ঢাকা ০৫:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একজন নাজমা মমতাজ ও তাঁর ছাদ বাগান

  • আপডেট সময় : ০৯:০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • ১৩৩ বার পড়া হয়েছে

বারী সুমন :”আমি নিজের ডিপ্রেশন নিয়ে ভাবি কখন,
আমাকে ভাবতে হয় আমার কোনো গাছ
ডিপ্রেশনে ভুগছে কিনা!”

কথাটি শুনে খুবই অবাক লাগছে হয়তো। কিন্তু হ্যাঁ, এটাই সত্যি কথা। আর কথাটি বলেছিলেন ঈশ্বরগঞ্জের কৃতি সন্তান, গবেষক, প্রাবন্ধিক, আলোচক, সমালোচক এপার উপার দুই বাংলার প্রখ্যাত আলোচক কবি নাজমা মমতাজ। বাবা এম.এ মালেক ও মা- জোবেদা আক্তার। বাবা আদর করে নাম রাখেন নাজমা মমতাজ। কিন্তু কে জানতো সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি একদিন এতো বড় হবে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়। স্কুল জীবন থেকেই মূলত লেখালেখির শুরু। সাহিত্যের আঙিনায় প্রবেশ করেন ছড়া দিয়ে। বাংলা একাডেমির এই খ্যাতিমান লেখক পেশায় একটি মাদ্রাসার বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। দেশ ছাড়িয়ে দেশের বাইরেও এই লেখকের অবাধ বিচরণ। কলকতা বিশ্বভারতীতে তিনি বেশ কয়েকবার প্রবন্ধ উপস্থান করেন। লেখক জগতে তিনি একজন গুণী লেখক। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ। ভ্রমণ কাহিনী জাতীয় উপন্যাস “দেশ-দেশান্তর”, এবং “গীতিকার জগত এবং জীবন” উল্লেখযোগ্য। এ বইয়ে স্থান পেয়েছে “মৈমনসিংহ গীতিকা” এবং “পূর্ব বঙ্গ গীতিকা” নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় লেখা সমৃদ্ধ কিছু প্রবন্ধ। এছাড়াও লেখকের আরও কয়েকটি বই প্রকাশ পেতে যাচ্ছে, “ঝরা পাতার গল্প”; “কটা চাঁদ নেবে” ; “ছড়ায় ছড়ায় ঈশপের গল্প” ; তাঁর মৌলিক ছড়াগ্রন্থ “চামচা” প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।
লেখক নাজমা মমতাজ বাস্তব জীবনে একজন চমৎকার মানুষ। খুবই সাদা-সিধে, সহজ সরল জীবন যাপন করেন। কিন্তু জানার পরিধি ব্যাপক। তাঁর জানার জগতে যদি কেউ প্রবেশ করার মতো সাধ্য রাখে তবে তিনি বুঝতে পারবেন নাজমা মমতাজের জ্ঞানের পরিধি কতটা বিস্তৃত। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যে শাখায় তিনি প্রবেশ করেন নি। মানুষের সাথে খুব সাবলীলভাবে কথা বলেন এই কবি। যারা কবির সান্নিধ্য লাভ করতে পারেন নি তারা দূর থেকে হয়তো নাজমা মমতাজকে ঈর্ষা করতে পারেন। আমরা একই উপজেলার বাসিন্দা হিসেবে এই মহান কবির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছে। যখনই অবসর পাই এবং কবির অবসর সময়ে চলে যাই কবির বাসায়। বয়সের দিক থেকে অনেক সিনিয়র থাকলেও যখন আমরা কথা বলি তখন বয়সটা আর তফাৎ থাকেনা। ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা হয় সাহিত্য নিয়ে। যখনই সময় পান নাড়ীর টানে চলে যান গ্রামের বাড়িতে। আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলেন, তাদের খোঁজ খবর নেন। কখনও প্রবীণদের কাছ থেকে ঐ এলাকার পুরাতন কোন ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন।
এসব কিছুর বাহিরেও নাজমা মমতাজের আরো একটি জীবন আছে।আছে সে জীবনের অনেক পার্ট।তন্মধ্যে একটি হলো তাঁর সযতেœ তৈরি করা ছাদ বাগান। হয়তো অনেকেই নাজমা মমতাজের ছাদ বাগান সম্পর্কে জানেনই না। জানলেও হয়তো আমরা ছাদ বাগান বলতে যা বুঝি কয়েকটি বিভিন্ন গাছের চারা টবে লাগিয়ে রাখা। কিন্তু কবি নাজমা মমতাজের ছাদ বাগানের চিত্রটি সম্পূর্ণই ভিন্ন। সেদিন শুক্রবার বিকেলে আমরা কয়েকজন মিলে যাই কবির সাথে সাহিত্য আড্ডা দিতে এবং ছাদ বাগান দেখার জন্য। নিজ চোখে দেখার আগে আমিও ভাবতাম ছাদবাগান বুঝি মাত্র কয়েকটি গাছ ছাদে লাগানো আছে। আমার ঘরণী লেখালেখির সূত্র ধরে কবির বাসায় গিয়েছেন অনেকবার। আমিও গিয়েছি কিন্তু ছাদে যাওয়া হয়নি। এই প্রথম কবির বাগানে আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছি। কবির রুমের সামনেই রয়েছে বেশ কতগুলো পাতা বাহারের টব। পানির টেপের কাছেও রয়েছে সবুজ গাছ। সিঁড়ির উপরের দিকে কয়েকটি টবে ঝোলানো আছে আরও কয়েক প্রকার পাতাবাহার যা সৌন্দর্য বর্ধন করছে সবসময়। সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা ছাদে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। ছাদের দুপাশেই রয়েছে সারি সারি বিভিন্ন রকমের গাছ। ক্যাকটাস, পাতাবাহার, ফুল-ফল ও সবজি গাছ। ছাদ বাগানে প্রবেশ করতেই হাতের বাম পাশে দেখা পেলাম মাধবী লতার; তার পাশে রয়েছে রঙ্গন। সাথে রাখা আছে চায়না বেম্বো, পাশেই রাখা আছে মাল্টি কালার গোলাপের গাছ। সামনে এগুতেই দেখা মেলে ক্যাকটাসের। কাছাকাছি অনেকগুলো ক্যাকটাস লাগানো। ভিন্ন আকৃতির এবং ভিন্ন ধরণের ফুল দিয়ে শোভা বর্ধন করে যাচ্ছে। কতগুলো ক্যাকটাস আছে যেগুলো এইখানে আমি প্রথম দেখেছি। তার পরে রয়েছে কাঁটা মুকুল, প্রায় বিশ প্রজাতির পাতা বাহার। স্মল স্পাইডার, বিগ স্পাইডার এগুলোও একধরণের পাতা বাহার। বাগানের একপাশ শুধু পাতা বাহার।যাকে বলা চলে পাতা বাহার কর্ণার। পাশে আছে রক্ত জবা, সাদা জবার গাছ। তার সাথে গন্ধরাজ, রয়েছে রায় বেলী এবং কাঠ বেলী। দোলনচাঁপাও রয়েছে এক পাশে। কিছু দিনের মধ্যেই ফুল ফোটার অপেক্ষায়। গুটি রঙ্গণ, চায়না জবা, পর্তুলিকা ও সন্ধ্যামালতীর কয়েকটি প্রজাতি।
এতো গেলো ফুলের কথা এবার আসি ফলের কথায়। হাতের ডান পাশে রয়েছে লিচু, সফেদা, দেশী জামরুল ও গোলাপী রঙের চায়না জামরুল। গাছের গোড়া থেকে প্রতিটি পাতার গোড়ায় গোড়ায় ঝুলে আছে গোলাপী রঙের জামরুল। জামরুলের রুপে পাগল হয়ে আমরা গাছ থেকে জামরুল পেড়ে খেতে লাগলাম। অপূর্ব স্বাদ এবং ঘ্রাণের সম্মিলন।সাথে করে কিছু নিয়েও এলাম। আমের মধ্যে অনেক প্রকারের গাছ। ড্রাম ভর্তি করে মাটিতে লাগানো হয়েছে। আম্রপালি, ফজলি আরও কয়েক প্রকারের আম। ৫-৬ প্রজাতির আমের গাছ দেখতে পেলাম। তার পাশে রয়েছে তেতুল গাছ, আমলকী গাছ, নিম গাছ। পাশেই সুতার মতো চিকন কি যেন ঝোলে আছে। কবি আপাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কি গাছ আপা। আপা জানালেন এটা সাজনা গাছ। সবে মাত্র সাজনা ধরেছে। আমরা অবাক হয়ে গেলাম একটা ছাদ বাগানের মধ্যেও সাজনা গাছ! কবি আপা বললেন, “আরও অনেক গাছ পাবে সামনে যাও”। আমরা এগুতে থাকলাম। জাম্বুরা, পেঁপে, কদবেল, হরিতকী। পাশেই দেখতে পেলাম দেশীয় লটকন গাছ। যা আজ গ্রামের বাড়িতেই খোঁজে পাওয়া যায়না তার দেখা পেলাম কবি নাজমা মমতাজের ছাদ বাগানে। বেশ কয়েকটি পেয়ারা গাছ রয়েছে। যতগুলো মনে রাখতে পেরেছি সেগুলোর নাম লিখলাম। সবজির মধ্যে, কুমড়া, লাউ, কাকরোল, বেগুন, মরিচ ইত্যাদি গাছ দেখতে পেলাম।
ছুটির দিন সকাল বেলা প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে চলে যান ছাদ বাগানে। পরম মমতায় প্রত্যেকটি গাছের পরিচর্যা করেন। বর্তমানে করোনার সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাগানে সময় দেন বেশি। কোন গাছটির কি সমস্যা হলো, পোকা আক্রমণ করেছে নাকি পানি শূন্যতা কিংবা পুষ্টির ঘাটতি সব কিছুরই খোঁজ রাখতে হয় কবিকে। কোন প্রকার কীটনাশক ব্যবহার করেন না। ডিটারজেন্ট পাউডার পানিতে গুলিয়ে স্প্রে করেন গাছে। কোন কোন সময় গাছ বেশি রোগাক্রান্ত হলে নিমপাতা পানিতে জাল করে রস করে সেটা স্প্রে করেন গাছে। কোন প্রকার সার ব্যবহার করেন না। গোবর সার ব্যবহার করেন গাছের গোড়ায়। রয়েছে পানি দেওয়ার জন্য মটরের ব্যবস্থা। ছাদের একপাশে সিঁড়ি কোঠায় পেলাম কোদাল, নিরানি, পেরেক, স্প্রে মেশিন ইত্যাদি। বাগান ঘুরে ছবি তুলে যখন নেমে আসবো তখন আপাকে প্রশ্ন করলাম, আপা এই বন্ধ সময় বাসায় আপনার খারাপ লাগেনা? বা আপনি কি কখনও ডিপ্রেশনে ভুগেন না? তখন আপা উত্তর দিলেন,
“আমি নিজের ডিপ্রেশন নিয়ে ভাবি কখন
আমাকে ভাবতে হয় আমার কোনো গাছ
ডিপ্রেশনে ভুগছে কিনা?”
কথাটা শুনে অবাকই লাগলো। আসলে কতটা গাছ প্রেমী এই কবি। গাছের ডিপ্রেশন নিয়েও ভাবেন তিনি। পরম যতেœ মায়ের মমতা দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলা নাজমা মমতাজের ছাদ বাগান। করোনাকালীন সময়ে আমরা যারা বিভিন্ন ডিপ্রেশনে ভুগছি আসুন আমরাও কবি নাজমা মমতাজ আপার মতো বাগান করি, বাগানে সময় দেই তাহলেই নিজের ডিপ্রেশন নিয়ে ভাবার সময় থাকবেনা, ভাবতে হবে গাছের ডিপ্রেশন নিয়ে, ফলে আমরা থাকবো দুশ্চিন্তামুক্ত। কবি নাজমা মমতাজের ছাদ বাগান সত্যিই সেদিন আমাদের মুগ্ধ করেছে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

একজন নাজমা মমতাজ ও তাঁর ছাদ বাগান

আপডেট সময় : ০৯:০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

বারী সুমন :”আমি নিজের ডিপ্রেশন নিয়ে ভাবি কখন,
আমাকে ভাবতে হয় আমার কোনো গাছ
ডিপ্রেশনে ভুগছে কিনা!”

কথাটি শুনে খুবই অবাক লাগছে হয়তো। কিন্তু হ্যাঁ, এটাই সত্যি কথা। আর কথাটি বলেছিলেন ঈশ্বরগঞ্জের কৃতি সন্তান, গবেষক, প্রাবন্ধিক, আলোচক, সমালোচক এপার উপার দুই বাংলার প্রখ্যাত আলোচক কবি নাজমা মমতাজ। বাবা এম.এ মালেক ও মা- জোবেদা আক্তার। বাবা আদর করে নাম রাখেন নাজমা মমতাজ। কিন্তু কে জানতো সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি একদিন এতো বড় হবে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়। স্কুল জীবন থেকেই মূলত লেখালেখির শুরু। সাহিত্যের আঙিনায় প্রবেশ করেন ছড়া দিয়ে। বাংলা একাডেমির এই খ্যাতিমান লেখক পেশায় একটি মাদ্রাসার বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। দেশ ছাড়িয়ে দেশের বাইরেও এই লেখকের অবাধ বিচরণ। কলকতা বিশ্বভারতীতে তিনি বেশ কয়েকবার প্রবন্ধ উপস্থান করেন। লেখক জগতে তিনি একজন গুণী লেখক। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ। ভ্রমণ কাহিনী জাতীয় উপন্যাস “দেশ-দেশান্তর”, এবং “গীতিকার জগত এবং জীবন” উল্লেখযোগ্য। এ বইয়ে স্থান পেয়েছে “মৈমনসিংহ গীতিকা” এবং “পূর্ব বঙ্গ গীতিকা” নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় লেখা সমৃদ্ধ কিছু প্রবন্ধ। এছাড়াও লেখকের আরও কয়েকটি বই প্রকাশ পেতে যাচ্ছে, “ঝরা পাতার গল্প”; “কটা চাঁদ নেবে” ; “ছড়ায় ছড়ায় ঈশপের গল্প” ; তাঁর মৌলিক ছড়াগ্রন্থ “চামচা” প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।
লেখক নাজমা মমতাজ বাস্তব জীবনে একজন চমৎকার মানুষ। খুবই সাদা-সিধে, সহজ সরল জীবন যাপন করেন। কিন্তু জানার পরিধি ব্যাপক। তাঁর জানার জগতে যদি কেউ প্রবেশ করার মতো সাধ্য রাখে তবে তিনি বুঝতে পারবেন নাজমা মমতাজের জ্ঞানের পরিধি কতটা বিস্তৃত। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যে শাখায় তিনি প্রবেশ করেন নি। মানুষের সাথে খুব সাবলীলভাবে কথা বলেন এই কবি। যারা কবির সান্নিধ্য লাভ করতে পারেন নি তারা দূর থেকে হয়তো নাজমা মমতাজকে ঈর্ষা করতে পারেন। আমরা একই উপজেলার বাসিন্দা হিসেবে এই মহান কবির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছে। যখনই অবসর পাই এবং কবির অবসর সময়ে চলে যাই কবির বাসায়। বয়সের দিক থেকে অনেক সিনিয়র থাকলেও যখন আমরা কথা বলি তখন বয়সটা আর তফাৎ থাকেনা। ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা হয় সাহিত্য নিয়ে। যখনই সময় পান নাড়ীর টানে চলে যান গ্রামের বাড়িতে। আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলেন, তাদের খোঁজ খবর নেন। কখনও প্রবীণদের কাছ থেকে ঐ এলাকার পুরাতন কোন ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন।
এসব কিছুর বাহিরেও নাজমা মমতাজের আরো একটি জীবন আছে।আছে সে জীবনের অনেক পার্ট।তন্মধ্যে একটি হলো তাঁর সযতেœ তৈরি করা ছাদ বাগান। হয়তো অনেকেই নাজমা মমতাজের ছাদ বাগান সম্পর্কে জানেনই না। জানলেও হয়তো আমরা ছাদ বাগান বলতে যা বুঝি কয়েকটি বিভিন্ন গাছের চারা টবে লাগিয়ে রাখা। কিন্তু কবি নাজমা মমতাজের ছাদ বাগানের চিত্রটি সম্পূর্ণই ভিন্ন। সেদিন শুক্রবার বিকেলে আমরা কয়েকজন মিলে যাই কবির সাথে সাহিত্য আড্ডা দিতে এবং ছাদ বাগান দেখার জন্য। নিজ চোখে দেখার আগে আমিও ভাবতাম ছাদবাগান বুঝি মাত্র কয়েকটি গাছ ছাদে লাগানো আছে। আমার ঘরণী লেখালেখির সূত্র ধরে কবির বাসায় গিয়েছেন অনেকবার। আমিও গিয়েছি কিন্তু ছাদে যাওয়া হয়নি। এই প্রথম কবির বাগানে আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছি। কবির রুমের সামনেই রয়েছে বেশ কতগুলো পাতা বাহারের টব। পানির টেপের কাছেও রয়েছে সবুজ গাছ। সিঁড়ির উপরের দিকে কয়েকটি টবে ঝোলানো আছে আরও কয়েক প্রকার পাতাবাহার যা সৌন্দর্য বর্ধন করছে সবসময়। সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা ছাদে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। ছাদের দুপাশেই রয়েছে সারি সারি বিভিন্ন রকমের গাছ। ক্যাকটাস, পাতাবাহার, ফুল-ফল ও সবজি গাছ। ছাদ বাগানে প্রবেশ করতেই হাতের বাম পাশে দেখা পেলাম মাধবী লতার; তার পাশে রয়েছে রঙ্গন। সাথে রাখা আছে চায়না বেম্বো, পাশেই রাখা আছে মাল্টি কালার গোলাপের গাছ। সামনে এগুতেই দেখা মেলে ক্যাকটাসের। কাছাকাছি অনেকগুলো ক্যাকটাস লাগানো। ভিন্ন আকৃতির এবং ভিন্ন ধরণের ফুল দিয়ে শোভা বর্ধন করে যাচ্ছে। কতগুলো ক্যাকটাস আছে যেগুলো এইখানে আমি প্রথম দেখেছি। তার পরে রয়েছে কাঁটা মুকুল, প্রায় বিশ প্রজাতির পাতা বাহার। স্মল স্পাইডার, বিগ স্পাইডার এগুলোও একধরণের পাতা বাহার। বাগানের একপাশ শুধু পাতা বাহার।যাকে বলা চলে পাতা বাহার কর্ণার। পাশে আছে রক্ত জবা, সাদা জবার গাছ। তার সাথে গন্ধরাজ, রয়েছে রায় বেলী এবং কাঠ বেলী। দোলনচাঁপাও রয়েছে এক পাশে। কিছু দিনের মধ্যেই ফুল ফোটার অপেক্ষায়। গুটি রঙ্গণ, চায়না জবা, পর্তুলিকা ও সন্ধ্যামালতীর কয়েকটি প্রজাতি।
এতো গেলো ফুলের কথা এবার আসি ফলের কথায়। হাতের ডান পাশে রয়েছে লিচু, সফেদা, দেশী জামরুল ও গোলাপী রঙের চায়না জামরুল। গাছের গোড়া থেকে প্রতিটি পাতার গোড়ায় গোড়ায় ঝুলে আছে গোলাপী রঙের জামরুল। জামরুলের রুপে পাগল হয়ে আমরা গাছ থেকে জামরুল পেড়ে খেতে লাগলাম। অপূর্ব স্বাদ এবং ঘ্রাণের সম্মিলন।সাথে করে কিছু নিয়েও এলাম। আমের মধ্যে অনেক প্রকারের গাছ। ড্রাম ভর্তি করে মাটিতে লাগানো হয়েছে। আম্রপালি, ফজলি আরও কয়েক প্রকারের আম। ৫-৬ প্রজাতির আমের গাছ দেখতে পেলাম। তার পাশে রয়েছে তেতুল গাছ, আমলকী গাছ, নিম গাছ। পাশেই সুতার মতো চিকন কি যেন ঝোলে আছে। কবি আপাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কি গাছ আপা। আপা জানালেন এটা সাজনা গাছ। সবে মাত্র সাজনা ধরেছে। আমরা অবাক হয়ে গেলাম একটা ছাদ বাগানের মধ্যেও সাজনা গাছ! কবি আপা বললেন, “আরও অনেক গাছ পাবে সামনে যাও”। আমরা এগুতে থাকলাম। জাম্বুরা, পেঁপে, কদবেল, হরিতকী। পাশেই দেখতে পেলাম দেশীয় লটকন গাছ। যা আজ গ্রামের বাড়িতেই খোঁজে পাওয়া যায়না তার দেখা পেলাম কবি নাজমা মমতাজের ছাদ বাগানে। বেশ কয়েকটি পেয়ারা গাছ রয়েছে। যতগুলো মনে রাখতে পেরেছি সেগুলোর নাম লিখলাম। সবজির মধ্যে, কুমড়া, লাউ, কাকরোল, বেগুন, মরিচ ইত্যাদি গাছ দেখতে পেলাম।
ছুটির দিন সকাল বেলা প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে চলে যান ছাদ বাগানে। পরম মমতায় প্রত্যেকটি গাছের পরিচর্যা করেন। বর্তমানে করোনার সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাগানে সময় দেন বেশি। কোন গাছটির কি সমস্যা হলো, পোকা আক্রমণ করেছে নাকি পানি শূন্যতা কিংবা পুষ্টির ঘাটতি সব কিছুরই খোঁজ রাখতে হয় কবিকে। কোন প্রকার কীটনাশক ব্যবহার করেন না। ডিটারজেন্ট পাউডার পানিতে গুলিয়ে স্প্রে করেন গাছে। কোন কোন সময় গাছ বেশি রোগাক্রান্ত হলে নিমপাতা পানিতে জাল করে রস করে সেটা স্প্রে করেন গাছে। কোন প্রকার সার ব্যবহার করেন না। গোবর সার ব্যবহার করেন গাছের গোড়ায়। রয়েছে পানি দেওয়ার জন্য মটরের ব্যবস্থা। ছাদের একপাশে সিঁড়ি কোঠায় পেলাম কোদাল, নিরানি, পেরেক, স্প্রে মেশিন ইত্যাদি। বাগান ঘুরে ছবি তুলে যখন নেমে আসবো তখন আপাকে প্রশ্ন করলাম, আপা এই বন্ধ সময় বাসায় আপনার খারাপ লাগেনা? বা আপনি কি কখনও ডিপ্রেশনে ভুগেন না? তখন আপা উত্তর দিলেন,
“আমি নিজের ডিপ্রেশন নিয়ে ভাবি কখন
আমাকে ভাবতে হয় আমার কোনো গাছ
ডিপ্রেশনে ভুগছে কিনা?”
কথাটা শুনে অবাকই লাগলো। আসলে কতটা গাছ প্রেমী এই কবি। গাছের ডিপ্রেশন নিয়েও ভাবেন তিনি। পরম যতেœ মায়ের মমতা দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলা নাজমা মমতাজের ছাদ বাগান। করোনাকালীন সময়ে আমরা যারা বিভিন্ন ডিপ্রেশনে ভুগছি আসুন আমরাও কবি নাজমা মমতাজ আপার মতো বাগান করি, বাগানে সময় দেই তাহলেই নিজের ডিপ্রেশন নিয়ে ভাবার সময় থাকবেনা, ভাবতে হবে গাছের ডিপ্রেশন নিয়ে, ফলে আমরা থাকবো দুশ্চিন্তামুক্ত। কবি নাজমা মমতাজের ছাদ বাগান সত্যিই সেদিন আমাদের মুগ্ধ করেছে।