প্রত্যাশা ডেস্ক : প্রাকৃতিক দুর্যোগে জমিজমা ও বসতবাড়িহারা উপকূলের মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য শহরের বস্তিতে আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছে।
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উপকূলীয় তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার দীর্ঘ উপকূল রেখায় জমিজমা ধীরে ধীরে লবণপানি গ্রাস করছে। এতে মানুষ ঘরবাড়ি, জমিজমা ও কাজ হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে; চলে যাচ্ছে শহরে। সংবাদসংস্থা বিডিনিউজ এক বিশেষ প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে বিস্তারিত।
খুলনা নগরীতে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় অর্ধশত বস্তি, যেগুলোতে উপকূলের এলাকার উদ্বাস্তুরা ঠাঁই নিয়েছেন। নগরীর ৫ নম্বর ঘাটের গ্রিনল্যান্ড বস্তির ডি ব্লকে বসবাস করছেন কয়রা উপজেলার নাকশা গ্রামের বাসিন্দা রাহেলা বেগম (৪০)। ঘূর্ণিঝড় আইলায় ঘরবাড়ি হারিয়ে সপরিবার শহরে চলে আসেন তারা। বাসাবাড়িতে কাজ করে তার সাতজনের সংসার চলে।
রাহেলা বলেন, আইলার পর অর্ধশত পরিবার সব হারিয়ে এই বস্তিতে বসবাস করছে। এরা প্রায় সবাই তার এলাকার।
“বস্তিটি রেলওয়ের জমিতে। প্রায়ই রেল কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ করার কথা বলে যায়, যে কারণে মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকু হারানোর আতঙ্ক সব সময় ঘিরে থাকে।”
নগরীর সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালের পাশে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে গড়ে উঠেছে খোড়াবস্তি। বর্তমানে এই বস্তির নামকরণ করা হয়েছে স্থানীয় কাউন্সিলরের নাম অনুসারে হাফিজ নগর। এই বস্তিতেও আইলার পরে ৩০-৪০টি পরিবার এসে বসবাস করছে। খুলনা সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, নগরীতে ছোট-বড় মোট ৪০টি বস্তি রয়েছে। এসব বস্তিতেই উদ্বাস্তুরা ঠাঁই নিচ্ছে। তেমনি একটি হল ২১ নম্বর ওয়ার্ডের গ্রিনল্যান্ড বস্তি। এখানে হাজারো মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে বসবাস করছে। রেলওয়ের জমিতে গড়ে ওঠা এই বস্তিতে বসবাস করছে এক সময়ের কয়রার স্থায়ী বাসিন্দা অর্ধশত পরিবার। এদের মধ্যে কেউ এসেছে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর, কেউ ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর, আবার কেউবা এসেছেন ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর। তারা সবাই প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারিয়েছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। নদী কেড়ে নিয়েছে শেষ সম্বল জমি। কারও আবার জমি থাকলেও লবণাক্ততায় সেই জমিতে ফসল ফলছে না।
জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি, বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোংলায় নদীর তীর ও বেড়িবাঁধের পাশে প্রায় ২০ লাখ মানুষের বসবাস।
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় নদীর আশপাশের এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। মানুষ ঝুঁকি নিয়ে নদীর তীরে ও বেড়িবাঁধের পাশে নিজের জমি বা খাসজমিতে বসবাস করছে। ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে তাদের।
পরিবেশ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে মাইগ্রেশন হওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও এসব উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা জরুরি।
পরিবেশ সুরক্ষা ফোরাম খুলনার আহ্বায়ক কুদরৎ ই খুদা বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাইগ্রেশন হবে, বেঁচে থাকার স্বার্থে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের সব অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এজন্য থাকা দরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা। কিন্তু এ উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক তানজিল সৌগাত বলেন, প্রকৃতিক কোনো দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তাদের কাছাকাছি যে শহর আছে সেখানে আশ্রয় নেয়। খুলনা শহরেরও একই অবস্থা। সরকারের কাজ হল এই মানুষদের আশ্রয় দেওয়া ও জীবিকার ব্যবস্থা করা।
“তাছাড়া শহরের আশপাশের উপজেলাগুলোকে শহরের আদলে তৈরি করা হলে মূল শহরের ওপর চাপ কম পড়বে। তাহলে শহরের শৃঙ্খলা ঠিক থাকবে।”
জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজিজুল হক জোয়ার্দ্দার বলেন, “শহর এলাকায় আমাদের কাজ নেই বললেই চলে। আমাদের কাজ রুট লেভেলে। আমরা কাজ করি প্রশাসনের সঙ্গে। আমরা মাধ্যম হিসেবে কাজ করি, বাস্তবায়ন করে প্রশাসন।”
কয়রার ইউএনও অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের আমরা সরকারি ও বেসরকারিভাবে পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছি। রাস্তাঘাট ও বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। যারা গৃহহারা হয়েছে তাদের গৃহনির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে।”
খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, “দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে যারা শহরে এসেছে একটি এনজিও তাদের জন্য আমাদের সহযোগিতায় কাজ করছে। খুলনা সিটি করপোরেশনেরও দারিদ্র্য মোচনের একটি কর্মসূচি রয়েছে।” খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ইসমাইল হোসেন বলেন, উপকূলীয় তিন জেলায় যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করেন, তাদের স্থানান্তর, ঘর তৈরিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।