নিজস্ব প্রতিবেদক : এবার তুলনামূলকভাবে স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পারছেন ঈদ যাত্রীরা। রাজধানীসহ কয়েকটি প্রধান এলাকা ঘরে যে চিত্র দেখা গেছে, তার ভিত্তিতে এমনটাই বলা যায়।
ঘড়ির কাঁটা সকাল ১০টা বেজে ৪৫ মিনিট ছুঁইছুঁই। রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনের ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে কিশোরগঞ্জগামী কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে যাত্রী হিসেবে অপেক্ষা করছিলেন নিয়ামুল করিম। ঈদ করতে সস্ত্রীক গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন রাজধানীর মগবাজারের এই বাসিন্দা। তাঁর চোখেমুখে স্বস্তির চিহ্ন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ভেবেছিলাম রেলস্টেশনে অনেক ভিড় হবে। অন্যবারের তুলনায় এবার তো কোনো ভিড়ই দেখলাম না। সকাল থেকে দেখলাম, ট্রেনগুলো বেশির ভাগ সময়মতোই ছাড়ছে।’
নিয়ামুল করিমের সঙ্গে কথা হতে হতে ঠিক এক মিনিট পর কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাত্রী নিয়ে স্টেশন ছেড়ে যায়। ট্রেনটির নির্ধারিত সময়সূচি ছিল ১০টা ৪৫ মিনিট।
কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ঈদের ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে গত বুধবার থেকে। গতকাল শনিবার কমলাপুর রেলস্টেশনে ঈদযাত্রার চতুর্থ দিন। শনিবার সকাল থেকে স্টেশনে যাত্রীর চাপ গত তিন দিনের তুলনায় কিছুটা কম ছিল। একটু বেলা হতেই স্টেশনে যাত্রীর আনাগোনা বাড়ে। অনেকে যানজটের কথা চিন্তা করে একটু আগেভাগেই কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে আসছেন। তেমনি একজন চট্টলা এক্সপ্রেসের যাত্রী হাফিজুর রহমান। তাঁর বাসা মোহাম্মদপুর। বেলা ১টায় ট্রেনটি স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার কথা। তবে যানজটের কথা ভেবে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুই ঘণ্টা আগেই স্টেশনে চলে এসেছেন।
হাফিজুর বলেন, ‘গত দু বছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বাড়িতে যেতে পারিনি। বাড়িতে বাবা-মা, ভাই-বোনরা আছে। এবার একসঙ্গে সবাই ঈদ করব।’
কমলাপুর রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত আন্তনগর ও লোকাল মেইলসহ ২০টি ট্রেন দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রী নিয়ে ছেড়ে গেছে।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, আজ কয়েকটি ট্রেন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছুটা দেরিতে ছেড়েছে। চিলাহাটি নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ ট্রেনটি ৪০ মিনিট দেরি করে ৭টা ২০ মিনিটে কমলাপুর স্টেশন ত্যাগ করে। পঞ্চগড়গামী একতা এক্সপ্রেস সকাল ১০টা ১০ মিনিটে স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। তবে বেলা ১১টার দিকে ওই ট্রেনটি স্টেশন ছেড়ে যায়।
একতা এক্সপ্রেসের যাত্রী একটি বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। গত দুই বছর করোনার কারণে ঈদে বাড়ি যাননি। এবার তিনি দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। শফিকুল বলেন, আধা ঘণ্টা, ৪০ মিনিট দেরি মানা যায়। এতে কোনো সমস্যা নয়। এটা স্বস্তির যে ট্রেনগুলো বেশির ভাগ সময়মতো ছাড়ছে। তবে বিমানবন্দর স্টেশনে গেলে বগিতে দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না। তখন কষ্ট বোঝা যাবে। যত কষ্টই হোক, বাড়িতে ফিরতে হবে।
কমলাপুর রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার বলেন, এবারের ঈদযাত্রা সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও নিরাপদ হয়েছে। হাতেগোনা কয়েকটি ট্রেন ২০ থেকে ৪০ মিনিট দেরিতে কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছে। এটাকে শিডিউল বিপর্যয় বলা চলে না সময়মতো ট্রেন ছাড়া নিয়ে যাত্রীরা স্বস্তি প্রকাশ করছেন।
মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার বলেন, আমাদের বাড়তি কিছু টিকিট এবং ইমারজেন্সি কোটার কিছু টিকিট রেখে দেওয়া হয়। যখন প্রয়োজন হয়, তখন সঙ্গে সঙ্গেই সেই সব টিকিট অ্যাটাচ করে বিক্রি করা হয়। এ টিকিটগুলো অনস্পট কাউন্টারে পাওয়া যায়।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ এই দুটি ঈদ স্পেশাল ট্রেনসহ আজ সারা দিনে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ১২২টি ট্রেন দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাবে। ট্রেনে দাঁড়িয়ে যাওয়া টিকিট প্রসঙ্গে স্টেশন ব্যবস্থাপক বলেন, একটি ট্রেনের মোট আসনের ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট (দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন) বিক্রি করার সিদ্ধান্ত আছে। সে অনুপাতেই কাউন্টার থেকে স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রি চলছে।
শিমুলিয়ায় ৭ ঘণ্টায় ৫০ হাজার যাত্রী পার : ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার ঘরমুখো মানুষের ঢল নেমেছে শিমুলিয়া ঘাটে। শনিবার সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত শিমুলিয়া ঘাটে লঞ্চ ও স্পিডবোটযোগে পদ্মা পাড়ি দিয়েছেন ৫০ হাজার যাত্রী। বিআইডব্লিউটিএ শিমুলিয়া ঘাটের নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী পরিচালক এবং সহকারী বন্দর কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, শিমুলিয়া নদীবন্দর লঞ্চঘাট থেকে সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত লঞ্চে মোট ২৫২টি ট্রিপ বাংলাবাজার ও মাঝিরকান্দি নৌপথে ছেড়ে গেছে। যাত্রী হিসেবে লঞ্চ ও স্পিডবোটে আনুমানিক ৫০ হাজার যাত্রী এ ঘাট দিয়ে পারাপার হয়েছে। শুক্রবার রাত ৯টা থেকে শনিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ফেরিতে আনুমানিক ১০ হাজারের অধিক যাত্রী পারাপার হয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, স্পিডবোট ও লঞ্চঘাটে যাত্রীদের চাপ। সকাল থেকে অধিকাংশ সময় ঘাটের অ্যাপ্রোচসড়ক ও সিঁড়িতে যাত্রীদের দীর্ঘ জট রয়েছে। একই চিত্র স্পিডবোট ঘাটে। যাত্রীর চাপে স্পিডবোট ঘাটের অবস্থা বেসামাল। ঘাটে নোঙর করতেই যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন নৌযানে। বিআইডব্লিউটিসি শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. ফয়সাল জানান, নৌরুটে একটি রোরো, দুটি মিনি রোরো, দুটি কেটাইপ ও দুটি ডাম্পসহ ১০টি ফেরি সচল রয়েছে। এখন পর্যন্ত দুই হাজারের অধিক মোটরসাইকের পারাপার হয়েছে। ঘাটের শৃঙ্খলা রক্ষায় ১নং ঘাট দিয়ে শুধু মোটরসাইকেল পারাপার হচ্ছে।
গাবতলীতে লোকাল বাসই ভরসা : অন্যান্য দিনের মতো আজও গাবতলীতে চাপ নেই ঘরমুখো মানুষের। শনিবার (৩০ এপ্রিল) সকাল ৮টার মধ্যে অনেকগুলো বাসই ছেড়ে গেছে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তেমন চাপ ছিল না কাউন্টারগুলোতে। তবে সন্ধ্যা থেকে চাপ বাড়বে বলে জানিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। এই সময়ে লোকাল বা আন্তঃজেলা বাসগুলোতে যাত্রীর চাপ বাড়বে বলেও জানান তারা। করোনা বিধিনিষেধের মধ্যেই গত দুই বছর ঈদ উদযাপন করেছে দেশবাসী। করোনা সংক্রমণের কারণে সেভাবে রাজধানীও ছাড়তে পারেনি ঘরমুখো মানুষ। তবে এবছর করোনার প্রকোপ কম থাকায় পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে কয়েকদিন ধরেই রাজধানী থকে গ্রামে ফিরছেন ঘরমুখো মানুষ। শনিবার (৩০ এপ্রিল) সকাল থেকেও বাস কাউন্টারে ছুটে যান ঘরমুখো মানুষ। ব্যাগ হাতে খুঁজছে কাউন্টার। দুই হাত ভর্তি ব্যাগও দেখা যায় অনেকের। ঈদের আগেই বেশ কদিনের ছুটি মেলায় ঘরেফেরা দূরপাল্লার যাত্রীর চাপ কম থাকলেও ঢাকার নিকটবর্তী জেলার মানুষের চাপ দেখা যায় রাজধানীর প্রবেশমুখ গাবতলীতে। শনিবার দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, গাবতলী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমবঙ্গের বাসগুলো ছেড়ে যাচ্ছে। অনেকেই অর্ধদিবস অফিস করে পরিবার নিয়ে ছুটছেন গাবতলীতে। তবে টিকিটপ্রত্যাশীরা নির্বিঘেœ বাসে উঠতে পারলেও বিড়ম্বনায় পড়েছেন টিকিট না পাওয়া যাত্রীরা। যারা টিকিট কাটেননি তাদের ভরসা লোকাল বা আন্তঃজেলা বাস। গাবতলীতে দেখা যায়, দূরপাল্লার যাত্রীর চাপ নেই। সাভার, নবীনগর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ধামরাই গাজীপুর ও পাটুরিয়া ঘাটগামী যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। অধিকাংশ যাত্রীর অবস্থান দেখা যায় সড়ক ও ফুটপাতে। যে বাস পাচ্ছেন তাতেই উঠে পড়ছেন তারা। মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটগামী যাত্রী রাজীব বিশ্বাস বলেন, কাউন্টারে ভিড় কম থাকলেও লোকাল বাসগুলোতে চাপ বেশি। এ সুযোগে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ১৫০ টাকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।
সদরঘাটে বেড়েছে যাত্রীর চাপ : আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে শেষ বিকেলে রাজধানীর সদরঘাটে বাড়ছে যাত্রীদের চাপ। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীর চাপ আরও বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন লঞ্চমালিকরা। শনিবার সদরঘাটে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যাত্রীদের চাপ না থাকলেও শেষ বিকেলে ঘাটে ভিড় করছেন যাত্রীরা। সদরঘাটে পৌঁছাতে বিকেল থেকে যানজটে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। লঞ্চমালিকরা বলছেন, শনিবার গার্মেন্টসে ছুটি শুরু হওয়ায় যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। সন্ধ্যায় ইফতারের পর চাপ আরও বাড়বে। সকাল থেকে বেশ হতাশ ছিলাম। কারণ অন্যান্য সময় সকাল থেকেই ভিড় বেশি থাকে। কিন্তু এবার সকালে তেমন ভিড় ছিল না। তবে বিকেলে ভিড় বাড়ায় কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। মিরপুরের একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত শাহিনা বেগম বলেন, ‘আমগো আজকে ছুটি হইছে। সকালে তাড়াতাড়ি বাইর হইছি। সবাইরে নিয়া আইছি। লঞ্চে তো এহন অনেক ভিড়। সকাল থেকে তো ভিড় কম শুনছি।’ আমিনুল ইসলাম নামের আরেক শ্রমিক বলেন, ‘পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাচ্ছি। লঞ্চে মোটামুটি সিট আছে। আশা করি, শান্তিতে বাড়ি যেতে পারবো।’
এবার তুলনামূলকভাবে স্বস্তিতে ঘরমুখো যাত্রীরা
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ