রাশেদ খান মেনন : একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ শুরু করতে সক্ষম হলেও, তাদের প্রতিশ্রুত বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে পারেনি, সেটা পার্লামেন্টে তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সম্ভবও ছিল না। তবে এই সময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে তার পক্ষে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। মাদ্রাসা শিক্ষার বিপুল বিস্তার, মসজিদভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি ইতিমধ্যেই দেশে আধুনিক শিক্ষার মূলধারার বাইরে এক বড় সামাজিক শক্তির জন্ম দেয়, যা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে জামায়াতের রাজনৈতিক ভিত্তিকে প্রসারিত করে।
এদিকে পৃথিবীতেও সত্তর দশকের শেষভাগ থেকে ইসলামিক রাজনীতির উত্থান ঘটে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা, মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো ডলারের পৃষ্ঠপোষকতা, ইসলামি অর্থনীতির প্রচলন ও সর্বোপরি আফগানিস্তানে তালেবান মুজাহিদদের ক্ষমতা দখল ও ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা-এসবই বাংলাদেশের ধর্মবাদী দল ও গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশেও ধর্মবাদী রাজনীতির দ্রুত বিস্তার ঘটে। বড় দু’টি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের সমর্থন লাভের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে।
একইভাবে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ভারতের সাথে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা, গঙ্গার পানি চুক্তিতে পানির কম হিস্যা গ্রহণ করে বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের এক দশমাংশ অংশকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া এবং সর্বোপরি আওয়ামী লীগের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র স্লোগানকে সেই পুরানো কায়দায় ধর্মহীনতার অভিযোগ তুলে বিএনপি-জামায়াত চার দলের ঐক্যের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। ওই নির্বাচনের পেছনে বিচারপতি লতিফের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ থাকলেও, আওয়ামী লীগ শাসনের দলবাজি, দুর্নীতি, দখলদারি ও এলাকাবিশেষে সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েমে জনগণ বিদ্বিষ্ট ছিল। এই সুযোগ নিয়েছিল চারদলীয় জোট। আওয়ামী লীগের এক নির্বাচনি পোস্টারে ‘কুকুরের মাথায় টুপি’কে চারদল তাদের নির্বাচনি প্রচারে আওয়ামী লীগের ধর্মহীনতার প্রমাণ হিসেবে হাজির করে। চারদল কেবল নির্বাচনে বিজয় লাভ করেই ক্ষান্ত থাকে নাই, নির্বাচনের পরপরই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংস আক্রমণ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উপর আক্রমণ শুরু করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এই সাম্প্রদায়িক হামলায় হিন্দু-খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠী চরম উৎপীড়নের সম্মুখীন হয়। বহু প্রাণহানি, হামলা, ঘরবাড়ি লুট ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী ঘরছাড়া-এলাকা ছাড়া হয়।
এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে পাঁচদল, যা ইতিমধ্যে বামফ্রন্টে রূপান্তরিত হয়েছে তারা দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করলেও আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য শক্তি সংগঠনের নির্বাচনোত্তর বিপর্যস্ত অবস্থায় সেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। তবে বিএনপি-জামায়াত চারদলের সরকারকে ওই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধে বাধ্য করতে সক্ষম হয়।
একানব্বইয়ের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের সহায়তায় সরকার গঠন করলে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী তার ছত্রছায়ায় তারা রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতিতে তাদের শিকড়ও বিস্তৃত করা শুরু করে। তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র-শিবিরকে দিয়ে তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর কারমাইকেল কলেজ, বিভিন্ন মেডিক্যাল ও পলিটেকনিক্যাল ইন্সস্টিটিউটসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহিংসতার মাধ্যমে তাদের দখলদারিত্ব কায়েম করে। এই সহিংসতায় তাদের প্রধান ধরন ছিল প্রতিপক্ষের চোখ তোলা, হাত-পা, রগকাটা ও গুলিবর্ষণ করা। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের ছাত্রনেতা-কর্মীরা। কারণ তারা জানত আওয়ামী লীগকে বামপন্থীদের কবলমুক্ত করতে পারলে তারা বিএনপি’র ছত্রছায়ায় দেশের রাজনীতিতে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। তাদের ওই সকল সহিংস আক্রমণে নিহত শহীদ জামিল আখতার রতন, রীমু চৌধুরী, দেবাশীষ রুপম, ফারুক, জুয়েলের নাম এখানে বিশেষভাবে স্মরণ করছি। তবে তাদের আক্রমণে আরও অসংখ্য বাম ও প্রগতিশীল নেতা কর্মীরা নিহত হয়, অনেকে হাত, পা, চোখ হারায় এবং তাদের বহু ছাত্রবাস অগ্নিদগ্ধ হয়।
এবার চারদলের সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এই স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীও মন্ত্রীত্ব লাভের মাধ্যমে সরাসরি ক্ষমতার অংশীদার হয়। ইতোমধ্যে পৃথিবীতে আরও পরিবর্তন ঘটেছে পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা গুরুতর রূপ লাভ করেছে। বাংলাদেশেও বিএনপি-জামায়াতের ছত্রছায়ায় হুজি, জেএমবি নামের প্রায় ১৯টি জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী সংগঠিত তৎপরতা শুরু করে। রাজশাহী অঞ্চলে সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই ও শাইখ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে জঙ্গিবাদী তৎপরতা বিশাল বিস্তৃতি লাভ করে।
রাজশাহী, নাটোর, চাপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা, সিলেট, জামালপুর, ময়মনসিংহে বাংলা ভাই, শাইখ আব্দুর রহমানের জেএমবি দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় ভাল ও কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ১৭ আগস্ট ২০০৫ সনে মুন্সিগঞ্জ জেলা বাদে জেএমবি একযোগে একই সময় দেশের ৬৩টি জেলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটনার মধ্য দিয়ে তাদের শক্তির প্রদর্শন ঘটায়। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এই জঙ্গিবাদী তৎপরতাকে ‘মিডিয়ার প্রচারণা’ বলে উড়িয়ে দিলেও, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারা তাদের মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়েনি। বরং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ‘হুজি’কে দিয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা বিস্ফোরণ করিয়ে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে সমূলে বিনাশ করার উদ্যোগ নেয়। একুশে আগস্টের এই বোমাবর্ষণের ঘটনাকে ভিন্নখাতে ঘোরানোর জন্য তাকে ভারতীয় ‘র’-এর কাজ বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা নেয়। তারা একুশে আগস্টের বোমা হামলার বিচারও করেনি। বরং ‘জজ মিঞা’ নাটক সাজিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করে।
২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত বিরোধী ১৪ দলের আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে সেনা হস্তক্ষেপে বিএনপি-জামায়াত শাসনের অবসান ঘটলেও দুই বছরের সেনাশাসন বাংলা ভাইয়ের জেএমবি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল বিচারসহ জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী তৎপরতা বন্ধে কিছু ব্যবস্থা নিলেও দেশে যে সাম্প্রদায়িক তৎপরতা ও মানসিকতার বিস্তৃতি রোধে কোনও উদ্যোগ নেয়নি। বরং বাংলাদেশের সকল শাসকগোষ্ঠীর মতই দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করেছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বিজয়ের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় দেশ ফিরে আসে। কিন্তু যে আশা নিয়ে দেশবাসী বাহাত্তরের সংবিধানে পরিপূর্ণভাবে প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করেছিল তা ঘটেনি। পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা পুনঃস্থাপিত করা হলেও, আওয়ামী লীগ বিশেষ করে তার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছানুসারে সংবিধানের প্রস্তাবনায় জিয়াউর রহমান কর্তৃক সন্নিবেশিত ‘বিসমিল্লাহ’কে ভাষান্তর করে অন্য ধর্মালম্বীদের বুঝ দেওয়ার এবং একইভাবে এরশাদের প্রবর্তিত ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’কে একইভাবে বহাল রেখে তাকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের গ্রহণযোগ্য করতে নতুন একটি বাক্য সংযোজন করা হয় যার মধ্য দিয়ে সকল ধর্মের সমঅধিকারের কথা বলা হয়। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ সংবিধান সংশোধনী কমিটি ও সংশোধনী গ্রহণকালে বিভক্তি ভোটে ভিন্নমত লিপিবদ্ধ করলেও তার কোনও প্রকাশ ঘটেনি সংবিধানের সংশোধনীতে। মাঠেও বাম রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কোনও কার্যকর জমায়েত বা আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারায় এ বিধানটি নির্বিঘেœই অস্তিত্ব বজায় রাখে। (চলবে)
উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ