এ বাড়ি ফেরার ‘এক-সালা’ ছন্দ এবার আর গতবার স্বাভাবিকতার ছন্দে ছেদ টেনেছে। তা অস্বীকার করি কী করে? লাখো মানুষের প্রায় একই সময়ে বাড়ি ফেরার তাড়না আদতে এক মৌলিক মনস্তাত্ত্বিক মিল ছাড়া কিছু না। যারা এ শহর ছেড়ে যান আর যারা ছাড়তে পারি না আমাদের কেউই আসলে এ শহর ধারণ করি না।

‘ইউলিসিস’ এর লেখক জেমস জয়েস যৌবনে ছেড়েছিলেন প্রিয় শহর ডাবলিন। উপন্যাসের লেখক সে যে তার প্রিয় ডাবলিন ত্যাগ করলেন কিন্তু তারপর থেকে সারা জীবন স্মৃতিতে ডাবলিন নিয়ে ঘুরলেন বিদেশ বিভুঁই। ঈদ পার্বণে বাড়ি ফেরা মানুষেরাও ‘ইউলিসিস’ এর লিওপোল্ড নামের চরিত্রের মতো জীবনের সব না পাওয়ার বিপরীতে বাড়ি ফিরে পেতে চায় বিশেষ কিছু।

তাদের মনেও ডাবলিনের মতো থাকে নেত্রকোনা কিংবা পঞ্চগড়। আর আমরা শহর ছাড়তে পারি না আমাদের আসলে প্রিয় কোন ঠিকানা নেই বলে, জলে ভাসা পদ্ম যেমন।

কারাবাস শেষে, একটু আগেই যে কয়েদ ছিল, লোহার ফটক পেরিয়ে মুক্তভূমিতে পা রেখেই তাকায় আকাশপানে- কে জানে হয়তো কৃতজ্ঞতায় নয়তো উন্মুক্ত আকাশটাকে মুক্ত অবস্থায় দেখার জন্য। এ শহর ছাড়ার পরও এতে থাকতে বাধ্য হওয়া মানুষেরা প্রথমেই নীলাকাশ আর সবুজের আশ্রয় খোঁজে এবং সে সুযোগ পায় বছরে দুই-একবার।

কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো এল ঈদুল ফিতর।

এ পর্যন্ত এ মহামারীতে বিশ্বে মোট ৩৩ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। বাংলাদেশে মারা গেছেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ; পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রমিত হিসেবে শনাক্ত মানুষের সংখ্যা পৌনে ৮ লাখের বেশি।

লকডাউনের কারণে বন্ধ গণ-পরিবহন ব্যক্তিগত যান যাদের নেই কয়েক গুণ বেশি ভাড়া আর সীমাহীন দুর্ভোগ নিয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তায় লাখো মানুষ।
তবে যে বার লকডাউন থাকে না তখনো যে খুব নির্বিঘেœ ঈদ যাত্রা সম্পন্ন হয় এমন না। ফেরিতে ভিড়ের চাপে একদিনেই মারা গেছে একাধিক বাড়ি ফিরতে চাওয়া মানুষ। অথচ আমাদের যাবতীয় মনোযোগ থাকে এমন সাধারণ মানুষকে দাবিয়ে রাখতে। অথচ ওদের ছাড়া পৃথিবী অচল। ওদের ছাড়া বিচ্ছিন্ন হবে যোগাযোগের সেতু, গড়ে উঠবে অলঙ্ঘনীয় সব পাঁচিল, কথিত আলোর পথযাত্রীদের সমস্ত অভিজ্ঞান মিথ্যে হয়ে যাবে।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

এ শহর জাদুর শহর, কারোরই নয়!

আপডেট সময় : ০৯:৪৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ মে ২০২১

এম এম খালেকুজ্জামান : কবি হাসে, টাকা ভাসে
গঙ্গাবুড়ির শহরে
আসমান তুই কাঁদিস কেন
অট্টালিকার পাহাড়েৃ
এ শহর জাদুর শহর।
চিরকূটের ব্যান্ডের গানের অ্যালিগরি না, ঢাকা সততই এক যাদুর শহর। এ জাদুর শহর সবারই ভাগ্য গড়ে দেয় কোন না কোনভাবে। কোন এক জাদু মন্ত্রে কোটি কোটি লোক কি সুন্দর জড়াজড়ি করে এটে যায় ছোট্ট এক শহরে। আবার সে শহর ছাড়ার সময় কাফেলার মতো ফেরার যান না পেয়ে হেঁটে যায় প্রিয় গন্তব্যে। এদের বেশিরভাগই খেটে খায়। কাপট্য, চাতুরি, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা আর সমূহ নীচতাকে শহরে রেখে সবুজ শুশ্রুষা পাওয়ার জন্য জন্য লাখো মানুষ ছাড়ে এ শহর।

এ শহর কেড়ে নেয় সোনালি সকাল, শুষে নেয় মায়ার বিকেল এপাশ ওপাশ করে রাত পার করে, রোজ সকালের একই যুদ্ধতে যাবে বলে। ওরহান পামুক তার ‘মাই নেম ইজ রেড’ উপন্যাসে ফার্সি শিল্পীদের কথা বলেছিলেন যারা প্রতি বছরই সমান আবেগ নিয়ে আঁকেন ঘোড়ার ছবি, তেমনি আমাদের শহর ছাড়া মানুষেরা প্রতি বছরই সমান আবেগ নিয়ে শহর ছেড়ে বাড়ি যান নির্ভুলভাবে।

জীবন শুষে নেওয়া এ শহর যেন এক প্রাণহীন নির্দয় কংক্রিটের কাঠামো। আর এসব সাধারণরা রুক্ষ্ণ প্রাণহীন শহরে অবস্থান করেও স্থাপন করে রাখেন এমন এক একটি স্থানাঙ্ক যেখানে গেলে তারা ছুঁয়ে ফেলবেন- ‘সবুজের মায়াবী ঝালর যেখানে আছেন মা, বধু, পরিজন’। এ বাড়ি ফেরা আহ্নিক গতির মতোই নিয়মিত। জাতীয় জীবনে এ বাড়ি ফেরার ‘এক-সালা’ ছন্দ এবার আর গতবার স্বাভাবিকতার ছন্দে ছেদ টেনেছে। তা অস্বীকার করি কী করে? লাখো মানুষের প্রায় একই সময়ে বাড়ি ফেরার তাড়না আদতে এক মৌলিক মনস্তাত্ত্বিক মিল ছাড়া কিছু না। যারা এ শহর ছেড়ে যান আর যারা ছাড়তে পারি না আমাদের কেউই আসলে এ শহর ধারণ করি না।

‘ইউলিসিস’ এর লেখক জেমস জয়েস যৌবনে ছেড়েছিলেন প্রিয় শহর ডাবলিন। উপন্যাসের লেখক সে যে তার প্রিয় ডাবলিন ত্যাগ করলেন কিন্তু তারপর থেকে সারা জীবন স্মৃতিতে ডাবলিন নিয়ে ঘুরলেন বিদেশ বিভুঁই। ঈদ পার্বণে বাড়ি ফেরা মানুষেরাও ‘ইউলিসিস’ এর লিওপোল্ড নামের চরিত্রের মতো জীবনের সব না পাওয়ার বিপরীতে বাড়ি ফিরে পেতে চায় বিশেষ কিছু।

তাদের মনেও ডাবলিনের মতো থাকে নেত্রকোনা কিংবা পঞ্চগড়। আর আমরা শহর ছাড়তে পারি না আমাদের আসলে প্রিয় কোন ঠিকানা নেই বলে, জলে ভাসা পদ্ম যেমন।

কারাবাস শেষে, একটু আগেই যে কয়েদ ছিল, লোহার ফটক পেরিয়ে মুক্তভূমিতে পা রেখেই তাকায় আকাশপানে- কে জানে হয়তো কৃতজ্ঞতায় নয়তো উন্মুক্ত আকাশটাকে মুক্ত অবস্থায় দেখার জন্য। এ শহর ছাড়ার পরও এতে থাকতে বাধ্য হওয়া মানুষেরা প্রথমেই নীলাকাশ আর সবুজের আশ্রয় খোঁজে এবং সে সুযোগ পায় বছরে দুই-একবার।

কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো এল ঈদুল ফিতর।

এ পর্যন্ত এ মহামারীতে বিশ্বে মোট ৩৩ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। বাংলাদেশে মারা গেছেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ; পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রমিত হিসেবে শনাক্ত মানুষের সংখ্যা পৌনে ৮ লাখের বেশি।

লকডাউনের কারণে বন্ধ গণ-পরিবহন ব্যক্তিগত যান যাদের নেই কয়েক গুণ বেশি ভাড়া আর সীমাহীন দুর্ভোগ নিয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তায় লাখো মানুষ।
তবে যে বার লকডাউন থাকে না তখনো যে খুব নির্বিঘেœ ঈদ যাত্রা সম্পন্ন হয় এমন না। ফেরিতে ভিড়ের চাপে একদিনেই মারা গেছে একাধিক বাড়ি ফিরতে চাওয়া মানুষ। অথচ আমাদের যাবতীয় মনোযোগ থাকে এমন সাধারণ মানুষকে দাবিয়ে রাখতে। অথচ ওদের ছাড়া পৃথিবী অচল। ওদের ছাড়া বিচ্ছিন্ন হবে যোগাযোগের সেতু, গড়ে উঠবে অলঙ্ঘনীয় সব পাঁচিল, কথিত আলোর পথযাত্রীদের সমস্ত অভিজ্ঞান মিথ্যে হয়ে যাবে।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।