ঢাকা ০৯:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

এক টাকায় ৮ মণ চাল ও বিগত সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধি

  • আপডেট সময় : ০৫:১৩:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫
  • ২ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

সাংবাদিকতায় রিপোর্টিং জীবনে অর্থনীতি নিয়ে যৎকিঞ্চিত ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। সেই সুবাদে অর্থনীতিতে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ কিছুটা ধরতে পারি। এর মর্মার্থ হলো অর্থনীতিতে ‘নয়-ছয়’ করা খুব কঠিন নয়। বিষয়টির স্রষ্টা মধ্যযুগের বঙ্গদেশে শুভঙ্কর দাস নামে গণিতশাস্ত্রের এক পণ্ডিত। তাঁর ফাঁকি দেওয়ার কৌশল থেকেই এসেছে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বাগধারা। হিসাব-নিকাশের মারপ্যাঁচে প্রকৃত বিষয় রেখে কর্তৃপক্ষ কিংবা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে অনৈতিকভাবে ফায়দা হাসিল করার কৌশল।

শুভঙ্কর বাবুর ধরাধামে আবির্ভাবের বহু আগে কৌটিল্য তার বিখ্যাত গ্রন্থ অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রের কর্মচারীদের দ্বারা হিসাব ঠিক রেখে অর্থ আত্মসাতের বিষয় বর্ণনা করেছেন এভাবে- ‘পানির মধ্যে একটি মৎস্য কী পরিমাণ পানি পান করে তা জানা যেমন অসম্ভব, তেমনি একজন সরকারি কর্মচারি কী পরিমাণ অর্থ চুরি করে তা নির্ণয় করাও অসম্ভব ব্যাপার।’

হিসাব-নিকাশের এই মারপ্যাঁচে বিগত সরকারের কোনো জুড়ি ছিল না। এক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তি ছিল- ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’। তাই গণতন্ত্রকে তার পিতার মতোই পায়ের নিচে পিষ্ট করে গুম, খুন ও আয়নাঘরকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এমন কথা তিনি একা বলেছেন বা এহেন কাজ তিনি একাই করেছেন- এমন নয়; বাংলাদেশের জ্যাঠাতো ভাই পাকিস্তানের এক প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল জিয়াউল হক। তিনি বলতেন- ‘আগে ইসলাম, পরে গণতন্ত্র’।

অপরাধীদের ওপর ইসলামি ধরনের শাস্তি, যেমন জিনা বা অবৈধ সঙ্গম করলে পুরুষের পশ্চাদ্বেশে কতটি বেত্রাঘাত করতে হবে, জিয়াউল হক ওই মহৌষধি প্রয়োগের ব্যবস্থা করেছিলেন স্টেডিয়ামভর্তি দর্শকের উপস্থিতিতে। কিন্তু পাকিস্তানে ইসলাম কায়েমের আগেই বিমান বিধ্বংস হয়ে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডে পরিণত করার চক্করে হেলিকপ্টার ও বিমানযোগে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ‘দয়াল তোমার লীলা বোঝা দায়!’

আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা প্রায়ই বলতেন যে, তারা ২০০৯ সালের জিডিপি মাত্র ১০২ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩ সালে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছেন। এটি ছিল স্ফীত। কারণ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো প্রকৃত রফতানির চেয়ে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত রফতানি দেখাতো, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, এতে প্রকৃত জিডিপি’র কোনো পরিবর্তন হয়নি।

ব্র্যাকের সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার বলেছেন, জিডিপি তখনই উন্নয়ন সূচক, যখন অধিকাংশ অর্থনৈতিক কার্যক্রম উৎপাদনশীল হয়। যখন মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয় অযৌক্তিকভাবে বেশি হয়, তখন জিডিপি আকাশচুম্বী হলেও জনগণের প্রকৃত কোনো উপকার হবে না। তাদের জীবনমান উন্নত হবে না, ভোগান্তি কমবে না। বরং জিডিপি নিয়ে আস্ফালন করা হবে অর্থনৈতিক সন্ত্রাসের নামান্তর । দেশে কার্যত আওয়ামী অর্থনৈতিক সন্ত্রাস কায়েম হয়েছিল।

অর্থনীতির তুলনামূলক আলোচনা শায়েস্তা খানের আমলে ‘এক টাকায় ৮ মন চাল পাওয়া যাইত’ গল্প দ্বারা চলে না। কাজেই ২০০৯ সালের ১০০ টাকার মূল্যমান ২০২৩ সালে এক থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। জিডিপি নির্ধারণের সূচক শায়েস্তা খানের আমলের চালের মূল্য দিয়ে স্থির করাও অস্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরে ব্যতিক্রমী কোনো উন্নয়ন হয়নি।

শেখ হাসিনা বলতেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশি মানুষের গড় আয় তিন গুণ বেড়েছে। ব্যয় কি বাড়েনি? ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ১২ বছরে গড় গৃহস্থালী আয় ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা থেকে বেড়ে ৩২ হাজার ৪২২ টাকায় পৌঁছেছে। অর্থাৎ আয় বেড়েছে ২.৮ গুণ। ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ব্যয় ২.১৬ গুণ বেড়েছে। অবকাঠামো খাতে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল প্রকল্পের সুফল নিয়ে বিতর্ক নেই। তবে এই মেগা প্রকল্পগুলোর বিপুল ঋণের বড় অংশই দুর্নীতিতে ব্যয় হয়েছে, এ ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রখ্যাত সাংবাদিক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/ কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

আগুন লাগাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি না: সারজিস আলম

এক টাকায় ৮ মণ চাল ও বিগত সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধি

আপডেট সময় : ০৫:১৩:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

সাংবাদিকতায় রিপোর্টিং জীবনে অর্থনীতি নিয়ে যৎকিঞ্চিত ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। সেই সুবাদে অর্থনীতিতে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ কিছুটা ধরতে পারি। এর মর্মার্থ হলো অর্থনীতিতে ‘নয়-ছয়’ করা খুব কঠিন নয়। বিষয়টির স্রষ্টা মধ্যযুগের বঙ্গদেশে শুভঙ্কর দাস নামে গণিতশাস্ত্রের এক পণ্ডিত। তাঁর ফাঁকি দেওয়ার কৌশল থেকেই এসেছে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বাগধারা। হিসাব-নিকাশের মারপ্যাঁচে প্রকৃত বিষয় রেখে কর্তৃপক্ষ কিংবা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে অনৈতিকভাবে ফায়দা হাসিল করার কৌশল।

শুভঙ্কর বাবুর ধরাধামে আবির্ভাবের বহু আগে কৌটিল্য তার বিখ্যাত গ্রন্থ অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রের কর্মচারীদের দ্বারা হিসাব ঠিক রেখে অর্থ আত্মসাতের বিষয় বর্ণনা করেছেন এভাবে- ‘পানির মধ্যে একটি মৎস্য কী পরিমাণ পানি পান করে তা জানা যেমন অসম্ভব, তেমনি একজন সরকারি কর্মচারি কী পরিমাণ অর্থ চুরি করে তা নির্ণয় করাও অসম্ভব ব্যাপার।’

হিসাব-নিকাশের এই মারপ্যাঁচে বিগত সরকারের কোনো জুড়ি ছিল না। এক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তি ছিল- ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’। তাই গণতন্ত্রকে তার পিতার মতোই পায়ের নিচে পিষ্ট করে গুম, খুন ও আয়নাঘরকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এমন কথা তিনি একা বলেছেন বা এহেন কাজ তিনি একাই করেছেন- এমন নয়; বাংলাদেশের জ্যাঠাতো ভাই পাকিস্তানের এক প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল জিয়াউল হক। তিনি বলতেন- ‘আগে ইসলাম, পরে গণতন্ত্র’।

অপরাধীদের ওপর ইসলামি ধরনের শাস্তি, যেমন জিনা বা অবৈধ সঙ্গম করলে পুরুষের পশ্চাদ্বেশে কতটি বেত্রাঘাত করতে হবে, জিয়াউল হক ওই মহৌষধি প্রয়োগের ব্যবস্থা করেছিলেন স্টেডিয়ামভর্তি দর্শকের উপস্থিতিতে। কিন্তু পাকিস্তানে ইসলাম কায়েমের আগেই বিমান বিধ্বংস হয়ে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডে পরিণত করার চক্করে হেলিকপ্টার ও বিমানযোগে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ‘দয়াল তোমার লীলা বোঝা দায়!’

আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা প্রায়ই বলতেন যে, তারা ২০০৯ সালের জিডিপি মাত্র ১০২ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩ সালে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছেন। এটি ছিল স্ফীত। কারণ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো প্রকৃত রফতানির চেয়ে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত রফতানি দেখাতো, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, এতে প্রকৃত জিডিপি’র কোনো পরিবর্তন হয়নি।

ব্র্যাকের সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার বলেছেন, জিডিপি তখনই উন্নয়ন সূচক, যখন অধিকাংশ অর্থনৈতিক কার্যক্রম উৎপাদনশীল হয়। যখন মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয় অযৌক্তিকভাবে বেশি হয়, তখন জিডিপি আকাশচুম্বী হলেও জনগণের প্রকৃত কোনো উপকার হবে না। তাদের জীবনমান উন্নত হবে না, ভোগান্তি কমবে না। বরং জিডিপি নিয়ে আস্ফালন করা হবে অর্থনৈতিক সন্ত্রাসের নামান্তর । দেশে কার্যত আওয়ামী অর্থনৈতিক সন্ত্রাস কায়েম হয়েছিল।

অর্থনীতির তুলনামূলক আলোচনা শায়েস্তা খানের আমলে ‘এক টাকায় ৮ মন চাল পাওয়া যাইত’ গল্প দ্বারা চলে না। কাজেই ২০০৯ সালের ১০০ টাকার মূল্যমান ২০২৩ সালে এক থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। জিডিপি নির্ধারণের সূচক শায়েস্তা খানের আমলের চালের মূল্য দিয়ে স্থির করাও অস্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরে ব্যতিক্রমী কোনো উন্নয়ন হয়নি।

শেখ হাসিনা বলতেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশি মানুষের গড় আয় তিন গুণ বেড়েছে। ব্যয় কি বাড়েনি? ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ১২ বছরে গড় গৃহস্থালী আয় ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা থেকে বেড়ে ৩২ হাজার ৪২২ টাকায় পৌঁছেছে। অর্থাৎ আয় বেড়েছে ২.৮ গুণ। ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ব্যয় ২.১৬ গুণ বেড়েছে। অবকাঠামো খাতে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল প্রকল্পের সুফল নিয়ে বিতর্ক নেই। তবে এই মেগা প্রকল্পগুলোর বিপুল ঋণের বড় অংশই দুর্নীতিতে ব্যয় হয়েছে, এ ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রখ্যাত সাংবাদিক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/ কেএমএএ