নিজস্ব প্রতিবেদক: পাঠ্যপুস্তকের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়া এবং এর প্রতিবাদে রাস্তা নামা বিক্ষোভকারীদের উপর হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) এক বিবৃতিতে দুর্নীতিবিরোধী এই সংস্থা প্রশ্ন তুলেছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ‘পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের পুনর্বাসনকেন্দ্রে’ পরিণত হয়েছে কি-না।
নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে পেছনের প্রচ্ছদ থেকে ওই গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ‘কর্তৃত্ববাদের এজেন্ডা বহাল রাখার ঘৃণ্য প্রয়াস’ আখ্যা দিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এনসিটিবি প্রমাণ করতে চেয়েছে, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদের পতন হলেও এই সংস্থায় কর্তৃত্ববাদের চর্চার পরিবর্তন হয়নি। বরং যৌক্তিক প্রশ্ন উঠেছে এনসিটিবি কি বাস্তবে পতিত কর্তৃত্ববাদের এজেন্ডা বহাল রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে?
নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত একটি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিল। সেখানে একটি গাছের পাঁচটি পাতায় লেখা ছিল মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও আদিবাসী; পাশে লেখা ছিল ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’ ব্যানারে গত ১২ জানুয়ারি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড- এনসিটিবি ঘেরাও করার পর রাতে ওই বইয়ের অনলাইন সংস্করণ থেকে চিত্রকর্মটি সরিয়ে ফেলা হয়।
এর প্রতিবাদে বুধবার বেলা ১১টায় পাঠ্যপুস্তক ভবন ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেয় ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্রজনতা’ নামে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন। পরে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ও একইসময়ে পাঠ্যপুস্তক ভবন ঘেরাও করার ঘোষণা দেয়।
ঘোষণা অনুযায়ী ‘আদিবাসী ছাত্রজনতা’র ব্যানারে শিক্ষার্থীরা বুধবার পাঠ্যপুস্তক ভবনের সামনে উপস্থিত হলে সেখানে আগে থেকে অবস্থান নিয়ে থাকা ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’র সদস্যরা তাদের ওপর চড়াও হয় এবং বেধড়ক লাঠিপেটা করে। হামলায় আহত নয়জনকে পরে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
ওই ঘটনার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আশ্বাস দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যে বার্তা দিয়েছে, সেখানে বিক্ষোভকারীদের ‘জাতিগত সংখ্যালঘু’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ওই বার্তায় বলা হয়, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, সরকার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পুনর্ব্যক্ত করছে যে, গণসহিংসতা, জাতিগত বিদ্বেষ এবং গোঁড়ামির কোনো স্থান বাংলাদেশে হবে না। সম্প্রীতি, শান্তি ও আইনশৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটে এমন কর্মকাণ্ডে যারাই লিপ্ত হবে, তাদের পরিচয় বিবেচনা না করে সবার ক্ষেত্রেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সরকার এ বিষয়ে সতর্ক করে দিচ্ছে।
টিআইবি বলছে, এনসিটিবির সিদ্ধান্ত এবং পরে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদরত সংক্ষুব্ধ আদিবাসীদের ওপর ধারাবাহিক হামলা ‘রক্তস্নাত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে সূচিত বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ -এর চেতনা ও প্রত্যাশার সঙ্গে প্রতারণা’।
এনসিটিবির জবাবদিহিতাসহ এই প্রতিষ্ঠানকে ‘কর্তৃত্ববাদের দোসরমুক্ত করে ঢেলে সাজানোর’ আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।
বৃহস্পতিবার সরকারের প্রকাশ করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিকে ‘সময়োপযোগী’ হিসাবে বর্ণনা করে বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আদিবাসী হিসেবে আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতিসহ সমঅধিকারভিত্তিক মর্যাদার প্রশ্নে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এনসিটিবি এবং যারা আদিবাসী হিসেবে আদিবাসীদের নিজেদেরকে পরিচিত থাকার চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা ও দাবির বিরোধিতা করছেন, এবং বিশেষ করে সরকারের অজানা থাকার কথা নয়, বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ পরিচয় ব্যবহার করা যাবে না-এমন উদ্ভট তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিল কর্তৃত্ববাদী সরকার।
আর তার পেছনে ইন্ধন ছিল এমন স্বার্থান্বেষী মহলের যারা আদিবাসী অধিকার হরণের জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক সমালোচনাকে মিথ্যাচারের মাধ্যমে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীকে বলতে চেয়েছিল- ‘বাংলাদেশে আদিবাসী নেই।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্বীকার করতে চায়নি যে আদিবাসী পরিচয়ের মানদণ্ড কোনো জনগোষ্ঠী কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে কতকাল যাবত বসবাস করছেন তার উপর নির্ভর করে না।
তারা মানতে চায়নি যে আদিবাসী হচ্ছেন মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠের বাইরে এমন জনগোষ্ঠী যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রথাগত ও প্রাকৃতিক পরিবেশ-নির্ভর জীবনাচরণের ধারা বহাল রেখে নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচিত থাকতে চায়।
‘আদিবাসী’ পরিচয়ের ওই ব্যাখ্যা যে ‘বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত’, তা না জানা এনসিটিবি’র জন্য ‘লজ্জাজনক’ বলে মন্তব্য করেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক।
তিনি বলেন, শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে কোনো প্রকার বিচার বিবেচনা না করে এক পক্ষের আব্দারের দোসর হওয়া পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই না।
একইসঙ্গে তা নজিরবিহীন রক্তপাত ও প্রাণহানির বিনিময়ে অর্জিত অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈষম্যমুক্ত ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে শুধু সাংঘর্ষিকই নয়, প্রতারণাও বটে। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত গতকালের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ অবস্থান স্পষ্টভাবে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যে বাংলাদেশে সহিংসতা, জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মান্ধতার কোনো স্থান নেই।
যারা ঐক্য, শান্তি ও আইনশৃঙ্খলার বিনষ্ট করবে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। আমরা সরকারের এ বার্তাকে সময়োপযোগী হিসেবে স্বাগত জানাই।
কিন্তু ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘দৃশ্যত সচেতনভাবে’ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পরিচয় হিসেবে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “যা জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত প্রধান উপদেষ্টার ২৫ আগস্টের ২০২৪’র ভাষণে আদিবাসী পরিচয় বিষয়ক শব্দচয়নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
যদি এটি সচেতনভাবেই ঘটে থাকে, তাহলে কি এর মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী এজেন্ডা ও বয়ানের প্রতিফলন ঘটেছে বলে ধরে নিতে হবে না?
‘আদিবাসী’ পরিচয়ের বস্তুনিষ্ঠ ব্যখ্যা ও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক চর্চার অনুসরণে অবস্থান নির্ধারণের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আদিবাসী পরিচয় ব্যবহারের বিরোধী অন্য সকল অংশীজনদের প্রতিও আমাদের একই আহ্বান। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন শুধু ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের মাধ্যমে সম্ভব নয়, কর্তৃত্ববাদ চেতনা ও এজেন্ডা এবং তার বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার চর্চার আমূল পরিবর্তন অপরিহার্য।