সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : করোনা ভাইরাসের ভয়কে উপেক্ষা করে, স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে ঈদের সময় এই যে লাখ লাখ মানুষ গাদাগাদি করে বাড়ি গেল তার নানা ব্যাখ্যা হচ্ছে এখন মূলধারার গণমাধ্যমে এবং সামাজিক মাধ্যমের নানা পরিসরে। মানুষ কষ্ট করে বাড়ি গেছে, অনেক বেশি খরচ করে বাড়ি গেছে এবং ফেরি থেকে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে মারাও গেছে। কিন্তু কোন কিছুই মানুষকে থামাতে পারেনি এই ভয়ংকর ঈদযাত্রা থেকে।
এত ঝুঁকি নিয়ে কেন মানুষ এভাবে বাড়ি যায়? এটা কি শুধুই প্রিয়জনের সাথে ঈদ উদযাপন, নাকি অন্য কিছু? অনেকেই বলছেন, বেঁচে থাকার জন্য, কাজ করার জন্য, বেকারত্ব থেকে বাঁচতে এ শহরে মানুষ আসলেও, বাস করলেও, এ শহরটাকে বেশিরভাগ মানুষ তাদের নিজস্ব শহর মনে করে না। একথা যেমন দরিদ্র, সংগ্রামী মানুসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি সত্য ধনিক শ্রেণির জন্যও। দরিদ্র ও নি¤œ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ গ্রামকে তার নিজস্বতায় দেখলেও এ ঢাকাকে দেখে না। তেমনি বড়লোকদের বেলায়ও। তারা বেগম পাড়া, সেকেন্ড হোম নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু এ শহরে থাকে টাকা বানানোর জন্য।
যে শহরে ভালো পরিবহন ব্যবস্থা নেই, যে শহরে ঘর থেকে কোনও কাজে বের হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ না করতে না পেরে ঘরে ফিরতে হয়, যেখানে শিশুরা বড় হচ্ছে খেলার মাঠের অভাবে, যে শহরে চিকিৎসা ও শিক্ষার পর্যাপ্ততা নেই সেই শহর ছেড়ে যেতে চাইবে মানুষ এটাই স্বাভাবিক। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বেগম পাড়ায় যায়, কিন্তু যাদের উপায় নেই, তারা এভাবে মরে মরে বাড়ি যায়।
রাজধানী ঢাকা আসলে একটা শহরের মতো বেড়েই উঠেনি। এবং তার ছায়ায় অন্য শহরও বেড়ে উঠতে পারেনি। ঢাকার নগরায়ণকে বলা যায় একটা পাগলামি শহরায়ণ – অতি দ্রুততার সঙ্গে, পরিকল্পনাহীনভাবে। যখন যা ইচ্ছে তা-ই করা হয়েছে এখানে। ঢাকা শহরে কত লোক থাকে, কত লোক এখানে প্রতিদিন প্রবেশ করে তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে আন্দাজ করে সবাই বলে এটি একটি দুই থেকে আড়াই কোটি মানুষের শহর। বাংলাদেশের সমান বা তার চেয়ে বড় দেশ আছে, যাদের পুরো জনসংখ্যাও এতো না।
পুরোনো কারও সাথে কথা হলে ঢাকা শহরও যে একসময় সুন্দর আর গোছানো ছিল তার কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু এখন কোথাও পরিকল্পনার কোন ছিঁটেফোটাও নেই। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলে গেছে সে। নব্বইয়ের দশকে হুড়মুড়িয়ে বদলে যেতে থাকলো ঢাকা। একে একে একতলা দোতলা বাড়িগুলো ভেঙে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠতে থাকল বহুতল, যার নাম হলো অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট। ভূমিদস্যুরা পানি প্রবাহের সব জায়গা দখল করে, ভরাট করে আমাদের জন্য বানাতে লাগলো ফ্ল্যাট। বড় ক্ষমতাধররা নিতে শুরু করলো পানির দরে প্লট নামের সোনার খনি। বাস্তুহারা হতে থাকলো বহু যুগ ধরে বাস করা মানুষগুলো। তারা কোথায় যায় কেউ জানে না। শহর ছড়িয়ে গেছে একদিকে গাজীপুর, অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। কিন্তু সব মিলিয়ে ঢাকা, গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জ-কে সিটি কর্পোরেশনভুক্ত করা হলেও এগুলো কোনটিই শহর নয়। ঢাকাতো নয়ই।
ঢাকা এখন মশার শহর, ঢাকা আবর্জনার শহর। ঢাকা যানজটের শহর, ঢাকা জলাবদ্ধতার শহর, রোগের শহর, পরিবহন দানবের শহর, দূষণের শহর। ঢাকা আগুন লাগার শহর এবং এবারের ঈদ প্রমাণ করলো মরে গিয়ে হলেও ঢাকা হলো ছেড়ে যাওয়ার শহর। অর্থাৎ এই শহরের কোন ওনারর্শিপ নেই।
শহরের পরিসরের অন্তত ৩০ শতাংশ রাস্তা হওয়া প্রয়োজন, ঢাকায় সেখানে মাত্র আট শতাংশ। শহরের প্রায় সব ফুটপাতই দখল হয়ে আছে, ফলে মানুষ রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য। কাজেই, রাস্তার মাপ আরও কমেছে। অর্থাৎ, নামমাত্র রাস্তায় বহু গাড়ি একটু জায়গার জন্য আক্ষরিক অর্থেই মারামারি করছে। শহরের ট্রাফিক তাই আর গতি পায় না। এই শহরে গণপরিবহন সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে। যা আছে পুরোটাই বিশৃঙ্খলা আর পরিবহন শ্রমিকদের স্বেচ্ছাচার। সবাই যদি নিজের গাড়িতে চেপে অফিসে যান, বাচ্চাকে স্কুলে পাঠান, তাহলে গণপরিবহন গুরুত্ব পাবে কী করে?
যারা নীতিনির্ধারক, তারা কাদের বেশি গুরুত্ব দেবেন, যারা নিজেদের গাড়িতে চড়েন, নাকি পাবলিক বাসে চড়বেন? সন্দেহ নেই গাড়িওয়ালাদের প্রতি রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের বিশেষ ভালোবাসা আছে। বাসগুলো যদি চড়ার মতো হতো, যদি রেল ব্যবস্থা থাকতো, হয়তো অনেকেই নিজের গাড়ির বদলে বাসে-রেলে যাতায়াত করতেন। একজন মানুষের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি যতখানি রাস্তা দখল করে, বাস সে তুলনায় কিছুই করে না। গাড়ির বদলে অনেকে যদি বাসে চড়তেন, তাহলেই এত জট লেগে থাকতো না। দুনিয়ার বহু সভ্য শহরে তা-ই হয়। কিন্তু, ঢাকা তো অসভ্য।
এই যে একটা নগরী সভ্য হলো না, এর কারণ কী? আমি কোনও সমাধান দেওয়ার জন্য লিখছি না। কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণ হলো, এই শহরকে কেউ নিজের মনে করে না। এখানে যারা রাজনৈতিক নেতা, আমলা, সরকারি চাকুরে, ব্যবসায়ী, বড় বুদ্ধিজীবী, যাদের কথায় সব চলে, তাদের অনেকেরই উন্নত দেশের পাসপোর্ট আছে। এবং সমস্যা লুকিয়ে আছে এখানেই। এই শহরে থাকে, কিন্তু এটি তার শহর নয়। আগেই বলেছি তাদের শহর কানাডার বেগমপাড়া, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস বা নিদেনপক্ষে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম। আর যাদের নেই তাদের জন্য আছে মফস্বল বা গ্রাম।
অনেক প্রকল্প হবে শহরকে তিলোত্তমা করার জন্য, কিন্তু তা কোনোদিনই হবে না। অর্থ চলে যাবে পকেটে পকেটে, সেখান থেকে বিদেশে বিদেশে। ফলে যারা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তারা আসলে জেনে বুঝেই নিচ্ছে। তারা বুঝতে পারছেন এ শহর আর তাদের জন্য নয়।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটি
এ শহর কাদের শহর?
                                 ট্যাগস :  
                                                            
							
                            
                                      জনপ্রিয় সংবাদ                                
                                 
																			 
										















