মোঃ মাহবুবুর রহমান : লালাবাই কি? লালাবাই হলো খুব নরম সুরে একই তাল-লয়ে গাওয়া এক ধরনের গান; যা শিশুদের ঘুমাতে সাহায্য করার জন্য বারবার পুনরাবৃত্তি করে গাওয়া হয়।
হিরোশিমা শহরের কাছে একটি রাস্তা। রাস্তার পাশে খুব বড় একটি পুরাতন গাছ দাঁড়িয়ে আছে। কালের সাক্ষী এই গাছটি বছরের পর বছর ধরে অনেক কিছু দেখেছে। এক গ্রীষ্মের রাতে গাছটি একটি লালাবাই শুনতে পেল। গাছের নিচে এক মা তার ছোট মেয়েকে গান গেয়ে শোনাচ্ছিলেন। মা-মেয়েকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছিল। গানটিও মিষ্টি শোনাচ্ছিল। কিন্তু কালের সাক্ষী এই গাছটির তখন মনে পড়ল আরেকটি হৃদয়-বিদারক লালাবাই।
গাছটির আত্মকথা : “হ্যাঁ, এটি ১৯৪৫ সালের ঘটনা। আমি সেই রাতেও একটি লালাবাই শুনেছিলাম। ক্যালেন্ডারে আগস্ট মাসের ৬ তারিখ। ওই দিন সকালে হিরোশিমা শহরে একটি বড় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। আহতদের সারা শরীর পুড়ে ঝলসে গিয়েছিল। সেই মানুষগুলোকে দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। এমনিতে দিনটি ছিলো খুব গরম। কিছু লোক আমার ছায়াতলে কোনোরকমে এসে পড়ে গেলো। আমি তাদের বললাম, ‘এসো এবং আমার ছায়ায় বিশ্রাম করো। তোমরা শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে।”
রাত এলো। কিছু মানুষ আগেই মারা গিয়েছিল। আমি একটি দুর্বল কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এটি ছিলো একটি লালাবাই। একটি খুব অল্পবয়সী শিশু মেয়ে তার কোলে রাখা একটি ছোট্ট ছেলেকে লালাবাই শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিল। দুজনেরই সারা শরীর পুড়ে গিয়েছিল।
‘মা! মা!’ ছেলেটি অনবরত কাঁদতে থাকলো।
‘কেঁদো না, কেঁদো না’-মেয়েটি বলল। ‘এইতো মা এখানে। তুমি মায়ের কোলেই আছো।’ তারপর আবার গাইতে শুরু করল। সে নিজে শারীরিককভাবে খুব দুর্বল ছিল, কিন্তু সে দরিদ্র ছোট্ট ছেলেটির মা হওয়ার চেষ্টা করেছিল। একজন সত্যিকারের মায়ের মতো ছোট্ট ছেলেটিকে তার কোলে জড়িয়ে ধরে রাখলো।
‘মা, মা’-ছেলেটি তখনও কাঁদছিল।
‘লক্ষী ছেলে আমার, শান্ত হও, কেঁদো না। তুমি ঠিক হয়ে যাবে।’ মেয়েটি বলল।
সে ছেলেটিকে আরও শক্ত করে ধরে এবং সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ক্ষীণস্বরে আবার লালাবাই গাইতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি কান্না থামিয়ে নিঃশব্দে এ পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলো! কিন্তু ঐ ছোট্ট শিশু মাতা গান গাওয়া বন্ধ করেনি। মেয়েটির গলার স্বর ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে।
সকাল হলো। পূর্বদিগন্তে রক্তলাল সূর্য উঠল। কিন্তু মেয়েটি আর নড়লো না।
গাছটির জন্য এটি ছিলো একটি দুঃখজনক স্মৃতি, একটি ট্র্যাজিক লালাবাই।
আমার কথা: ওয়্যার লিটারেচার পড়ানোর সময়, সভা-সেমিনারে কথা বলার সময় বিদেশিরা বাংলাদেশের লালাবাই এবং হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গল্প শুনতে চায়। আমি শুনিয়েছি অনেক। মাকে লেখা চিঠি বুক পকেটে রেখে আন্দোলনে নেমে শহীদ হলেন একজন মুক্তিকামী যুবক। এ ধরনের গল্প যা জানি সব বলেছি। কিন্তু এই লালাবাই গল্পটির মতো মর্মস্পর্শী কোনো গল্প আজ পর্যন্ত শোনাতে পারিনি। হয়তো আছে; কিন্তু আমার পড়া হয়নি বা জানা হয়নি। যদি কেউ জানেন, আমাকে শেয়ার করবেন প্লিজ।
শুধুমাত্র ক্ষুদিরামের ফাঁসি বিষয়ে-‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানটি ব্যাখ্যা করে দেখেছি-বিদেশি শ্রোতাদের বেশ মনযোগ আকর্ষণ করে। একটি গানের মধ্যে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং তাদের অত্যাচারের ইতিহাস সংক্ষেপে ফুটে ওঠে। একটি গান যেন একটি প্রতীক।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্মরণে একটি গান আছে। ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা।’’ এই গানটির একটি লাইন ‘হয়তো বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না, বড় বড় লোকেদের ভিড়ে তোমাদের কথা কেউ কবে না।’ এই একটি লাইন যথেষ্ট। আমি এ পর্যন্ত যত ওয়্যার লিটারেচার পড়েছি, তার মধ্যে এই লাইনটি আমার কাছে এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি মনে হয়। কিন্তু এই লাইনটি গল্প আকারে ব্যাখ্যা করতে গেলে শ্রোতাদের মর্মবেদনা আপেক্ষিক হয়ে যায়। যেকোনো লেখক একটু চেষ্টা করে দেখবেন কি-এই লাইনটি নিয়ে একটি হৃদয়স্পর্শী ছোটগল্প লেখা যায় কিনা? অথবা ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত আপনার পছন্দের যে কোনো বিষয়ে লিখতে পারেন। হৃদয় ছুঁয়ে যায় এমন একটি গল্প চাই।
লেখক : সাবেক ম্যাগাজিন সম্পাদক, রাকসু; বর্তমানে জাপানে বসবাসরত।
এ মাদার’স লালাবাই
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ