নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রস্তুতি সেরে কেবল প্রবেশপত্র-কলম গুছিয়ে কেন্দ্রে ঢুকে যাওয়া নয়, করোনাভাইরাসের চোখ রাঙানির মধ্যে বাড়তি সতর্কতা নিয়েই এবার পরীক্ষায় বসতে হয়েছে মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীদের।
মাস্কে নাক-মুখ ঢেকে, হাতে স্যানিটাইজার নিয়ে অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল রোববার তাদের ঢুকতে হয়েছে পরীক্ষার কেন্দ্রে। সকাল ১০টায় পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এবারের বিলম্বিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে, তাতে বিজ্ঞান বিভাগের ৫ লাখ ৬ হাজার ৮৩১ জন শিক্ষার্থীর অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
সবমিলিয়ে এবার এসএসসিতে পরীক্ষার্থী ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন; সারা দেশে ৩ হাজার ৬৭৯টি কেন্দ্রে এই পরীক্ষা হচ্ছে। এসএসসির বাধা পেরিয়ে যেতে পারলেই কলেজ, শিক্ষাজীবনের নতুন অধ্যায়। কিন্তু এবার সেই পথে রয়েছে অদৃশ্য অন্য এক কাঁটা, যার নাম করোনাভাইরাস। পরীক্ষার মধ্যে জ্বর এলেই শেষ হয়ে যেতে পারে পরীক্ষার্থীর একটি বছর।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-মাদ্রাসা বোর্ডে অনুপস্থিত ১১ হাজার পরীক্ষার্থী : সারা দেশে একযোগে শুরু হয়েছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। গতকাল রোববার সকাল ১০টায় শুরু হয়ে পরীক্ষা শেষ হয় সাড়ে ১১টায়। সূত্রে জানা যায়, পরীক্ষার প্রথম দিন ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রাম ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে প্রায় ১১ হাজার পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অসদুপায় অবলম্বনের জন্য ১০ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তথ্যমতে, পরীক্ষার প্রথম দিনে ঢাকা বোর্ডের অধীনে ৪২৩টি কেন্দ্রে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮০৭ জন অংশগ্রহণ করার কথা থাকলেও অংশগ্রহণ করেছেন ১ লাখ ২৭ হাজার ৯২৩ জন। সে হিসেবে অনুপস্থিত ছিলেন ৮৮৪ জন পরীক্ষার্থী। এই বোর্ডে কাউকে বহিষ্কার করা হয়নি। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে ২০৪টি কেন্দ্রে ২৮ হাজার ৩৩৭ জনের মধ্যে ২৮ হাজার ১৪৩ জন উপস্থিত ছিলেন। এদিন ১৯৪ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৩৭১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪৭৭ জন। সে হিসেবে অনুপস্থিত ছিলেন ৯ হাজার ৮৯৪ জন। এছাড়া অসাধু পন্থা অবলম্বন করায় ১০ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২০ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৯ জন। সে হিসাবে এবার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৩৩৪ জন। বৃদ্ধির এ হার ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ছাড়াও আটটি দেশে ৪২৯ জন পরীক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। দেশের বাইরে ৯টি কেন্দ্র হলো- জেদ্দা, রিয়াদ, ত্রিপলি, দোহা, আবুধাবি, দুবাই, বাহরাইন, ওমানের সাহাম ও গ্রিসের এথেন্স।
মহামারীকালের এই পরীক্ষায় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে সব কেন্দ্রে হাত জীবাণুমুক্ত করা ও তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়েছে। রাখতে হবে আইসোলেশন রুমও। কেন্দ্র এলাকায় অভিভাবকদের ভিড় না করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
রাজধানীর কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা কোভিড বিধি মেনে কেন্দ্রে প্রবেশ করলেও বাইরে অভিভাবকদের জটলায় তা উপেক্ষিত ছিল। কিছু কেন্দ্রে যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থাও দেখা যায়নি।
পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষার্থী ও কেন্দ্রের কর্মী ছাড়া অন্য যেন পরীক্ষা কেন্দ্রের ২০০ গজের ভেতরে প্রবেশ না করে, সে বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ। শিক্ষামন্ত্রীও অভিভাবকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীর সাথে একজনের বেশি অভিভাবক না আসতে অনুরোধ জানিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের সাথে তিন-চারজন করেও অভিভাবক এসেছেন।
অভিভাবকদের ব্যাপক চাপে কেন্দ্রের প্রবেশপথে ঢোকা কঠিন হয়ে পড়ে। স্কুলের সামনের প্রধান সড়কে তৈরি হয় যানজট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিভাবকদের সরে যেতে বললেও তাতে কাজ হয়নি। সোয়া ৯টা থেকে এই কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীরা ঢুকতে শুরু করে। অভিভাবকদের উপচে পড়া ভিড় ঠেলে কেন্দ্রে প্রবেশ করা শিক্ষার্থীরাও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মনিপুর স্কুলের পরীক্ষার্থী কাজী আফরা জাহান বললো, অভিভাবকদের জটলায় কেন্দ্রে ঢুকতেই বেশ সময় লেগেছে তার। “গার্ডিয়ানদের কারণেই অনেক সমস্যা হচ্ছে। ভিড় ঠেলে ধাক্কাধাক্কি করে অনেক কষ্টে চিৎকার চেঁচামেচি করে ঢুকতে হয়েছে। তাদের কারণে দেরি হচ্ছে ঢুকতে। করোনার ভয় তো আছেই।” গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মাপতে দেখা যায়নি। নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে স্যানিটাইজার থাকলেও সব শিক্ষার্থীদের তা দিতেও দেখা যায়নি।
আলাদা আলাদা করে পরীক্ষার্থীদের ঢুকতে বললেও তা মানেনি অনেকে। মনিপুর স্কুলের শিক্ষার্থী ফাহমিদা আক্তারের সাথে কেন্দ্রে এসেছিলেন তার বাবা-মা। এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে একাধিক অভিভাবক থাকায় জটলার বিষয়ে প্রশ্ন করলে ফারুক হোসেন বলেন, “পাবলিক পরীক্ষায় বাবা-মাকে তো আসতেই হয়। আর বাচ্চারা বের হয়ে তো গার্ডিয়ান খুঁজবে। মোবাইল নাই, দূরে থাকলে পাবে কী করে?”
আরেক অভিভাবক নাসরীন জাহান বললেন, “বাচ্চাদের জন্য তো টেনশন হয়। সে পরীক্ষা দেবে, তখন তো আমি বাসায় বসে থাকতে পারব না।” তার যুক্তি, “এত শিক্ষার্থী একসাথে পরীক্ষা দিলে ভিড় হবেই। এটা আটকে রাখা সম্ভব না।” তবে মিরপুরের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অভিভাবকদের তেমন চাপ দেখা যায়নি। প্রবেশপথ ফাঁকা থাকায় শিক্ষার্থীরা নির্বিঘেœই প্রবেশ করতে পেরেছে।
একজন একজন করে হাত স্যানিটাইজ করে পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে প্রবেশ করেছে। তবে এ স্কুলেও প্রবেশপথে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র ছিল না। এই কেন্দ্রের নিরাপত্তারক্ষী হজরত আলী বলেন, “সবাইকে নিয়ম মেনে ঢুকাচ্ছি আমরা। মাস্ক পরে সবাই আসছে। স্যানিটাইজ করে ভেতরে নিচ্ছি।”
শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের পরীক্ষার্থী তানজীম হোসেন জানান, দেরি হলেও পরীক্ষা দিতে পেরে তারা খুশি। “অটোপাসের কথা তো আর শুনতে হবে না। পরীক্ষার কারণে পড়াশুনায়ও গতি এসেছে। নিরাপদে পরীক্ষা দিতে পারলেই আমরা খুশি।”
সংক্রমণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি পরীক্ষার্থীরা টিকা নিয়ে নেওয়ায় করোনাভাইরাস নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগ কমেছে। এ কেন্দ্রে আসা প্রগতি উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান মোহিনীর মা মনি বললেন, “পরীক্ষা হওয়ায় আমরা খুশি। আশা করি ভাল ফলাফল করবে। স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে এখন আর চিন্তা করছি না। শিক্ষার্থীরা তো মাস্ক পরেই আছে। আর সংক্রমণও কমে আসছে।”
শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের বায়েজীদ হোসেনের মা মাকসুদা বেগম বলেন, “বাইরে জটলা আছে। কিন্তু ভিতরে তো দূরত্ব মেনেই পরীক্ষা হবে। গেইট দিয়ে তো জীবাণুমুক্ত করেই বাচ্চাদের প্রবেশ করানো হচ্ছে না। সেজন্য তেমন ভয় পাচ্ছি না।” দেশে ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা হয়ে এলেও কোভিডের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবার নয় মাস পিছিয়ে এই পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। সোহেলা আক্তার নামে একজন অভিভাবক বললেন, করোনাভাইরাসের কারণে এবার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার ধারণা। “এতদিন পর পরীক্ষাটা হচ্ছে, অ্যানাউন্সমেন্টের পরই মূলত পড়াশোনা শুরু হইছে। আগে তেমন পড়েনি। ফলে গ্যাপ পড়ে যাবে। উচ্চ মাধ্যমিক সংক্ষিপ্ত করে দিলে গ্যাপটা সারা জীবন থেকে যাবে।”
এসএসসি পরীক্ষা শুরু: পরীক্ষার্থীরা সতর্ক, অভিভাবকরা উদাসীন
জনপ্রিয় সংবাদ