ড. সুলতান মাহমুদ রানা : গত বেশ কয়েকদিনে যারা নিহত হয়েছেন তাদেরকে আমরা কোনোভাবেই ফিরে পাব না। নিহতদের মধ্যে রয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, পুলিশ, শিশু-কিশোর, পথচারী, শ্রমজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মী। আন্দোলন যতই দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে ততই এই সংখ্যা বেড়ে চলেছে। আন্দোলনকারীরা একের পর এক নানা ধরনের দাবিতে ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে সামনে আসছে। সরকারের কাছে তারা যেসব দাবি করে আসছে, সেসব দাবি নিয়ে প্রথম থেকেই সরকার কিছুটা দেরিতে হলেও আন্তরিকতা দেখিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের দাফির দফা যেমন পরিবর্তন হচ্ছে বারবার ঠিক তেমনি ভিন্ন ভিন্ন সমন্বয়করা ভিন্ন ভিন্নভাবে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত কোনো দাবি উত্থাপন করলে তার জন্য একটি যৌক্তিক সময় দিতে হয়। যৌক্তিক দাবি যৌক্তিকভাবেই পূরণ হয়ে থাকে। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, আন্দোলনকারীদের সাথে তিনি কথা বলতে চান, আলোচনা করতে চান। এমনকি গণভবন তাদের জন্য সবসময় খোলা থাকবে বলে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সংঘাত ও সহিংসতা তিনি চান না।
আমরা সবাই বুঝি আন্দোলন যত বেশি সামনে আগাবে সংঘাত, সহিংসতা আরও তত ভয়াবহ হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এই মুহূর্তে আন্দোলনকারীদের যৌক্তিক পূর্ববর্তী ৯ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য হলেও প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনায় বসা উচিত। এমনকি জনজীবনে যে দুর্ভোগ নেমে এসছে, সেই বিষয়টির সুন্দর সমাধানের জন্য হলেও আন্দোলকারীদের আলোচনার পথ বেছে নেয়া যুক্তিসঙ্গত হবে। দেশবাসী একটি স্থিতিশীল পরিবেশ চায়। সারাদেশের মানুষের মনে যে শঙ্কা এবং অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তার শান্তিপূর্ণ সমাধান খুব জরুরি। এই মুহূর্তে আন্দোলনকারীরা যে এক দফা দাবি নিয়ে অসহেযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি চালাচ্ছে তা বাস্তবায়নের দিকে যাওয়া খুব বেশি সহজ হবে না। এর জন্য সংঘাত বাড়তেই থাকবে। সরকার ইতিমধ্যেই যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। এমনকি সেনাপ্রধান দেশের জানমাল রক্ষা এবং স্পাপনা সমূহের হেফাজতের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করেছেন। তারপরও আন্দোলনকারীরা যে এক দফার কথা বলছেন- সেটি কোনোভাবেই যৌক্তিক পর্যায়ে নেই। তাদের পূর্বে ঘোষিত ৯ দফার যৌক্তিকতা অনেক। কিন্তু এক দফার যৌক্তিকতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেনই বা আন্দোলনকারীরা যৌক্তিক সময় না দিয়ে নতুন নতুন দাবি নিয়ে সামনে আসছে? তারা কি দেশের পরিস্থিতির স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাক- সেটি চায় না?
আমরা জানি, কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন দেশের মানুষের শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন সরকার দেরিতে হলেও সংলাপ করতে আগেও আগ্রহ দেখিয়েছিল, এখনও দেখাচ্ছে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করে পরিস্থিতি পুঁজি করে রাখার চেষ্টা করে। বৈষম্যবিরোধী বেশ কিছু ছাত্র নেতার বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে তারা রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়, লক্ষ্য যেন সেই কাক্সিক্ষত চেয়ার। চেয়ার যদি একমাত্র লক্ষ্য হয় তাহলে ইনিয়ে বিনিয়ে না বলে, সরাসরি বলাই ভালো। প্রয়োজনে নূরুল হক নূরুর মতো ছাত্রত্ব ছেড়ে রাজনীতির ময়দানে নেমে কথা বলা ন্যায্য হবে। তাছাড়া আমি মনে করি সাধারণ কোনো শিক্ষাথী কেউই চায় না বিএনপি এবং নিষিদ্ধ জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিজেদের ব্যবহার করা। আমার ধারণা কোনো সুস্থ মস্তিস্কের অভিভাবকরাও তাদের দেয়া একদফা তথা বিএনপি ও নিষিদ্ধ জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন চায় না। অর্থাৎ সরকার পতনের এজেন্ডা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কাছে কাম্য নয়। আর যদি সেটাই হয় তাহলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ তা প্রতিহত করতে মাঠে নেমে যাবে। কারণ তারা বুঝবে যে এটি সরকার পতনের উদ্দেশ্যমূলক আন্দোলন। তখন দেশ চরম অনিশ্চয়তায় চলে যাবে।
দেশের এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনও ক্রমেই সংকটের দিকে যাবে। ইতিমধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে বন্ধ থাকায় রাজধানীতে যানজট বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারছে না। দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম থমকে গেছে। এখন স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ ও অসহযোগের নামে সারাদেশে অরাজকতা তৈরির চেষ্টা করছে। আমরা বিশ্বাস করি যারা সাধারণ শিক্ষার্থী তারা এসব অরাজকতার সাথে নেই। তাহলে কারা এই সুযোগে অরাজকতা এবং হানাহানি চাচ্ছে? ইচ্ছাকৃত বেশ কিছু লাশ ফেলে তাদের কী এমন উপকার হতে পারে। দীর্ঘদিনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে নস্যাৎ করে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই একটি মহল অরাজকতা তৈরি করছে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ক্রমাগত হামলা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ কোনো সুস্থ রাজনীতির লক্ষণ হতে পারে না।
পরিস্থিতি ঘোলা করার অপচেষ্টা চলছেই। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিষয়টি অতিরঞ্জিত করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি আন্তর্জাতিক মহলে মেরুকরণ করা হচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে একটি চাপ সৃষ্টির চেষ্টা ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হচ্ছে। বলা যেতে পারে বিদেশিদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করাই তাদের অন্যতম লক্ষ্য। যখন ভয়াবহ হামলা ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে- তখন সেটি দেখে আর কারও বুঝতে বাকি থাকেনি যে ওই হামলা এবং তাণ্ডব সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হয়েছে। বিশেষ করে ওই সময়ের পরিস্থিতি দেখে অনুমান করা যাচ্ছিল যে একটি মহল চেয়েছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে পরিস্থিতি আরও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠুক। আর যত সংকটপূর্ণ হবে ততই সাধারণ জনগণকে সরকারের বিপক্ষে দাঁড় করানো সম্ভব হবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।