প্রযুক্তি ডেস্ক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্টে আটকে গেলে শুধু শিক্ষক বা টিউটরের ওপর ভরসা করছেন না। অনেকে দ্রুত সহায়তার জন্য জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
লজ্জা পাওয়া, ভুল প্রশ্ন করার ভয় কিংবা শিক্ষকের অনুপস্থিতি সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ এখন বিকল্প হিসেবে চ্যাটজিপিটির মতো এআই টুল ব্যবহার করছে। মাত্র কয়েক মুহূর্তেই তারা উত্তর পেয়ে যাচ্ছেন, প্রয়োজনে সেই উত্তর থেকে আরো ব্যাখ্যাও চাইতে পারছেন। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার চারটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে করা এক সমীক্ষার তথ্য তুলে ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্ট লিখেছে, প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পড়াশোনায় মতামত পাওয়ার জন্য এআই ব্যবহার করেন।
গবেষণা ফলাফল: ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে ছয় হাজার নয়শ ৬০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে এই সমীক্ষা চালানো হয়। অংশগ্রহণকারীরা বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও গণিত, স্বাস্থ্য, মানবিক, ব্যবসা ও আইনসহ নানা বিষয়ে পড়াশোনা করছিলেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ ছিলেন নারী, ৭২ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। প্রায় ৯০ শতাংশ পূর্ণকালীন শিক্ষার্থী, ৫৮ শতাংশ ছিলেন দেশীয় শিক্ষার্থী। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৬১ শতাংশ ছিলেন স্নাতক পর্যায়ের এবং ৯২ শতাংশ সরাসরি ক্যাম্পাসের কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছিলেন। এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের অনলাইন জরিপে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। গবেষকদের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীরা শেখার প্রক্রিয়ায় কীভাবে এআই ব্যবহার করছে তা বোঝা, বিশেষত তারা এআই ব্যবহার করে ফিডব্যাক নিচ্ছেন কি না এবং শিক্ষক বনাম এআই থেকে পাওয়া ফিডব্যাকের সহায়কতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা কী।
এআইয়ের ফিডব্যাক কার্যকর তবে আস্থায় ঘাটতি: সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ৪৯ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেক তাদের বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাসাইনমেন্ট উন্নত করার জন্য ফিডব্যাক পেতে এআই ব্যবহার করছেন। চ্যাটজিপিটির মতো জনপ্রিয় এআই টুলে প্রশ্ন করা, লেখা উন্নত করার পরামর্শ নেওয়া, কাজের শক্তি বা দুর্বলতার বিশ্লেষণ, টেক্সট সম্পাদনার পরামর্শ কিংবা নতুন ধারণা সংগ্রহ এসবের মাধ্যমেই তারা এআই থেকে সহায়তা নিচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই বলছেন, শিক্ষক ও এআই দুই ধরনের ফিডব্যাকই তারা সহায়ক বলে মনে করেন। এআই ফিডব্যাককে ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী কার্যকর বলেছেন আর শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এই হার ৮২ শতাংশ। তবে আস্থার জায়গায় বড় পার্থক্য স্পষ্ট। প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষকের ফিডব্যাককে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছেন তবে এআইয়ের ক্ষেত্রে সেই হার নেমে এসেছে ৬০ শতাংশে।
এক শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, এআই দ্রুত তথ্য ব্যাখ্যা আর সৃজনশীল ধারণা দেয় যা তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধান কিংবা নতুন ধারণা খুঁজতে সহায়ক।
অন্যদিকে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, শিক্ষকের ফিডব্যাকগুলো কঠিন হলেও বেশি ফলপ্রসূ ছিল। এআই অনেক সময় শুধু আমার আগের ধারণাগুলোই নিশ্চিত করে, তাই আসলেই কতটা সহায়ক তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
এআইয়ের শক্তি পরিমাণে, শিক্ষকের শক্তি দক্ষতায়: শিক্ষার্থীদের উন্মুক্ত প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, এআই ও শিক্ষক মূলত ভিন্ন উদ্দেশ্যে কাজ করছে। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, এআই ততটা নির্ভরযোগ্য বা নির্দিষ্ট নয় এবং কোনো অ্যাসাইনমেন্টের প্রেক্ষাপটও শিক্ষক যতটা বোঝেন এআই তা বোঝে না। তবে সহজলভ্যতার জায়গায় এআই এগিয়ে। শিক্ষার্থীরা বারবার ফিডব্যাক চাইতে পারেন এবং এতে শিক্ষককে বিরক্ত করার মতো অস্বস্তি তৈরি হয় না।
ফিডব্যাক নিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতার সমাধান দিচ্ছে এআই: গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষকদের কাছ থেকে ফিডব্যাক চাইতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় দুর্বল অবস্থায় পড়েন। তাদের মধ্যে অনেকে ভয় পান কাজ যথেষ্ট ভালো না হলে শিক্ষকের কাছে সুনাম নষ্ট হতে পারে, বিব্রত হতে পারেন, কিংবা শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু এআই ব্যবহার করলে সেই দুশ্চিন্তা অনেকটাই দূর হয়। একজন শিক্ষার্থী বলেন, এআইয়ের ফিডব্যাক অনেক নিরাপদ মনে হয় এবং এতে বিচারধর্মী মনোভাব কম। আরেকজন শিক্ষার্থী বলছেন, এআই আমাকে এমন সব ‘বোকা’ প্রশ্ন করতে দেয় যেগুলো জিজ্ঞাসা করতে আমি শিক্ষকের সামনে লজ্জা পেতাম।
অনেকে জানেই না এআই সাহায্য করতে পারে: সমীক্ষায় অংশ নেওয়া অর্ধেক শিক্ষার্থীই ফিডব্যাকের জন্য কখনো এআই ব্যবহার করেননি। এর মধ্যে ২৮ শতাংশ জানতেনই না যে এভাবে এআই ব্যবহার করা সম্ভব। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে ছিল এআইকে অবিশ্বাস করা এবং ব্যক্তিগত মূল্যবোধের কারণে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার না করা। গবেষকরা মনে করছেন, এতে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। যারা এআই সম্পর্কে জানেন তারা যে কোনো সময় ফিডব্যাক পেতে পারছেন তবে যারা জানেন না তারা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যে বার্তা দিচ্ছে: শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতায় উঠে এসেছে, প্রাথমিক বিষয়ের ক্ষেত্রে দ্রুত ও সহজলভ্য ফিডব্যাক দেওয়ার ক্ষেত্রে এআই উপকারী। তবে গভীরতর বিষয়ে প্রাসঙ্গিক ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেওয়ায় শিক্ষকরা অতুলনীয়। গবেষকদের মতে, বিষয়টি অনেকটা যোগ্য চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নেওয়ার সঙ্গে গুগলে উপসর্গ খোঁজার পার্থক্যের মতো। দুটোই হয়তো উপকারী হতে পারে কিন্তু গুরুতর বিষয়ে কোনটিকে বেশি ভরসা করা হবে তা স্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন শিক্ষাদান ও শেখার কাঠামোয় এআই যুক্ত করার চেষ্টা করছে তখন বড় চ্যালেঞ্জ হবে শিক্ষকদের সামর্থের জায়গাগুলোকে আরো কাজে লাগানো। এআই সেখানে শিক্ষার্থীদের কাজ নিয়ে সহজবোধ্য, সর্বদা সহজলভ্য এবং নিরপেক্ষ ফিডব্যাক দিয়ে পরিপূরক ভূমিকা রাখতে পারে। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভবিষ্যৎ আসলে এআই ও মানুষের মধ্যে বেছে নেওয়ার বিষয় নয় বরং দুইপক্ষ কীভাবে একসঙ্গে কাজ করে শিক্ষার্থীদের শেখাকে আরো কার্যকর করা যায় সেটিই হবে মূল লক্ষ্য।