রাশেদ খান মেনন : দিনাজপুরের প্রবীণ ভাসানী ন্যাপ নেতা অ্যাডভোকেট বরদা চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনে ভাসানী ন্যাপ, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (দেবেন শিকদার), শ্রমিক-কৃষক কর্মী সংঘ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (হাতিয়ার), পূর্ব বাংলা কৃষক সমিতি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন (পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন) এবং পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ২রা জুন সম্মেলন সর্ব সম্মতিক্রমে মওলানা ভাসানীকে প্রধান করে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গঠন করে এবং একটি ঘোষণা গ্রহণ করে। ঘোষণার সূত্রপাতে বলা হয় “সম্প্রতি মওলানা ভাসানী ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে অগ্রসর করিয়া লওয়ার জন্য যে আহ্বান ও নির্দেশ দিয়াছেন তাহাকে অবলম্বন করিয়া…. রাজনৈতিক ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিরা এক সম্মেলনে মিলিত হইয়া ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গঠন করিয়াছেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে নি¤েœাক্ত ঘোষণা প্রণয়ন করিয়া বাংলাদেশের জনগণের নিকট উপস্থিত করিতেছেন।”
ঘোষণায় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলা হয় “… এই সমন্বয় কমিটির আশু লক্ষ্য হইল সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সরকার ও মুক্তিসংগ্রামের সকল শক্তির সহিত সংযোগ ও সমন্বয় সাধন করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লওয়া।” ঘোষণায় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে সফল করার জন্য আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, গণসংগঠন, শ্রেণি সংগঠন ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে একটি ‘জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট’ গঠনের আহ্বান জানানো হয়।
সমন্বয় কমিটি গঠনের এক কি দু’দিন পর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সমন্বয় কমিটি গঠন ও তার ঘোষণার কথা প্রকাশ করা হয়। জনাকীর্ণ ওই সাংবাদিক সম্মেলনে অনেক প্রশ্নের মধ্যে প্রধান প্রশ্ন ছিল এটা প্রবাসী সরকারের বিকল্প কোনও সংগঠন কিনা। সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার করা হয় যে সমন্বয় কমিটি প্রবাসী সরকারকে সহযোগিতার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে সকল মত পথ, সংগঠন ও ব্যক্তির ঐক্যবদ্ধ করা ও তাদের সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই সমন্বয় কমিটি গঠন ও তার ঘোষণা গ্রহণ করেছে। সম্মেলনের সংবাদ আনন্দবাজার থেকে ভারতীয় সকল পত্রিকা ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) মুখপত্র গণশক্তিতে সমন্বয় কমিটির ঘোষণা পূর্ণ পৃষ্ঠা ব্যাপী ছাপা হয়।
সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি পক্ষ থেকে কাজী জাফর আহমদ ও হায়দার আকবর খান রনো বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সাথে দেখা করে তাকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন, বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে সহযোগিতা, জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনসহ সম্মেলনের সকল সিদ্ধান্ত অবগত করেন। কিন্তু তিনি ইতিবাচক সাড়া না দিয়ে বরঞ্চ মুক্তিযুদ্ধে বাম কমিউনিস্টদের একাংশ অর্থাৎ নকশালপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকা- সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করেন। তাকে বলা হয় যে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন এই কমিটি নকশালদের ওই সকল কর্মকা-ের বিরোধিতা করে এবং তার সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। এক সময় কিছুটা উত্তপ্ত বিতর্ক হলে আবদুস সামাদ আজাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন জানান যে তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে কথা বলে এ ব্যাপারে জানাবেন। সম্ভবত তিনি ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম কমিটি’ ভবিষ্যতে প্রবাসী সরকারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এই অনুমান করেছিলেন। আর ইতিমধ্যে দলের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতৃত্ব তার সরকারের বিরোধিতায় ভারতীয় সেনা বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর সমান্তরাল ‘মুজিব বাহিনী’ গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিয়ে বিব্রত ছিলেন। দলের নেতৃত্বের একাংশ বিশেষ করে খন্দকার মোশতাক প্রথম থেকেই স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করে চলেছিল।
প্রবাসী সরকারের এ ধরনের অসহযোগিতার মনোভাবের কারণে মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে তাদের সাথে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির আর যোগাযোগ হয়নি। একদিকে প্রবাসী সরকারের এ ধরনের অস্বীকৃতি ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বৈরী মনোভাবের কারণে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটিকে এক বড় ধরনের প্রতিকূল অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের ভূমিকা রাখতে হয়। দেশের ১৪টি অঞ্চলে নিজেদের বাহিনীর নেতৃত্বে পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীকে মোকাবিলা করা প্রতিরোধ লড়াইয়ের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এর বাইরে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত হয়ে বিভিন্ন লড়াইয়ে অংশগ্রহণের কাজকেও এগিয়ে নেয়। এই অবস্থা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ভারতীয় গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ কাজী জাফর ও হায়দার আকবর খান রনোকে দু’দিন অনর্গল জেরার মাধ্যমে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করে। তারা শেষ পর্যন্ত জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটিকে অর্থ ও অস্ত্র দিতে রাজি হয়। তবে কমিটি অর্থ প্রদানের প্রস্তাব গ্রহণ না করে অস্ত্র প্রদানের উপর জোর দেয়।
ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বব্যাপী তার কূটনৈতিক সফর শেষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিতে মোটামুটি মানসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিয়ে মওলানা ভাসানীকে প্রধান করে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামন্ডলী গঠন করে। এটা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে একমাত্র স্বীকৃতি। উপদেষ্টামন্ডলী গঠনের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলই যে একমত সেটা বিশ্বকে দেখানো।
মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টামন্ডলীর একটি মাত্র সভা হয়, যার সচিত্র প্রতিবেদন ভারতের গণমাধ্যমসমূহে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। অবশ্য ইতোপূর্বে মওলানা ভাসানী তার ভারত প্রবাসের সাথী সাইফুল ইসলাম ও মুরাদুজ্জামানকে কাজী জাফর ও আমার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে কোনও ধরনের আপোসের কথা উঠলে তার বিরোধিতা করতে বলেন। কারণ ইতোমধ্যে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন গঠনের মধ্য দিয়ে একটা আপোস মীমাংসার প্রস্তাব খন্দকার মোস্তাকরা এনেছিল। সেই উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেওয়া হলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এহেন উদ্যোগ থেমে ছিল না। মওলানা ভাসানী আমাদের কাছে পাঠানো চিঠি শেষ করেছিলেন রবি ঠাকুরের পংক্তি দিয়ে, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে।”
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড গঠন ও পাক-ভারত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অতিদ্রুত সময়ে বিজয়ের প্রান্তে উপনীত হয়। জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটির অধীনস্ত সকল বাহিনীই এই সময়ে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের স্বাক্ষর রাখে। ক্ষেত্র বিশেষে যৌথ বাহিনীর পৌঁছার পূর্বেই পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটির পর ঘাঁটির পতন ঘটায়।
ষোলই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি ষোলই ডিসেম্বর ’৭১ মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তিতে সন্তোষ প্রকাশ করে সামনের দিনে কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে এক দিক নির্দেশক বক্তব্য প্রদান করে। বিবৃতির শেষে বলা হয়, “আজকের এই মুহূর্তে আমাদের বিশেষ কাজটি রহিয়াছে তাহার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের এবং সমগ্র জনগণের একতার প্রয়োজনীয়তা পূর্বের চাইতেও বেশি। সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়ার ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ প্রতিহত করা, স্বাভাবিক অবস্থার প্রবর্তন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক জীবন চালু করিবার জন্য সকল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে আমরা সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করিবার জন্য আহবান জানাইতেছি। সরকারের উদ্যোগে যে সকল গণকমিটি গঠিত হইবে তাহাতে সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দল ও মতের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করিতে হইবে। আমরা সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠনের কর্মীদেরকে এই প্রাথমিক গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করা, জনগণের মধ্যে ব্যাপক ঐক্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং এই ব্যাপারে সরকারের সাথে সক্রিয় সহযোগিতা করিবার জন্য আহবান জানাইতেছি। ”
জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সমন্বয় কমিটির সহযোগিতার প্রস্তাব যেমন প্রবাসী সরকার গ্রহণ করেনি, তেমনি বাংলাদেশ সরকারও সমন্বয় কমিটির এই আহ্বানে কান দেয়নি। বাংলাদেশ পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলের পুরনো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো পুনপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সে একই রাজনীতির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে। আর তারই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় গণবিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জাতির পিতাকে সবংশে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছে। বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের পথ থেকে বহুদূর, যারই ধারাবহিকতা বহন করতে হচ্ছে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর সুবর্ণজয়ন্তীতেও। (চলবে)