ঢাকা ০৭:৪০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

একসঙ্গে বাবা-মা ও ভাইয়ের শ্রাদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা করতে হলো শর্মীলাকে

  • আপডেট সময় : ০১:৪৫:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ মে ২০২২
  • ৯৩ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী শর্মীলা সাহার পেশাগত চূড়ান্ত পরীক্ষা (ফাইনাল প্রফ) ৩০ মে। এই পরীক্ষার জন্যই গত শনিবার বাবা-মা আর ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জে বাড়িতে যেতে রাজি হননি। অথচ শর্মীলা এখন গোপালগঞ্জের সেই বাড়িতেই। সেদিন বাড়ি যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বাবা–মা আর ভাইয়ের শ্রাদ্ধের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করছেন।
এই পরিস্থিতিতে শর্মীলার সঙ্গে সংবাদমাধ্যম সরাসরি কথা বলেনি। তাঁর পিসামশাই (ফুপা) ইন্দ্রজিৎ সাহার পাঠানো এক ছবিতে দেখা যায়, গতকাল মঙ্গলবার গম্ভীর মুখে বসে শ্রাদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা পালন করছেন শর্মীলা। ইন্দ্রজিৎ সাহা মুঠোফোনে বললেন, ‘মেয়ে একেবারে একলা হয়ে গেল। সেদিন পরীক্ষার জন্যই মেয়ে বাবার সঙ্গে বাড়ি যেতে চায়নি। মেয়ের পাশে এখন আমরা সবাই আছি। পরীক্ষা পর্যন্ত পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য শর্মীলার সঙ্গেই থাকবেন। ও ওর নিজের বাসায় থাকবে না আমাদের কারও সঙ্গে থাকবে, একসময় তো এ সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। আমরা শুধু ভাবছি ও যখন একা হয়ে পড়বে তখন কীভাবে সামলাবে নিজেকে। আমরাই তো পরিস্থিতি মানতে পারছি না। চোখের সামনে তিন-তিনটা মানুষ নাই হয়ে গেছেন। সুখী পরিবারটি ভেঙে গেল।’
স্বাভাবিক মৃত্যু না হয়ে অপমৃত্যু হয়েছে বলে মৃত্যুর চতুর্থ দিনে আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হচ্ছে। শ্রাদ্ধের আগে এক পোস্টে শর্মীলা তাঁর ফেসবুকে বাবা, মা ও ভাইয়ের আত্মার শান্তি কামনা করে অনুষ্ঠিত শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে সবাইকে অংশগ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছেন। সবাই তাঁর বাবা, মা ও ভাইয়ের আত্মার শান্তি কামনা করবেন, শুধু সেটুকুই চেয়েছেন শর্মীলা।
ইন্দ্রজিৎ জানালেন, বাসুদেবের ছোট ভাই রাজীব সাহা বাসুদেবের মুখাগ্নি করাসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন। আজ সামাজিক অ্যাপ্যায়ন বা অন্যান্য কিছু না করে শুধু ধর্মীয়ভাবে যেটুকু পালন করা জরুরি, সেটুকুই করছেন পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা দ্রুত শর্মীলাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরতে চাচ্ছেন, যাতে করে শর্মীলা পরীক্ষাটা দিতে পারেন।
গত শনিবার প্রায় ৭৮ বছর বয়সী মা শিখা রানী সাহাকে দেখতে যেতে চেয়েছিলেন চিকিৎসক বাসুদেব সাহা। মাকে দেখতে যাওয়ার সময় ব্যক্তিগত গাড়িতে বাসুদেব তাঁর স্ত্রী শিবানী সাহা (৪৮) ও ছেলে আহ্ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী স্বপ্নীল সাহাকেও (১৯) সঙ্গে নিয়েছিলেন। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দক্ষিণ ফুকরা ইউনিয়নের দক্ষিণ ফুকরা এলাকায় যাত্রীবাহী বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে বাসুদেব সাহা, তাঁর স্ত্রী, ছেলে, তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ির চালক আজিজুর ইসলামসহ (৪৪) মোট ৯ জন নিহত হন। আহত হন ৩০ জন।
ইন্দ্রজিৎ সাহা জানালেন, বাসুদেব সাহার মা শিখা রানী সাহাকে এখনো ছেলে ও ছেলের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর সংবাদ জানানো হয়নি। তাই শ্রাদ্ধের আনুষ্ঠানিকতায় বাড়তি সতর্কতা বজায় রাখতে হচ্ছে। বাড়িতে মানুষের উপস্থিতি দেখে কয়েকবার জানতেও চেয়েছেন বাড়িতে কী হয়েছে। অসুস্থতার জন্য শিখা রানী সাহার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে রাখতে হচ্ছে। বাসুদেব সাহার বাবা প্রফুল্ল কুমার সাহাকে প্রথম দিনই ঘটনার কথা জানানো হয়েছে।
সেদিন দুর্ঘটনার পর শর্মীলা সাহাই পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতেই বিকট শব্দ শুনেছেন, তারপর থেকেই বাবা, মা, ভাই এমনকি গাড়ির চালকও ফোন ধরছেন না। তারপর পরিবারের সদস্যরা খবর নিয়ে দুর্ঘটনার কথা জানতে পারেন।
বাসুদেব সাহা ছিলেন বারডেম হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৩১তম ব্যাচে তিনি এমবিবিএস পাস করেন। তাঁরা আট ভাই-বোন। ২৬ বছরের বিবাহিত জীবন ছিল তাঁর। এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা ছিলেন। পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জে ‘ডাক্তার বাসু’ নামে সুপরিচিত ছিলেন।
ইন্দ্রজিৎ সাহা বলেন, সম্পর্কে আত্মীয় হলেও বাসুদেব সাহার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। শুধু পারিবারিক জীবন নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়েই তাঁরা দীর্ঘক্ষণ কথা বলতেন। বাসুদেবের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়ি যাওয়ার দিনও ইন্দ্রজিৎ বলেছিলেন, এলাকার রাস্তাঘাট অনেক উন্নত হয়েছে। বাসুদেব যাতে ছবি তোলেন ও ভিডিও করেন। গোপালগঞ্জে আসার পথে ফেরিতে নদী পার হওয়ার সময় পদ্মা সেতুর ছবিসহ স্ত্রী, ছেলের সঙ্গে সেলফি তোলেন বাসুদেব। ফেসবুকেও পোস্ট করেছিলেন।
ইন্দ্রজিৎ সাহা বললেন, ‘সেদিন কথা বলার সময় বাসুদেব আমাকেও বলেছিলেন বাড়ি পৌঁছাতে আর বেশি সময় লাগবে না। তবে সেই বাড়ি আর তাঁর ফেরা হলো না।’
১৪ মে এ ঘটনায় ভাটিয়াপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক (নিরস্ত্র) সিরাজুল ইসলাম বাদী হয়ে রাজিব পরিবহনের বাসটির (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৪৯৬০) চালকের নাম উল্লেখ করে কাশিয়ানী থানায় সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করেন। ১৬ মে বাসচালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইন্দ্রজিৎ সাহা বলেন, এ এলাকায় আগেও দুর্ঘটনা ঘটেছে। হাইওয়ের মতো ব্যস্ত সড়কে ধান শুকানো, যন্ত্র বসিয়ে ধান মাড়াই করা সবই চলে। নসিমন, ভ্যানের মতো ছোট যানবাহনের পাশাপাশি চলে বড় বাস ও যানবাহন। কোনো শৃঙ্খলা নেই হাইওয়েতে। সরকার এদিকটাতে নজর না দিলে এ ধরনের দুর্ঘটনা আরও ঘটবে। আর শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন, এর যন্ত্রণা কতটুকু।
ইন্দ্রজিৎ জানালেন, বাসুদেবের পরিবারে দুর্ঘটনা লেগেই আছে। দুই থেকে আড়াই মাস আগে দেশের বাইরে ফ্লোরিডায় থাকা বাসুদেবের এক ভাই ও তাঁর স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। তাঁরা বাঁচবেন, এ আশা সবাই ছেড়েই দিয়েছিল। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় তাঁরা বেঁচে যান। ছেলে ও ছেলের বউয়ের দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরই মূলত বাসুদেবের মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই তাঁকে তাঁর আরেক ছেলের পরিবারের তিনজন সদস্য মারা গেছেন, তা জানানো হচ্ছে না।
বাসুদেবের ব্যক্তিগত গাড়িচালকের পরিবারের সদস্যদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন খরচের জন্য টাকাপয়সা দেওয়া হয়েছে বলেও জানালেন ইন্দ্রজিৎ।
বাসুদেব সাহার তরুণ ছেলে স্বপ্নীল সাহা ২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একজনের কাছ থেকে কপি বা ধার করা একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তাঁর ফেসবুকে। তাতে লেখা ছিল, ‘আপনার জীবনে এমন সময় কখনোই না আসুক যখন আপনার বাবা-মা আপনার একটা ছবি নিয়ে মর্গে কান্না করতে করতে আপনাকে খুঁজবেন। আপনাকে না পেয়ে আপনার দেহের একটা অংশ হলেও যেন তুলে দেওয়া হয় তাঁর বুকে। শেষবারের মতো আদর করতে চাওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়তে যেন না হয় আপনার মাকে।…যখন দরজার এ প্রান্তে অপেক্ষা করছেন আপনার বাবার জন্য, যিনি আপনাকে খাওয়াবেন বলে বিরিয়ানি হাতে ফেরার কথা, অথচ তিনি শুয়ে আছেন চোখ মেলে রাস্তার ধারে।…আপনি যে কথা দিয়েছিলেন মৃত্যুর আগপর্যন্ত একসঙ্গে থাকার। আপনার জীবনে এই সময়গুলো কখনোই না আসুক যখন আপনার প্রিয় মানুষগুলো একে একে হারাবেন অসহনীয় কিছু নির্মম মৃত্যুর কাছে শুধু এই শহরের মানুষগুলোর অবহেলার কারণে।’
ইন্দ্রজিৎ সাহা বললেন, ‘বাসুদেব সাহা ও তাঁর স্ত্রী জীবনের এমন একটি সময়ে এসে পৌঁছেলেন যখন তাঁদের মেয়ে চিকিৎসক হতে যাচ্ছে আর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। অথচ তাঁরা কিছুই দেখে যেতে পারলেন না।’

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

একসঙ্গে বাবা-মা ও ভাইয়ের শ্রাদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা করতে হলো শর্মীলাকে

আপডেট সময় : ০১:৪৫:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ মে ২০২২

প্রত্যাশা ডেস্ক : স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী শর্মীলা সাহার পেশাগত চূড়ান্ত পরীক্ষা (ফাইনাল প্রফ) ৩০ মে। এই পরীক্ষার জন্যই গত শনিবার বাবা-মা আর ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জে বাড়িতে যেতে রাজি হননি। অথচ শর্মীলা এখন গোপালগঞ্জের সেই বাড়িতেই। সেদিন বাড়ি যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বাবা–মা আর ভাইয়ের শ্রাদ্ধের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করছেন।
এই পরিস্থিতিতে শর্মীলার সঙ্গে সংবাদমাধ্যম সরাসরি কথা বলেনি। তাঁর পিসামশাই (ফুপা) ইন্দ্রজিৎ সাহার পাঠানো এক ছবিতে দেখা যায়, গতকাল মঙ্গলবার গম্ভীর মুখে বসে শ্রাদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা পালন করছেন শর্মীলা। ইন্দ্রজিৎ সাহা মুঠোফোনে বললেন, ‘মেয়ে একেবারে একলা হয়ে গেল। সেদিন পরীক্ষার জন্যই মেয়ে বাবার সঙ্গে বাড়ি যেতে চায়নি। মেয়ের পাশে এখন আমরা সবাই আছি। পরীক্ষা পর্যন্ত পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য শর্মীলার সঙ্গেই থাকবেন। ও ওর নিজের বাসায় থাকবে না আমাদের কারও সঙ্গে থাকবে, একসময় তো এ সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। আমরা শুধু ভাবছি ও যখন একা হয়ে পড়বে তখন কীভাবে সামলাবে নিজেকে। আমরাই তো পরিস্থিতি মানতে পারছি না। চোখের সামনে তিন-তিনটা মানুষ নাই হয়ে গেছেন। সুখী পরিবারটি ভেঙে গেল।’
স্বাভাবিক মৃত্যু না হয়ে অপমৃত্যু হয়েছে বলে মৃত্যুর চতুর্থ দিনে আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হচ্ছে। শ্রাদ্ধের আগে এক পোস্টে শর্মীলা তাঁর ফেসবুকে বাবা, মা ও ভাইয়ের আত্মার শান্তি কামনা করে অনুষ্ঠিত শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে সবাইকে অংশগ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছেন। সবাই তাঁর বাবা, মা ও ভাইয়ের আত্মার শান্তি কামনা করবেন, শুধু সেটুকুই চেয়েছেন শর্মীলা।
ইন্দ্রজিৎ জানালেন, বাসুদেবের ছোট ভাই রাজীব সাহা বাসুদেবের মুখাগ্নি করাসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন। আজ সামাজিক অ্যাপ্যায়ন বা অন্যান্য কিছু না করে শুধু ধর্মীয়ভাবে যেটুকু পালন করা জরুরি, সেটুকুই করছেন পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা দ্রুত শর্মীলাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরতে চাচ্ছেন, যাতে করে শর্মীলা পরীক্ষাটা দিতে পারেন।
গত শনিবার প্রায় ৭৮ বছর বয়সী মা শিখা রানী সাহাকে দেখতে যেতে চেয়েছিলেন চিকিৎসক বাসুদেব সাহা। মাকে দেখতে যাওয়ার সময় ব্যক্তিগত গাড়িতে বাসুদেব তাঁর স্ত্রী শিবানী সাহা (৪৮) ও ছেলে আহ্ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী স্বপ্নীল সাহাকেও (১৯) সঙ্গে নিয়েছিলেন। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দক্ষিণ ফুকরা ইউনিয়নের দক্ষিণ ফুকরা এলাকায় যাত্রীবাহী বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে বাসুদেব সাহা, তাঁর স্ত্রী, ছেলে, তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ির চালক আজিজুর ইসলামসহ (৪৪) মোট ৯ জন নিহত হন। আহত হন ৩০ জন।
ইন্দ্রজিৎ সাহা জানালেন, বাসুদেব সাহার মা শিখা রানী সাহাকে এখনো ছেলে ও ছেলের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর সংবাদ জানানো হয়নি। তাই শ্রাদ্ধের আনুষ্ঠানিকতায় বাড়তি সতর্কতা বজায় রাখতে হচ্ছে। বাড়িতে মানুষের উপস্থিতি দেখে কয়েকবার জানতেও চেয়েছেন বাড়িতে কী হয়েছে। অসুস্থতার জন্য শিখা রানী সাহার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে রাখতে হচ্ছে। বাসুদেব সাহার বাবা প্রফুল্ল কুমার সাহাকে প্রথম দিনই ঘটনার কথা জানানো হয়েছে।
সেদিন দুর্ঘটনার পর শর্মীলা সাহাই পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতেই বিকট শব্দ শুনেছেন, তারপর থেকেই বাবা, মা, ভাই এমনকি গাড়ির চালকও ফোন ধরছেন না। তারপর পরিবারের সদস্যরা খবর নিয়ে দুর্ঘটনার কথা জানতে পারেন।
বাসুদেব সাহা ছিলেন বারডেম হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৩১তম ব্যাচে তিনি এমবিবিএস পাস করেন। তাঁরা আট ভাই-বোন। ২৬ বছরের বিবাহিত জীবন ছিল তাঁর। এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা ছিলেন। পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জে ‘ডাক্তার বাসু’ নামে সুপরিচিত ছিলেন।
ইন্দ্রজিৎ সাহা বলেন, সম্পর্কে আত্মীয় হলেও বাসুদেব সাহার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। শুধু পারিবারিক জীবন নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়েই তাঁরা দীর্ঘক্ষণ কথা বলতেন। বাসুদেবের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়ি যাওয়ার দিনও ইন্দ্রজিৎ বলেছিলেন, এলাকার রাস্তাঘাট অনেক উন্নত হয়েছে। বাসুদেব যাতে ছবি তোলেন ও ভিডিও করেন। গোপালগঞ্জে আসার পথে ফেরিতে নদী পার হওয়ার সময় পদ্মা সেতুর ছবিসহ স্ত্রী, ছেলের সঙ্গে সেলফি তোলেন বাসুদেব। ফেসবুকেও পোস্ট করেছিলেন।
ইন্দ্রজিৎ সাহা বললেন, ‘সেদিন কথা বলার সময় বাসুদেব আমাকেও বলেছিলেন বাড়ি পৌঁছাতে আর বেশি সময় লাগবে না। তবে সেই বাড়ি আর তাঁর ফেরা হলো না।’
১৪ মে এ ঘটনায় ভাটিয়াপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক (নিরস্ত্র) সিরাজুল ইসলাম বাদী হয়ে রাজিব পরিবহনের বাসটির (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৪৯৬০) চালকের নাম উল্লেখ করে কাশিয়ানী থানায় সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করেন। ১৬ মে বাসচালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইন্দ্রজিৎ সাহা বলেন, এ এলাকায় আগেও দুর্ঘটনা ঘটেছে। হাইওয়ের মতো ব্যস্ত সড়কে ধান শুকানো, যন্ত্র বসিয়ে ধান মাড়াই করা সবই চলে। নসিমন, ভ্যানের মতো ছোট যানবাহনের পাশাপাশি চলে বড় বাস ও যানবাহন। কোনো শৃঙ্খলা নেই হাইওয়েতে। সরকার এদিকটাতে নজর না দিলে এ ধরনের দুর্ঘটনা আরও ঘটবে। আর শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন, এর যন্ত্রণা কতটুকু।
ইন্দ্রজিৎ জানালেন, বাসুদেবের পরিবারে দুর্ঘটনা লেগেই আছে। দুই থেকে আড়াই মাস আগে দেশের বাইরে ফ্লোরিডায় থাকা বাসুদেবের এক ভাই ও তাঁর স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। তাঁরা বাঁচবেন, এ আশা সবাই ছেড়েই দিয়েছিল। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় তাঁরা বেঁচে যান। ছেলে ও ছেলের বউয়ের দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরই মূলত বাসুদেবের মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই তাঁকে তাঁর আরেক ছেলের পরিবারের তিনজন সদস্য মারা গেছেন, তা জানানো হচ্ছে না।
বাসুদেবের ব্যক্তিগত গাড়িচালকের পরিবারের সদস্যদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন খরচের জন্য টাকাপয়সা দেওয়া হয়েছে বলেও জানালেন ইন্দ্রজিৎ।
বাসুদেব সাহার তরুণ ছেলে স্বপ্নীল সাহা ২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একজনের কাছ থেকে কপি বা ধার করা একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তাঁর ফেসবুকে। তাতে লেখা ছিল, ‘আপনার জীবনে এমন সময় কখনোই না আসুক যখন আপনার বাবা-মা আপনার একটা ছবি নিয়ে মর্গে কান্না করতে করতে আপনাকে খুঁজবেন। আপনাকে না পেয়ে আপনার দেহের একটা অংশ হলেও যেন তুলে দেওয়া হয় তাঁর বুকে। শেষবারের মতো আদর করতে চাওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়তে যেন না হয় আপনার মাকে।…যখন দরজার এ প্রান্তে অপেক্ষা করছেন আপনার বাবার জন্য, যিনি আপনাকে খাওয়াবেন বলে বিরিয়ানি হাতে ফেরার কথা, অথচ তিনি শুয়ে আছেন চোখ মেলে রাস্তার ধারে।…আপনি যে কথা দিয়েছিলেন মৃত্যুর আগপর্যন্ত একসঙ্গে থাকার। আপনার জীবনে এই সময়গুলো কখনোই না আসুক যখন আপনার প্রিয় মানুষগুলো একে একে হারাবেন অসহনীয় কিছু নির্মম মৃত্যুর কাছে শুধু এই শহরের মানুষগুলোর অবহেলার কারণে।’
ইন্দ্রজিৎ সাহা বললেন, ‘বাসুদেব সাহা ও তাঁর স্ত্রী জীবনের এমন একটি সময়ে এসে পৌঁছেলেন যখন তাঁদের মেয়ে চিকিৎসক হতে যাচ্ছে আর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। অথচ তাঁরা কিছুই দেখে যেতে পারলেন না।’