তারেক অপু
কথায় আছে ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। এই কথা যদি সত্য হয়, তাহলে শিক্ষক কী? শিক্ষক হলেন সেই মেরুদণ্ড তৈরির কারিগর। এই কারিগরের পেটে ভাত না থাকলে তিনি শিক্ষাদান করবেন কীভাবে? কীভাবে শক্ত মেরুদণ্ড তৈরি হবে? শিক্ষকদের যথযাযথ সম্মান ও সম্মানী- কোনোটাই আমরা দিতে পারছি না। রাষ্ট্র্রও যে তাদের বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নিয়েছে, তা বলা যাবে না। তাহলে শিক্ষকরা কেন রাস্তায় বিক্ষোভ করছেন?
আমাদের দেশের ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য রাষ্ট্রের ব্যয় খুবই সামান্য। বছরের বছর তারা প্রাপ্য পেতে আন্দোলন করে আসছেন। পুলিশ দিয়ে তাদের আন্দোলন দমানোর চেষ্টা চলেছে। মহান শিক্ষকদের পিঠে লাঠি চালিয়েছে পুলিশ।
রোববার (১২ অক্টোবর) দুপুর ১টা ৫০ মিনিটের দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর জলকামান নিক্ষেপ করে পুলিশ। সেখানে সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দও পাওয়া যায়। কয়েকজনকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। একজনকে হাতকড়া পরিয়ে টেনে নেওয়া হয়। তোলা হয় প্রিজন ভ্যানে। এই দৃশ্য একটা সভ্য দেশের জন্য ক্ষত। শিক্ষক সম্মানী ব্যক্তি। তাদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। এই নির্যাতন সহ্য করেও তারা দমে যাননি। সেখান থেকে তারা রাতে সরে যান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। দুটি রাত তারা এরই মধ্যে সেখানে পার করেছেন। দুঃখের বিষয়- সরকারের কেউ এখন পর্যন্ত যোগাযোগ করেননি। তার মানে সরকার তাদের দাবি ও আন্দোলনকে আমলে নিচ্ছেন না। সচিবালয় অভিমুখে লংমার্চ করার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষকরা। একই সঙ্গে চলছে তাদের কর্মবিরতি। বার্ষিক পরীক্ষার মাসখানেক আছে। এই সময়ে এই কর্মসূচি নিঃসন্দেহে পড়ালেখার পরিবেশ নষ্ট করছে। সব কিছু বিবেচনা করে সরকারকে দ্রুত সাড়া দিতে হবে।
দিন দশেক আগে পত্রিকায় দেখলাম এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া বেড়েছে ৫০০ টাকা। এখন থেকে তারা এই ভাতা পাবেন মাসে ১৫০০ টাকা। ছোট্ট একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। ১৫০০ টাকা ভাড়ায় দেশের কোথায় বাসা ভাড়া পাওয়া যায়? যারা এই ভাতা নির্ধারণ করেন, তারাও জানেন এই টাকায় বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না। তারপরও তারা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিল্ডিং-আধা পাকা ঘর নয়, অজপাড়াগাঁয়ও ১৫০০ টাকা ভাড়ায় একটি টিনের ছাপরাও ভাড়া পাওয়া যায় না। তাহলে বাড়ি ভাড়ার নামে শিক্ষকদের সঙ্গে এই তামাশা কেন? শিক্ষকরা ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া বৃদ্ধিকে প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। তারা মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা করার দাবি করেছেন। এ দাবিতে ১২ অক্টোবর থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন তারা।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা মূল বেতনের সঙ্গে মাসে ৫০০ টাকা চিকিৎসাভাতা পান। আগে বছরে ২৫ শতাংশ হারে বছরে দুটি উৎসব ভাতা পেতেন। গত মে মাসে বাড়ানোর পর তারা ও এমপিওভুক্ত কর্মচারীরা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ হারে উৎসব ভাতা পাচ্ছেন। এর বাইরে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা বছরে একবার মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বৈশাখী ভাতা পান।
এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী বলেন, ‘৫০০ টাকা বাড়িভাড়া ভাতা বৃদ্ধি আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা কমপক্ষে মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া চান। এর সঙ্গে আমাদের চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা করা এবং এমপিওভুক্ত কর্মচারীদের উৎসব ভাতা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশ করার দাবি জানাচ্ছি।’ সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা মাসে ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। স্থান ভেদে তাদের বাড়িভাড়া মূল বেতনের ৪০, ৫০ ও ৬০ শতাংশ।
বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস নামে একটি ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে সরকারি হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষকের মূল বেতন শুরুতেই ১৬ হাজার টাকা। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ সব মিলিয়ে বেতন দাঁড়ায় ২৬ হাজার টাকার মতো। এটি দশম গ্রেডের চাকরি। সেখানে এমপিওভুক্ত একজন শিক্ষকের মূল বেতন শুরুতে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এটি ১১তম গ্রেডের চাকরি (বিএড করলে দশম গ্রেড)। অর্থাৎ শুরুতেই একটা বৈষম্য। এই শিক্ষকরা এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া এবং ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা। সব মিলিয়ে তার বেতন দাঁড়ায় ১৪ হাজার টাকা। অথচ দায়িত্বের ক্ষেত্রে একই। সরকারি স্কুলের শিক্ষকের মতো তারাও একই বই পড়ান, পরীক্ষা নেন, খাতা দেখেন।
কলেজ পর্যায়েও একই বৈষম্য। চরম এই বৈষম্য তাদের মানসিক পীড়ার মধ্যেই রাখে বৈকী। কারণ বেতন বৈষম্য শুধু জীবনযাত্রা নয়, সামাজিক মর্যাদাতেও প্রভাব ফেলে। বর্তমান বাজার দর হিসেবে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও যে আহামরি বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, তা নয়।
আমাদের দেশের ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির মাধ্যমে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীকে মূল বেতন দেয় সরকার। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও বেতন-ভাতা নিয়ে সন্তুষ্ট নন। যেসব শিক্ষকের বিএড নেই, তারা শুরুতে ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতন পান। আর বিএড থাকলে দশম গ্রেডে যান। এর বাইরে তারা এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া এবং ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। এখন একজন শিক্ষক যদি দশম গ্রেডেও বেতন পান তাহলে শুধু মূল বেতন হবে ১৬ হাজার টাকা। এর বাইরে দেড় হাজার টাকা অন্যান্য ভাতা রয়েছে। অন্যদিকে কলেজ পর্যায়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা নবম গ্রেডে ২২ হাজার টাকা মূল বেতন পান। তারা সরকারি চাকরিজীবীদের মতো পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া, চিকিৎসাসহ অন্যান্য ভাতা পান না। এত দিন শিক্ষকরা মূল বেতনের মাত্র ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতাও পেলেও সম্প্রতি তা ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।
দেশে সাড়ে ছয় হাজার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী, অনার্স-মাস্টার্স কলেজের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষক ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক সরকারি বেতন পান না। দীর্ঘদিন ধরেই তারা এমপিওভুক্তির দাবি করে আসছেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ অন্যান্য দাবিতে আন্দোলন করছেন। শিক্ষকদের এই দুর্দশা লাঘবে জরুরি পদক্ষেপ নিন।
লেখক: সাংবাদিক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ