সুখদেব কুমার সানা : শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত’র চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ৩০ মে শনিবার সকাল সাতটা নাগাদ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ওইদিন বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকার বনানী কবরস্থানে তাঁর মায়ের কবরে দাফন করা হয় এই দেশপ্রেমিক সৃজনশীল কর্মবীরকে।
শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (প্রা.) লি. এবং শান্তনিবাসের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানও মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত। এছাড়া জাতীয় দৈনিক আজকের প্রত্যাশা’র সম্পাদকও ছিলেন তিনি। চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইমামুল কবীর শান্তকে।
মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশমাতৃকার এই কৃতিসন্তানকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাতে শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (প্রা.) লিমিটেড, দৈনিক আজকের প্রত্যাশাসহ সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
জন্ম ও কর্ম ইতিহাস: ১৯৫৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন মা মাটি ও মানুষের সেবায় নিবেদিত মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত। শিক্ষাজীবন শুরু করেন তেজগাঁও মিশনারি স্কুলে, যা গির্জা স্কুল নামে পরিচিত। রেললাইন ধরে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বস্তির দুপাশে অসহায় মানুষ ও এতিম সহপাঠীদের দেখে তাঁর মনে জেগে উঠে মমত্ববোধ ও প্রশ্নÑমানুষ কেন গরিব? কী এর সমাধান? অষ্টম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় মহান বিপ্লবী চে’গুয়েভারার আত্মজীবনী পড়ে বুঝেছিলেন, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ধনী-গরিবের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব। তাই তিনি গরিব মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বাম ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান যে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন, তার উদ্দেশ্য শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়; সাথে বৈষম্য দূর করে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের মাধ্যমে গুণগতমানসম্পন্ন জাতি গঠন করে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা। তাই গরিব মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে উদ্ধুদ্ধ হয়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফেরার পথে এক মর্মান্তিক নৌকাডুবিতে তাঁর ৩ জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুসহ এগারোজন সহযোদ্ধা শহীদ হন। যা তাঁর মনে নিদারুন রেখাপাত করে। এ ঘটনা তাঁর জীবনে কষ্টের অন্যতম কারণ ছিল। তিনি উপলব্ধি করেন-তাঁর যুদ্ধ শেষ হয়নি। জননী ও জন্মভূমির প্রতি তাঁর দায়িত্বকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তাঁর আর বাড়ি ফেরা হয়নি। মা বলতেন-যুদ্ধ শেষে সবার ছেলে বাড়ি ফিরলেও তুমি তো এখনো বাড়ি ফিরে আসলে না। মায়ের কথা শুনে তিনি মাকে বলেছিলেন, ‘মা আমার যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। যুদ্ধ শেষ হলে ফিরে আসবো।’ তাই তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার শান্তি, তাঁদের মূল্যায়ন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য স্বাধীনতার পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাথে কাজ করতে থাকেন এবং একইসাথে যুব সমাজের উন্নয়নের জন্য ‘জাতীয় যুব কল্যাণ সংস্থা’ গঠনে সম্পৃক্ত থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুললে সেখানে এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রথম যে প্রতিবাদ হয়, সেই প্রতিবাদে জনাব শান্ত সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এর ফলে তৎকালীন সামরিক সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংঘটিত বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও সংঘাতেও তিনি জড়িয়ে পড়েন, যা দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে রূপ নেয়। ফলে তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সেই সময় সামরিক সরকারের প্রচণ্ড চাপ ও হুমকির মুখে এক পর্যায়ে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে উপায়ান্ত না দেখে ক্ষুব্ধ ও ভারাক্রান্ত মনে তাঁর কয়েকজন সঙ্গীসহ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। উড়োজাহাজে বসে অনেক কেঁদেছিলেন আর ভেবেছিলেন-কেন তাঁকে স্বদেশ ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে! তিনি মনে মনে সংকল্প করেনÑএ দুর্ভাগা দেশে আর কখনো ফিরবেন না।
এক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশ ঘুরে তিনি জার্মানিতে পৌঁছে জার্মানদের দেখে অভিভূত হন। তারা যোদ্ধা জাতি, দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়েও কঠোর শ্রম, সঠিক কর্মমুখী শিক্ষা ও নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ আর অবিচল আস্থার কারণে আজও তারা মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে দাঁড়িয়ে আছে উন্নত জাতি হিসেবে। তা দেখে জনাব শান্ত অনুধাবন করেন-মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, বরং প্রয়োজন সঠিক কর্মমুখী শিক্ষা। সাথে মানবীয় গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে প্রয়োজন নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি অবিচল আস্থা; যা সাংস্কৃতিক শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। তিনি আরও অনুধাবন করেন, আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষা না থাকায় ডিগ্রি কালচারের মাধ্যমে জাতি ক্রমশ অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একইসাথে মাদ্রাসা শিক্ষায় কর্মমুখী শিক্ষা না থাকায় শিক্ষার্থীরা কর্মসংস্থান না পেয়ে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী মহলের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই অবস্থা উত্তরণের জন্য তিনি ভাবেন-যেহেতু আমাদের রয়েছে সৃজনশীল ও মেধাসম্পন্ন অগণিত মানুষ; তাই যদি জার্মানির অনুরূপ কর্মমুখী, সৃজনশীল, সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও দূরশিক্ষণ/অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে পারি; একইসাথে আমাদের আছে অব্যবহৃত অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, সুসংযুক্ত ভৌগোলিক অবস্থান, উর্বর মাটি এবং মাটির নিচের খনিজ সম্পদসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, এর রয়েছে প্রচুর পর্যটন সম্ভাবনা, এই সম্ভাবনা ও সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলেই স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। দূরদর্শিসম্পন্ন শান্ত অনুধাবন করেন, ছোটবেলা থেকে তাঁর মনে যে প্রশ্ন জেগেছিল-মানুষ কেন গরিব এবং কী এর সমাধান? এ প্রশ্নের উত্তর ও সমাধান এরই মাধ্যমে আসতে পারে। সে সময় মাদার তেরেসার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন এবং ‘মানুষ মানুষের জন্য’Ñএই দর্শনের প্রেরণায় মানবকল্যাণে আত্মনিবেদনের আকাক্সক্ষা তাঁর মনে সুদৃঢ় হয়। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে, তাঁর মনের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতার সুফল গরিব মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে, শহিদ সহযোদ্ধা ও বন্ধুদের আত্মার শান্তির জন্য এবং এদেশে জার্মানির অনুরূপ বাংলাদেশ উপযোগী শিক্ষার একটি মডেল তৈরির জন্য, শুধু মানবকল্যাণে কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে দেশে না ফেরার সিদ্ধান্ত পরিহার করে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন।
দেশে ফিরে বুঝতে পারেন, এ ধরনের কাজের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। শুরু করেন ব্যবসা। প্রতিষ্ঠা করেন দেশের প্রথম ও দ্রুততম কুরিয়ার সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (প্রাঃ) লিমিটেড। প্রসঙ্গত, একসময় এদেশে শুধু বিমান রুটে এয়ার এক্সপ্রেস সার্ভিসের প্রচলন ছিলো। এ সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এয়ার এক্সপ্রেস সার্ভিসকে শুধু বিমান রুটে নয়, সারাদেশে বিভিন্ন পরিবহন মাধ্যম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সেবা প্রদান করে ব্যাপকভাবে আস্থা অর্জন করেছে।
১৯৯২ সালে সরকারের ডাক বিভাগ কুরিয়ার সেবাখাতকে বন্ধ করে দেয়ার জন্য বিভিন্ন অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে কুরিয়ার কোম্পানিগুলোকে সংগঠিত করে তিনি ‘কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ গঠন করেন এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কুরিয়ার সার্ভিসের জন্য নিময়নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে লাইসেন্সিং অথরিটি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতার মাধ্যমে কুরিয়ার খাতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সক্ষম হন। বাংলাদেশে আজ শত শত কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, যার ফলে এ সেবাখাত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ডাক ও টেলি যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ‘লিজেন্ড অব কুরিয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে মোঃ ইমামুল কবীর শান্তকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের অবহেলিত ও অব্যবহৃত পণ্য যেমন কাঁকড়া ও ঈলফিস (কুইচ্চা) বিশ্ববাজারে রপ্তানি করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত। এ সেক্টরকে বন্ধ করে দেয়ার জন্য ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় বিভিন্নভাবে অপচেষ্টা চালায়। সেইসময় তিনি এ সেক্টরের ব্যবসায়ীদের সংগঠিত করে ‘বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিল্ড ফুড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে সেক্টরটিকেও একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যার ফলে দেশে হাজার হাজার ছোট-বড় খামার তৈরি হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ কৃষক জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হচ্ছে।
স্বপ্ন পূরণে সর্বোচ্চ ত্যাগ ও অগ্রগতি: বাংলাদেশে এসেছে ভৌগোলিক স্বাধীনতা, আসেনি পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক মুক্তি, হয়নি ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ। তাই এই অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁর ওই সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে এবং নিজে সন্তান-সন্ততি না নিয়ে জীবনের সমস্ত শ্রম ও মেধা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। জনাব শান্ত স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন-এর চারটি মূল কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেন। ১. আমাদের মানব সম্পদের সঠিক ব্যবহার ২. প্রাকৃতিক সম্পদের যথার্থ ব্যবহার ৩. দূরশিক্ষণ/অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপক প্রসার এবং ৪. সাংস্কৃতিক শিক্ষার বিকাশ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত মনে করেন ৪টি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলেই দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমনকি রাজনৈতিক সমস্যারও সমাধান অনেকাংশে সম্ভব হবে। এই চারটি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে কর্মমুখী, ডিজাইন ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার জন্যে স্থায়ী শিক্ষা কমপ্লেক্স ‘শান্ত-মারিয়াম ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’ নির্মাণের লক্ষ্যে প্রথমে ১৯৯৪ সালে গাজীপুরের সিনাবহে চল্লিশ বিঘা জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শান্ত-নিকেতন’। সেখানে সমাজের অসহায়, এতিম, দরিদ্র, জেলখানা ও পতিতালয়ের অবহেলিত শিশু-কিশোরদের কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করতে আবাসনসহ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং একইসাথে বয়োবৃদ্ধ অসহায় মানুষকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ‘বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন, যার উন্নয়নের অনেক কাজ হয়েছে এবং অব্যাহত। সেখানে একটি সুন্দর সুবিশাল মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।
এছাড়াও ঢাকার উত্তরখানের শ্যামলবাগে গড়ে তোলা হয়েছে ‘শান্ত-নিকেতন’-এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘শান্ত-নিবাস’। যেখানে সমাজের অসহায়, এতিম, দরিদ্র ও অবহেলিত শিশু-কিশোরদের ‘শান্ত-মারিয়াম স্কুল অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’তে আবাসনসহ শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও শান্ত-নিবাসে শান্ত-মারিয়াম ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, শান্ত-মারিয়াম একাডেমি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি ও শান্ত-মারিয়াম ইন্সটিটিউট অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হয়েছে।
পরবর্তী কার্যক্রম হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘শান্ত-মারিয়াম একাডেমি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি। যেখানে কর্মমুখী শিক্ষার জন্য বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কোর্স, দূরশিক্ষণ/অনলাইন শিক্ষার জন্য বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স এবং ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি শিক্ষা প্রদানের জন্য সিঙ্গাপুরের পালিন স্কুল অব ডিজাইন-এর বিভিন্ন কোর্স পরিচালনা শুরু করেন। এ ছাড়াও একাডেমি কর্মমুখী ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা প্রদানে বিভিন্ন শর্টকোর্সও পরিচালনা করে আসছে। এর পরপরই এ ক্রিয়েটিভ শিক্ষাকে বিশ্ববাজারের চাহিদানুযায়ী উচ্চতর শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে এবং একইসাথে ডিজাইন, কোয়ালিটি ও মার্কেটিং শিক্ষার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য তৈরি করে বিশ্ববাজারে বিপণন করার জন্য ইংল্যান্ডের এডেক্সেল ইন্টারন্যাশনাল এর সাথে সম্পৃক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শান্ত-মারিয়াম ইন্সটিটিউট অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি। যেখানে বিটেক এক্সটেন্ডেড ডিপ্লোমা (এনডি) ও হায়ার ন্যাশনাল ডিপ্লোমা (এইচএনডি) এর আওতায় ফ্যাশন ডিজাইন, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, গ্রাফিক ডিজাইনসহ ফ্যাশন মার্চেন্ডাইজিং ও মিডিয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন কোর্স পরিচালনা শুরু করেন। তখন দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন শিক্ষার তেমন প্রচলন না থাকায় এ শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তাই তিনি শান্ত-মারিয়াম একাডেমি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি ও শান্ত-মারিয়াম ইন্সটিটিউট অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সম্পৃক্ত করে এবং এসব বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজেক্ট প্রোফাইলে কর্মমুখী সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার ব্যবস্থা রেখে দূরশিক্ষণ/অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে অন্তর্ভুক্ত করে ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এ অঞ্চলের ব্যতিক্রমধর্মী প্রথম ক্রিয়েটিভ বিশ্ববিদ্যালয় ‘শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’। যার চৌদ্দতলা সুবিশাল স্থায়ী ক্যাম্পাস এখন উত্তরা দিয়াবাড়ি এলাকায়।
মসৃন ছিল না চলার পথ: সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে চারটি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য জনাব শান্ত তাঁর প্রতিষ্ঠিত সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসকে সম্পৃক্ত করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘শান্ত-মারিয়াম ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’ গড়ে সেখান থেকে কর্মমুখী, সৃজনশীল, সাংস্কৃতিক শিক্ষা এবং দূরশিক্ষণ/অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে জার্মানির অনুরূপ বাংলাদেশের উপযোগী শিক্ষার একটি মডেল তৈরির লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড শুরু করেন। যেখান থেকে দেশের মানুষ প্রযুক্তিনির্ভর কর্মমুখী, ডিজাইন, গার্মেন্টস ও প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টসহ তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষায় দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে নিজ নিজ স্থানের অফুরন্ত প্রাকৃতিক ও অন্যান্য সম্পদ ব্যবহার করতে সক্ষম হতো। এই শিক্ষাকার্যক্রম দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া গেলে দেশের মানুষ স্ব স্ব কর্মস্থলে থেকেও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষাগ্রহণ করার পর এইসব সেন্টার থেকে নবম শ্রেণি থেকে শুরু করে প্রয়োজনমতো পর্যায়ক্রমে দূরশিক্ষণে উচ্চতর শিক্ষা নিতে পারতো। সেই সাথে তারা সাংস্কৃতিক শিক্ষার জন্য প্রয়োজনমতো সঙ্গীত, নৃত্য ও চারুকলা বিষয়েও শিক্ষা নিতে পারতো। এর ফলে ২৫ থেকে ২৬ বছরের পরিবর্তে উন্নত বিশে^র মতো ১৮-১৯ বছরের মধ্যে যুব সমাজকে যদি কর্মে প্রবেশ করানো যেতো, তাহলে দেশ কোটি কোটি ঘণ্টা উৎপাদনমুখী বেশি শ্রম পেতো। ফলে দেশে ছোট ছোট গার্মেন্টস ভিলেজ ও ক্রাফ্ট ভিলেজ তৈরি হতো। সেখান থেকে তৈরি পণ্য দেশে বিপণনসহ বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হতো। উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য শহরের প্রতি মানুষের চাপও অনেকাংশে কমতো এবং জার্মানির অনুরূপ বাংলাদেশের উপযোগী শিক্ষার মডেল সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে অনেকটা মুক্ত করে অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সম্ভব হতো।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই দেশের দুটি মহল যার একটি স্বাধীনতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী এবং অপরটি স্বাধীনতার সুফলভোগী লুটেরা শ্রেণি। যারা এ কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য অপপ্রচার ও অপতৎপরতা শুরু করে। এমনকি তারা এই প্রতিষ্ঠানকে বিদেশিদের অর্থায়নে পরিচালিত খ্রিস্টানদের প্রতিষ্ঠান বলেও ব্যাপক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। অথচ এ ব্যতিক্রমধর্মী ক্রিয়েটিভ বিশ্ববিদ্যালয়কে সহযোগিতার জন্য দেশি-বিদেশি বহু প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিলেও জনাব শান্ত বিনয়ের সাথে তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
তাঁর স্বপ্নদর্শনে হাঁটছে সরকার: দীর্ঘ দুই দশক আগে শান্ত-মারিয়াম ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার-এর মাধ্যমে দেশব্যাপী যে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করেছিলেন জনাব শান্ত, সেই শিক্ষার প্রয়োজনীতা আজ প্রমাণিত। এটাও প্রমাণিত যে, মাদ্রাসা শিক্ষাতে কর্মমুখী শিক্ষা না থাকায় অনেকক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদসহ নানা বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। একইসাথে সমাজের উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেক ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পরেও সাংস্কৃতিক শিক্ষার অভাবে ধর্মীয় গোঁড়ামির শিকার হয়ে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়াচ্ছে। যার ফলে হলি আর্টিজন-এর মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার ও বিজ্ঞজনেরাও সাংস্কৃতিক শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারছেন। একইসাথে বর্তমান সরকারও স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের মাধ্যমে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছে কর্মমুখী শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে একে একে প্রতিষ্ঠা করেন বিভিন্ন সেবাধর্মী ব্যবসা, কর্মমুখী শিক্ষা ও মানবকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান। এ সকল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মমুখী, সৃজনশীল, সাংস্কৃতিক শিক্ষা এবং দূরশিক্ষণ/অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তিনি তাঁর কার্যক্রম পরিচালনা করে গেছেন। যা বর্তমান তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরিদের দ্বারা চলমান এবং ক্রমে অগ্রসরমান। জনাব শান্ত সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য সঙ্গীত, নৃত্য ও চারুকলা বিষয়ের শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করে গুণগত মানসম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর অনন্য মডেল সৃষ্টি করে গেছেন। যে সৃষ্টির সোপান বেয়ে ভৌগলিক স্বাধীনতার সাথে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় জাতি আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
মাকে যেমনটি বলেছিলেন-‘মা আমার যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।’ তেমনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের উদ্দেশেও বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বলতেন-যে মহান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশনের যাত্রা, সেই উদ্দেশ্য সফলে সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করে যেতে হবে। স্বাধীনতার সুফল মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে যে যুদ্ধ শুরু করেছি-সে যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।
আশা করি, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত প্রতিষ্ঠিত শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ডা. মোঃ আহসানুল কবিরসহ সংশ্লিষ্ট উত্তসূরিগণ প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের যোগ্য কর্মীবাহিনী সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের অসমাপ্ত যুদ্ধজয়ে অনেক বেশি আন্তরিক হবেন।
চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি-হে মহান কর্মবীর; দেশ ও জাতির উন্নয়ন স্বপ্নদ্রষ্টা।
লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, দৈনিজ আজকের প্রত্যাশা