শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক : দুইটি পৃথক কিন্তু সম্পৃক্ত ঘটনা মাত্র একদিনের ব্যবধানে ঘটায় বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দুইটি ঘটনাই ঘটিয়েছে দুজন পুলিশ সদস্য। প্রশ্ন উঠেছে এদের কারা উস্কানি দিচ্ছে। ত্বরিত এবং ইতিবাচক সিদ্ধান্তের জন্য যথাক্রমে ঢাকা মহানগর পুলিশ, সিলেট পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় পুলিশ প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে আজকের লিখা শুরু করছি।
প্রথমটি ড. লতা সমাদ্দার নামীয় তেজগাঁ কলেজের এক অধ্যাপিকার কপালে টিপ দেওয়ায় নাজমুল তারেক নামের এক ধর্মান্ধ পুলিশ কনস্টেবলের ন্যাক্কারজনক ঘটনার পর অভিযুক্ত পুলিশকে চিহ্নিত এবং আটক করতে ঢাকা মহানগর পুলিশ, বিশেষ করে তেজগাঁও অঞ্চলের পুলিশ যে নিষ্ঠা এবং দক্ষতা দেখিয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ভুক্তভোগী নারী, যাকে গালাগালি করেই সে কনস্টেবল ক্ষান্ত হয়নি, তার পায়ের উপর মোটর বাইক তুলে তাকে আহতও করেছে, সে কনস্টেবলকে চিহ্নিত করা সহজ ছিল না, কেননা ড. লতা সমাদ্দার সেই পুলিশ সদস্যের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেন নি। অভিযুক্তের মোটর বাইকের নম্বরও নির্ভুল ছিল না, শুধু তার মুখে বড় দাড়ি এবং গায়ে পুলিশের পোশাক এর বাইরে তিনি কিছু বলতে পারেননি। তদুপরি সেই পুলিশ তেজগাঁ এলাকায় কর্তব্যরত ছিল না, তার দায়িত্ব ছিল অন্যত্র। কৃতিত্ব ঢাকা পুলিশের। এ অবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায়, বেশ অল্প সময়ে অভিযুক্তকে চিহ্নিত এবং আটক করার কৃতিত্ব উন্নত দেশের পুলিশ করতে পারতো কিনা সন্দেহ রয়েছে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি সিলেট আদালতে কর্মরত জেলা পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী নামের আরো এক পুলিশ পরিদর্শককে ঘিরে, যাকেও আপাতদৃষ্টিতে একজন ধর্মীয় মৌলবাদী-ই মনে করার কারণ রয়েছে। ঢাকার টিপ নিয়ে হেনস্তার বিরুদ্ধে যারা ফুসে উঠেছে, তাদের সমালোচনা করে একটি পোস্ট দেওয়ার পর পরই সিলেট পুলিশ প্রশাসন, নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেয়ে, এই লিয়াকতকে ক্লোজ করেছে। ঢাকার ঘটনার পর যেখানে গোটা দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, তার পর সিলেট পুলিশের সেই লিয়াকত কিভাবে তার নিন্দনীয় এবং অপরাধমূলক মন্তব্য পোস্ট করলো সেটিই সকল অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিকে ভাবিয়ে তুলেছে। কারা এই ধর্মান্ধ অপশক্তিকে সাহস এবং সহায়তা দিচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা এবং এ ব্যাপারে উপযুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ অপরিহার্য।
এ দুটি ঘটনাকে বিক্ষিপ্ত বলার সুযোগ নেই। গত বছর হিন্দু মন্দিরে আক্রমণের বিষয় তদন্তের জন্য ৭১- এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের যৌথ উদ্যোগে যে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠিত হয়, তার সভাপতির দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। ৪ জন সংসদ সদস্য এবং আরো অনেক প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে এই কমিশন দীর্ঘ ৯ মাস বিভিন্ন জেলা ভ্রমণ করে, বহু ভুক্তভোগী এবং দর্শকের সাক্ষ্য নিয়ে যে সব তথ্য পায় তার অন্যতমটি ছিল এই যে, হিন্দুদের উপর আক্রমণে বিভিন্ন পদ মর্যাদার কয়েকজন পুলিশ এবং স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শুধু আক্রমণকারিদের রক্ষাই করেনি, বরং উস্কানি দিয়েছে এবং প্রত্যক্ষভাবে আক্রমণে শরিক হয়েছে। আমাদের দীর্ঘ এবং বিস্তারিত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে দেয়ার সময় তিনি এটি পড়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। সে সকল ঘটনায় উস্কানি দেয়ার অপরাধে কিছু পুলিশের বিরুদ্ধে আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর এবং র্যাব প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাদের বাইরেও আরো অনেকে রয়েছে, তার সাম্প্রতিক দুইটি উদাহরণ ঢাকার নাজমুল তারেক এবং সিলেটের লিয়াকত। এমনি আরো বেশকিছু নাজমুল-লিয়াকত পুলিশে ঘাপটি মেরে আছে, যাদের চিহ্নিত করে পুলিশ বাহিনী থেকে ছেঁটে ফেলে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু সামান্য কয়েকজন কিছু দুষ্ট লোকই ষড়যন্ত্র করে অনেক অমঙ্গলকর ঘটনা ঘটাতে পারে।
ঢাকার নাজমুলের বিষয়ে যতটা জানতে পেরেছি, তা হলো তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এটি বিভাগীয় বিচারের বিষয়। প্রথমত বরখাস্ত সাময়িকভাবে করে তদন্ত করাই আইন। তদন্তের পর অভিযোগ প্রমাণিত হলেই বিভাগীয়ভাবে তাকে সর্বোচ্চ সাজা হিসাবে বরখাস্ত করা যেতে পারে, তার আগে নয়। সাময়িক বরখাস্তকালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অর্ধেক বেতন পায়, কিন্তু কোন দায়িত্বে থাকতে পারে না। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের মামলার কোন কথা শুনছি না, যদিও ড. সমাদ্দার প্রথম দিনই থানায় অভিযোগ করেছেন, যাকে এজাহার বলা যেতে পারে। অভিযোগ অনুযায়ী এই কনস্টেবল, যাকে আপাতদৃষ্টিতে মৌলবাদী বলে মনে হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ছাড়াও হত্যা চেষ্টার এবং মারাত্মক দৈহিক আঘাতের মামলা এবং বিচার হতে পারে। পুলিশ এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয় তা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকবো। পুলিশ নির্লিপ্ত থাকলে, ড. সমাদ্দার নিজে আদালতে যেয়ে নালিশি মামলা করতে পারবেন। তবে আমরা মনে করছি পুলিশ নির্লিপ্ত থাকবে না।
সিলেটের লিয়াকতকে ক্লোজ করা হয়েছে এবং তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। মানতে হবে যে আইনের পথে চলার জন্য এ মুহুর্তে ক্লোজ করার বাইরে কিছু করার নেই। তাকে রংপুরে বদলির খবরও পাওয়া গেছে। কিন্তু পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা দেখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার সবাই অপেক্ষায় থাকবো। লিয়াকত যা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, যা সে স্বীকার করেছে বলেও গণমাধ্যমে জানা গেল, সেটি নিশ্চিতভাবে আমাদের তথ্য প্রযুক্তি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিভাগীয় ব্যবস্থা হিসেবে প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছে। তবে আরও তদন্ত সাপেক্ষে তাকে সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে বরখাস্তও করা যেতে পারে। কিন্তু এটি কোন ফৌজদারি ব্যবস্থা নয়। আদালতে বিচারে তুলতে হলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেটি বিভাগীয় ব্যবস্থা থেকে আলাদা। তার পর খুঁজে বের করতে হবে এদের উস্কানি এবং প্রশ্রয়দাতা কারা।
দেশ পাকিস্তানি শাসনমুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে বহুলাংশে নিশ্চিহ্ন করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানিপন্থি সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২৫ বছর এই মৌলবাদী অপশক্তিকে দুধ-কলা দিয়ে পালন করেছে বলে আজকের এই অবস্থা। এখন সময় এসেছে কঠোর পন্থায় এদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার।
কপালে টিপ দেয়া ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালি নারীদের সাজসজ্জারই অংশ। যুগ যুগ ধরে এটি বাঙালি কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। এটি বাঙালি নারীদের পরিচিতি, গৌরব, মর্যাদা এবং অহংকারেরই অংশ। এর ওপর আক্রমণ তারাই করছে যারা ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অস্তিত্ব মানতে পারছে না, পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি যাদের অথবা যাদের পূর্ব পুরুষদের বুকে রক্তক্ষরণ হয়েছিল, যাদের অন্তরে সব সময় পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনিত হয়, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ক্রিকেট দল জিতলে যারা খুশি হয়, যারা খেলার মাঠে পাকিস্তানি পতাকা উড়ায়, এই অপশক্তিকে সমূলে উৎখাত করার কোন বিকল্প নেই। আমার স্ত্রী সর্বদা কপালে টিপ দিতো। আমার সকল নিকট আত্মীয়ও কপালে টিপ দিয়ে থাকে। এতে আমি গর্বিত কারণ তারা বাঙালি সংস্কৃতিকে জিঁইয়ে রাখছে। পয়লা বৈশাখ এবং পয়লা ফাল্গুনের দিন সকল নারীই কপালে টিপ দিয়ে থাকেন। তখন এদের মধ্যে কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ- তা আঁচ করার কোন সুযোগ থাকে না। তারা সবাই বাঙালি, বাঙালি ঐতিহ্যে, কৃষ্টিতে নিবেদিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সকলকে একত্রিত হয়ে এই সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ অপশক্তিকে উৎখাত করার শপথ নিতে হবে। একই সাথে পুলিশ এবং প্রশাসনে যেন এই পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের বংশধররা প্রবেশ করতে না পারে, এবং যারা আগেই ঢুকে পড়েছে তাদের উৎখাতের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হতে হবে, আমরা এ দেশকে মৌলবাদি তালেবানি রাষ্ট্র পরিণত হতে দিতে পারি না। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক রাজাকারদের সন্তানদের চাকরির ওপর বিধিনিষেধের যে কথা বলেছেন তা সাধুবাদ পাবার যোগ্য। জার্মানিতে আজও সেই নীতি অনুসরণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িকতা ধ্বংস করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার্থে এই তালেবানি অপশক্তিকে অবশ্যই রুখতে হবে, এটিই হোক আমাদের সম্মিলিত প্রতিজ্ঞা এবং প্রত্যয়।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।