ড. কবিরুল বাশার : বিশ্বের ৭০৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছিল আর মারা গেয়েছিল ৭ মিলিয়নের অধিক। কোভিড-১৯ আতঙ্কের পর বর্তমান সময়ে আলোচিত ভাইরাস এইচএমপিভি (হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস)। করোনা সংক্রমণ শুরুর পাঁচ বছর পরে চীনের উত্তরাঞ্চলে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস সংক্ষেপে এইচএমপিভি আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
ভাইরাসটি নতুন নয়। ২০০১ সালে প্রথম শনাক্ত হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, হয়তো পৃথিবীতে অনেক যুগ আগে থেকেই ভাইরাসটির অস্তিত্ব ছিল। ভাইরাসটি মানবদেহে ছড়াতে শুরু করলেও এখনই ঘাবড়ানোর কারণ দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তবে রোগটি যাতে না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। ভাইরাসটি নিয়ে চীন সরকার বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)ও আনুষ্ঠানিক সতর্কতা জারি করেনি।
তবে জাপান, মালয়েশিয়া এবং ভারতের পর বাংলাদেশেও এইচএমপিভিতে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই দেখা দিয়েছে বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সূত্রে ১১ জানুয়ারি দেশে একজনের শরীরে এইচএমপিভি সংক্রমণের কথা জানা যায়। সংবাদপত্র থেকে জানা গেছে, আক্রান্ত ব্যক্তির বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই। মানে তিনি দেশেই আক্রান্ত হয়েছেন।
যুগে যুগে মানব ইতিহাসে অনেক মহামারি দেখা দিয়েছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, গুটিবসন্ত, যক্ষ্মা, প্লেগসহ মহামারির সংখ্যা নেহাত কম নয়। তবে মহামারিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ছিল প্লেগ, যেটির একটি ভ্যারিয়েন্ট ব্ল্যাক ডেথ হিসেবে পরিচিত। পৃথিবীতে যত মহামারি এসেছে তার মধ্যে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর দিক থেকে সবচেয়ে ভয়ানক ছিল প্লেগ। এছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য মহামারির মধ্যে রয়েছে স্প্যানিশ ফ্লু, এইচআইভি ও এইচ১এন১।
এইচএমপিভি একটি শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস; যা ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত হয়। এটি একটি আরএনএ ভাইরাস; যা মেটানিউমোভাইরাস পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এইচএমপিভির আবিষ্কারের পর থেকে এটি শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। ভাইরাসটি শিশু, বয়স্ক ও দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ব্যক্তিদের মধ্যে গুরুতর রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
এইচএমপিভির বৈশিষ্ট্যগত গঠন এবং রোগবিস্তার ক্ষমতা রেসপিরেটরি সিনসিশিয়াল ভাইরাসের (আরএসভি) সঙ্গে অনেকটাই অনুরূপ। তবে এটি একটি আলাদা ভাইরাস। এইচএমপিভির কোনো ভ্যাকসিন বা নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই। এইচএমপিভি বৈশ্বিক ভাইরাস এবং এটি পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মহাদেশেই শনাক্ত হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ভারত, চীন, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডে রোগটি শনাক্ত হয়েছে। এইচএমপিভিতে আক্রান্ত রোগী সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগের উপসর্গ নিয়ে আসে।
প্রাথমিকভাবে এটি বিশেষত শীত ও বর্ষার সময় বাড়ে এবং ঠান্ডা আবহাওয়া, বেশি জনসমাগম ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বায়ুদূষণের সঙ্গে এর গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।
এইচএমপিভি একটি এনভেলপড আরএনএ ভাইরাস; যার অর্থ ভাইরাসটির বাইরের অংশে একটি লিপিড বাইলেয়ার থাকে। এটি কোষের মেমব্রেনের মতো; যা ভাইরাসটিকে শ্বাসযন্ত্রের কোষে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। ভাইরাসটির জেনেটিক ম্যাটারিয়াল আরএনএ আকারে থাকে এবং এটি অল্প সময়ের মধ্যে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে এবং কোষের মেটাবলিজম ব্যবহার করে নিজেকে রেপ্লিকেট করে।
এইচএমপিভির গঠন বেশ জটিল এবং তার মধ্যে রয়েছে বেশকিছু স্পাইক প্রোটিন; যা ভাইরাসটিকে কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। এ স্পাইক প্রোটিনের মাধ্যমেই ভাইরাসটি শ্বাসযন্ত্রের কোষে সংক্রমণ সৃষ্টি করে।
এইচএমপিভি প্রধানত শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে ছড়ায় এবং সাধারণত বাতাসে ভেসে থাকা ভাইরাসের কণা বা একটি সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে।
ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি, হাঁচি বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। ভাইরাসটি মানুষের হাতের সংস্পর্শে আসতে পারে এবং তারপর সেই হাতের মাধ্যমে মুখ, নাক বা চোখে প্রবেশ করতে পারে। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের সংক্রমণ বেশির ভাগ সময় শীত ও বর্ষাকালে ঘটে। কারণ, এ সময় শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাসগুলোর কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায় এবং ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়ে, যা ভাইরাসের সংক্রমণ সহজতর করে।
এইচএমপিভিতে আক্রান্ত হওয়ার পর সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এ রোগের উল্লেখযোগ্য লক্ষণগুলো হলো সর্দি (রাইনাইটিস), কাশি (প্রাথমিকভাবে শুষ্ক, পরবর্তী সময়ে সর্দি, শ্লেষ্মাসহ), গলাব্যথা, জ্বর (এটি সাধারণত মাঝারি থেকে উচ্চমাত্রার হতে পারে), শ্বাসকষ্ট (বিশেষত শিশুদের মধ্যে), শ্বাসে অবরোধ। এইচএমপিভির সংক্রমণ সাধারণত এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে নিরাময় হয়ে যায়, তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এটি গুরুতর শ্বাসতন্ত্রের রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যেমন নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কিওলাইটিস; যা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
শিশু, বয়স্ক বা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন রোগীদের মধ্যে এইচএমপিভি গুরুতর শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যারা এ গ্রুপের মধ্যে আছেন তাদের জন্য ভাইরাসটি মৃত্যুর ঝুঁকিও সৃষ্টি করতে পারে। তাদের ক্ষেত্রে শ্বাসতন্ত্রের গভীরে সংক্রমণ তৈরি এবং ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি হয়; এমনকি শ্বাসনালি বা ব্রঙ্কিওলগুলোর প্রদাহ সৃষ্টি হয়। তা শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করে। গুরুতর সংক্রমণের ক্ষেত্রে শ্বাসপ্রশ্বাসে বিপত্তি ঘটতে পারে। ফলে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিতে পারে।
বর্তমানে এইচএমপিভির জন্য কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো উপসর্গের ভিত্তিতে রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা। উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সাধারণত নিম্নলিখিত চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকেন
প্যারাসিটামল বা অলিভ ফিভার রিলিভার (জ্বর কমাতে), কাশি প্রশমন এবং অ্যান্টি-কফ মেডিসিন (কাশি কমাতে), অক্সিজেনথেরাপি (যদি শ্বাসকষ্ট হয়), ইনহেলার/ব্রঙ্কোডিলেটরস (যদি শ্বাসযন্ত্রে অবরোধ থাকে)। গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা প্রয়োজন। যাদের শ্বাসকষ্ট তীব্র বা গুরুতর হয়, তাদের ক্ষেত্রে ভেন্টিলেটরি সাপোর্ট বা ইনকিউবেশন প্রয়োজন হতে পারে।
এইচএমপিভির জন্য কোনো নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন নেই। তবে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা রয়েছে। তা ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করতে পারে। ভাইরাসটি হাতের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। তাই হাত নিয়মিত ধোয়া, কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করা উচিত এবং টিস্যু ব্যবহারের পর তা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দিতে হবে। যাদের শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ রয়েছে, তাদের থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা; সংক্রমিত ব্যক্তির কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা এবং তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ পরিহার করা।
এইচএমপিভির বিস্তার এবং সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। জনগণের মধ্যে এইচএমপিভি সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ। টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এইচএমপিভি সম্পর্কে তথ্য প্রচার করা উচিত। যেমনÑ ভাইরাসের উপসর্গ, সংক্রমণের উপায় ও প্রতিরোধের কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। সচেতনতা কম থাকলে অনেক মানুষ ভাইরাসের উপসর্গ বা সংক্রমণ নিয়ে অবহেলা করতে পারে। তা ভাইরাসের বিস্তার ত্বরান্বিত করতে পারে।
এইচএমপিভি এবং করোনাভাইরাস (সার্স কোভ-২) দুটি আলাদা ধরনের ভাইরাস। তবে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ সৃষ্টির মধ্যে তাদের কিছু মিল রয়েছে। সার্স কোভ-২ অনেক বেশি সংক্রামক এবং মারাত্মক হতে পারে, বিশেষ করে উচ্চঝুঁকির মানুষের মধ্যে। অন্যদিকে এইচএমপিভি সাধারণত মৃদু বা মাঝারি ধরনের রোগ সৃষ্টি করে এবং এতে মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম। তবে এইচএমপিভির মতো ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের ভাইরোলজিস্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির তথ্য মতে, এইচএমপিভি নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এর বড় কারণ হচ্ছে, এটি কোভিডের মতো নতুন কোনো ভাইরাস নয়। ২০০১ সালে প্রথম এ ভাইরাস শনাক্ত হয় এবং বাংলাদেশে ২০১৬ বা ২০১৭ সালের দিকে এ ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। ভাইরাসটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু না থাকলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য কৌশল প্রণয়ন করে মোকাবিলার প্রস্তুতি রাখা প্রয়োজন।