ঢাকা ০২:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ মে ২০২৫

উদ্বাস্তু শিবিরে জন্ম রোহিঙ্গা শিশুদের বিস্মৃত শৈশব

  • আপডেট সময় : ০৪:৪৮:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ৫০ বার পড়া হয়েছে

নারী ও শিশু ডেস্ক: সাত বছর পার হয়ে গেল। ঠিক এত সময় কেটে গেছে- যখন থেকে লাখো রোহিঙ্গা শিশু মিয়ানমারের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলাদেশে কক্সবাজারের অস্থায়ী শিবিরে এই শিশুরা তাদের পুরো শৈশব কাটিয়েছে; যেন তারা এক অন্তহীন দুঃস্বপ্নের বৃত্তে বন্দি। এই সংকটে জন্ম নেয়া বা ছোট্ট অবস্থায় সীমান্ত পেরিয়ে আসা এই শিশুরা এমন সব ভয়াবহতার সাক্ষী; যা কোনো শিশুর দেখা উচিত নয়। তবুও তাদের ভবিষ্যৎ; যেখানে আশা, স্বপ্ন ও সুযোগ থাকা উচিতÑ এ ভবিষ্যৎ ক্রমেই যেন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
যে শিশু কখনো শান্তি দেখেনি, তার জীবন কেমন হতে পারে? যার কখনো স্থিতিশীল বাড়ির আনন্দ পাওয়া হয়নি? রোহিঙ্গা শিশুদের এই নিষ্ঠুর বাস্তবতায় প্রতিদিন কাটাতে হচ্ছে। তারা এমন একটি রাজনৈতিক সংকটের শিকার, যার জন্য তারা দায়ী নয়, অথচ যার কোনো সমাধানও এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। এই শিশুরা নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আত্মপরিচয়ের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আর সেই নীরবতার মাঝেই তারা অপেক্ষা করছে এমন এক ভবিষ্যতের, যা ক্রমশই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
সবচেয়ে বড় সংকট হারিয়ে যাওয়া শৈশব: রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবিক বিপর্যয়গুলোর একটি। প্রায় এক মিলিয়ন শরণার্থী, যাদের অর্ধেকই শিশু, মিয়ানমারের নির্মম সামরিক নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে হাজার হাজার শিশু এমন একটি জীবনে আটকে রয়েছে যেখানে তাদের শৈশব কেটে যাচ্ছে শিবিরের ভিড়ে, দৈনন্দিন বেঁচে থাকার সংগ্রামে।
কক্সবাজারে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা শিশু অস্থায়ী ত্রিপলের ঘরে বাস করে, যেখানে প্রতিনিয়ত খাদ্য, পানি এবং নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আগুন এবং সহিংসতার হুমকি তাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা। তবে সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হল শিক্ষা এবং উন্নতির সুযোগের অভাব।
বারো বছর বয়সি শাকিরা বিবি, যিনি একজন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তিনি এই শিশুদেরই প্রতিচ্ছবি। শাকিরার মতো হাজার হাজার শিশু শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে। তাদের স্কুলের ব্যবস্থা পুরোনো মিয়ানমার পাঠ্যক্রমের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা শরণার্থী জীবনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আর এই পাঠ্যক্রম, যা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি, তাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়।
শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষকদেরও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। জনাকীর্ণ শ্রেণিকক্ষ, যেখানে শিশুদের বসার জায়গা পর্যন্ত নেই, শিক্ষার পরিবেশকে আরও খারাপ করে তুলছে। ফলে বহু শিশুর কাছে স্কুলে যাওয়া কেবলই অধরা এক স্বপ্ন হয়ে উঠেছে।
পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্য সংকট: শিক্ষার ক্ষেত্রে যে দুর্দশা, তা এখানেই শেষ নয়। ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শিশুরা মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। তাদের মধ্যে ৪১ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার। যদিও তারা দিনে তিনবেলা খাবার পাচ্ছে, তবুও সেই খাবার পুষ্টিকর নয়। তাজা ফল, শাকসবজি এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের অভাবে এই শিশুরা খর্বকায়ত্ব, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং নানাবিধ রোগের ঝুঁকিতে পড়ছে। জীবনের প্রথম কয়েক বছরে পুষ্টিহীনতার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকে-মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং তারা কখনোই তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারে না।
পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোর স্বাস্থ্যসেবাও সীমিত। বহু শিশু প্রতিরোধযোগ্য রোগে ভুগছে এবং যথাযথ চিকিৎসার অভাবে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের সংকট নয়, মানসিক স্বাস্থ্যেরও একটি নীরব বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এসব শিশু সহিংসতা, ক্ষতি এবং এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে যা কোনো শিশুরই দেখা উচিত নয়। তারা তাদের বাড়িঘর ধ্বংস হতে দেখেছে, পরিবারের সদস্যদের বিচ্ছিন্ন হতে দেখেছে এবং তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যেতে দেখেছে। কিন্তু এই শিশুদের ট্রমা সামাল দিতে এবং সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে সহায়তার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অনুপস্থিত।
অব্যাহত ভয়, অনিশ্চয়তা এবং বঞ্চনার মধ্যে বসবাসের মানসিক চাপ ব্যাপক। শিশু কল্যাণ বিশেষজ্ঞরা মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার গুরুত্ব জোর দিয়ে বলছেন, তবে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া খুব ধীর এবং অপর্যাপ্ত। এই শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো মোকাবিলা না করলে, আমরা তাদেরকে যুদ্ধ, দারিদ্র্য এবং বাস্তুচ্যুতির ক্ষত নিয়ে এক নিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
শিশুদের নিরাপত্তা একটি স্থায়ী হুমকি: রোহিঙ্গা শিশুদের নিরাপত্তা একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়। ইতোমধ্যেই জনাকীর্ণ এবং খারাপভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা ক্যাম্পগুলো সহিংসতা, পাচার এবং শোষণের উৎসস্থল হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিশুদের ওপর সশস্ত্র হামলার খবর উঠে এসেছে, যার মধ্যে হত্যাকাণ্ড এবং অপহরণের ঘটনাও রয়েছে। অনেক শিশু, যেমন শাকিরার ছোট ভাইবোনেরা, ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পায় না কারণ বাইরে তাদের জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে।
শরণার্থী হিসেবে কোনো বৈধ মর্যাদা না থাকায় এই হুমকি আরও বাড়ছে। রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি হিসেবে রোহিঙ্গা শিশুদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে-শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং শোষণ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারও তারা পাচ্ছে না। বৈধ স্বীকৃতির অভাবে এই শিশুরা পাচার, অল্প বয়সে বিয়ে এবং জোরপূর্বক শ্রমের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। অনেক শিশু পরিবারকে সহায়তা করার জন্য কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, যেমন ১১ বছর বয়সি রশিদ উল্লাহ, যে পরিবারের আয়ের জন্য পান সুপারি বিক্রি করে। কিন্তু বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করা এবং শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া তাদের দুর্ভোগকে দীর্ঘায়িত করে।
অপেক্ষার দীর্ঘ অন্ধকার ভবিষ্যৎ: ওই শিশুদের জন্য ভবিষ্যৎ ক্রমেই আরও অন্ধকারময় হয়ে উঠছে। তারা অতীতের ট্রমা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে আছে। তাদের মধ্যে অনেকেই, যেমন ১৪ বছর বয়সি রিমা, গভীর হতাশা প্রকাশ করে। সে বলে, ‘আমরা জীবন বাঁচাতে পালিয়েছি। কিন্তু আমরা এখনো যুদ্ধের মধ্যে আছি। এখানে আমাদের কোনো জীবনই নেই।’ তার কথায় ক্যাম্পের অসংখ্য শিশুর হৃদয়ের যন্ত্রণা ফুটে ওঠে। তবে ভবিষ্যৎ এভাবে হতে হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব এখানে রয়েছে। শুধু মানবিক সহায়তাই যথেষ্ট নয়। এই শিশুদের শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং আইনি স্বীকৃতি প্রয়োজন। দারিদ্র্য ও বাস্তুচ্যুতির চক্র থেকে মুক্তি পেতে তাদেরকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। তাদের বড় হওয়ার, শেখার এবং স্বপ্ন দেখার সুযোগ দিতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকটের চূড়ান্ত সমাধান হলো তাদের প্রত্যাবাসন। তবে সেই দিন আসা পর্যন্ত, এই শিশুদের ভুলে যাওয়া যাবে না। তাদেরকে অনন্তকাল অপেক্ষার মধ্যে আটকে রাখা যাবে না। এখনই আমাদের কাজ করতে হবে। বিশ্বকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে প্রতিটি রোহিঙ্গা শিশু বেড়ে ওঠার, স্বপ্ন দেখার এবং আবার নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ পায়। তাদের ভবিষ্যৎ আমাদের আজকের পদক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

উদ্বাস্তু শিবিরে জন্ম রোহিঙ্গা শিশুদের বিস্মৃত শৈশব

আপডেট সময় : ০৪:৪৮:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪

নারী ও শিশু ডেস্ক: সাত বছর পার হয়ে গেল। ঠিক এত সময় কেটে গেছে- যখন থেকে লাখো রোহিঙ্গা শিশু মিয়ানমারের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলাদেশে কক্সবাজারের অস্থায়ী শিবিরে এই শিশুরা তাদের পুরো শৈশব কাটিয়েছে; যেন তারা এক অন্তহীন দুঃস্বপ্নের বৃত্তে বন্দি। এই সংকটে জন্ম নেয়া বা ছোট্ট অবস্থায় সীমান্ত পেরিয়ে আসা এই শিশুরা এমন সব ভয়াবহতার সাক্ষী; যা কোনো শিশুর দেখা উচিত নয়। তবুও তাদের ভবিষ্যৎ; যেখানে আশা, স্বপ্ন ও সুযোগ থাকা উচিতÑ এ ভবিষ্যৎ ক্রমেই যেন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
যে শিশু কখনো শান্তি দেখেনি, তার জীবন কেমন হতে পারে? যার কখনো স্থিতিশীল বাড়ির আনন্দ পাওয়া হয়নি? রোহিঙ্গা শিশুদের এই নিষ্ঠুর বাস্তবতায় প্রতিদিন কাটাতে হচ্ছে। তারা এমন একটি রাজনৈতিক সংকটের শিকার, যার জন্য তারা দায়ী নয়, অথচ যার কোনো সমাধানও এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। এই শিশুরা নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আত্মপরিচয়ের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আর সেই নীরবতার মাঝেই তারা অপেক্ষা করছে এমন এক ভবিষ্যতের, যা ক্রমশই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
সবচেয়ে বড় সংকট হারিয়ে যাওয়া শৈশব: রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবিক বিপর্যয়গুলোর একটি। প্রায় এক মিলিয়ন শরণার্থী, যাদের অর্ধেকই শিশু, মিয়ানমারের নির্মম সামরিক নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে হাজার হাজার শিশু এমন একটি জীবনে আটকে রয়েছে যেখানে তাদের শৈশব কেটে যাচ্ছে শিবিরের ভিড়ে, দৈনন্দিন বেঁচে থাকার সংগ্রামে।
কক্সবাজারে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা শিশু অস্থায়ী ত্রিপলের ঘরে বাস করে, যেখানে প্রতিনিয়ত খাদ্য, পানি এবং নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আগুন এবং সহিংসতার হুমকি তাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা। তবে সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হল শিক্ষা এবং উন্নতির সুযোগের অভাব।
বারো বছর বয়সি শাকিরা বিবি, যিনি একজন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তিনি এই শিশুদেরই প্রতিচ্ছবি। শাকিরার মতো হাজার হাজার শিশু শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে। তাদের স্কুলের ব্যবস্থা পুরোনো মিয়ানমার পাঠ্যক্রমের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা শরণার্থী জীবনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আর এই পাঠ্যক্রম, যা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি, তাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়।
শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষকদেরও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। জনাকীর্ণ শ্রেণিকক্ষ, যেখানে শিশুদের বসার জায়গা পর্যন্ত নেই, শিক্ষার পরিবেশকে আরও খারাপ করে তুলছে। ফলে বহু শিশুর কাছে স্কুলে যাওয়া কেবলই অধরা এক স্বপ্ন হয়ে উঠেছে।
পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্য সংকট: শিক্ষার ক্ষেত্রে যে দুর্দশা, তা এখানেই শেষ নয়। ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শিশুরা মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। তাদের মধ্যে ৪১ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার। যদিও তারা দিনে তিনবেলা খাবার পাচ্ছে, তবুও সেই খাবার পুষ্টিকর নয়। তাজা ফল, শাকসবজি এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের অভাবে এই শিশুরা খর্বকায়ত্ব, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং নানাবিধ রোগের ঝুঁকিতে পড়ছে। জীবনের প্রথম কয়েক বছরে পুষ্টিহীনতার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকে-মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং তারা কখনোই তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারে না।
পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোর স্বাস্থ্যসেবাও সীমিত। বহু শিশু প্রতিরোধযোগ্য রোগে ভুগছে এবং যথাযথ চিকিৎসার অভাবে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের সংকট নয়, মানসিক স্বাস্থ্যেরও একটি নীরব বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এসব শিশু সহিংসতা, ক্ষতি এবং এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে যা কোনো শিশুরই দেখা উচিত নয়। তারা তাদের বাড়িঘর ধ্বংস হতে দেখেছে, পরিবারের সদস্যদের বিচ্ছিন্ন হতে দেখেছে এবং তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যেতে দেখেছে। কিন্তু এই শিশুদের ট্রমা সামাল দিতে এবং সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে সহায়তার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অনুপস্থিত।
অব্যাহত ভয়, অনিশ্চয়তা এবং বঞ্চনার মধ্যে বসবাসের মানসিক চাপ ব্যাপক। শিশু কল্যাণ বিশেষজ্ঞরা মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার গুরুত্ব জোর দিয়ে বলছেন, তবে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া খুব ধীর এবং অপর্যাপ্ত। এই শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো মোকাবিলা না করলে, আমরা তাদেরকে যুদ্ধ, দারিদ্র্য এবং বাস্তুচ্যুতির ক্ষত নিয়ে এক নিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
শিশুদের নিরাপত্তা একটি স্থায়ী হুমকি: রোহিঙ্গা শিশুদের নিরাপত্তা একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়। ইতোমধ্যেই জনাকীর্ণ এবং খারাপভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা ক্যাম্পগুলো সহিংসতা, পাচার এবং শোষণের উৎসস্থল হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিশুদের ওপর সশস্ত্র হামলার খবর উঠে এসেছে, যার মধ্যে হত্যাকাণ্ড এবং অপহরণের ঘটনাও রয়েছে। অনেক শিশু, যেমন শাকিরার ছোট ভাইবোনেরা, ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পায় না কারণ বাইরে তাদের জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে।
শরণার্থী হিসেবে কোনো বৈধ মর্যাদা না থাকায় এই হুমকি আরও বাড়ছে। রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি হিসেবে রোহিঙ্গা শিশুদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে-শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং শোষণ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারও তারা পাচ্ছে না। বৈধ স্বীকৃতির অভাবে এই শিশুরা পাচার, অল্প বয়সে বিয়ে এবং জোরপূর্বক শ্রমের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। অনেক শিশু পরিবারকে সহায়তা করার জন্য কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, যেমন ১১ বছর বয়সি রশিদ উল্লাহ, যে পরিবারের আয়ের জন্য পান সুপারি বিক্রি করে। কিন্তু বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করা এবং শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া তাদের দুর্ভোগকে দীর্ঘায়িত করে।
অপেক্ষার দীর্ঘ অন্ধকার ভবিষ্যৎ: ওই শিশুদের জন্য ভবিষ্যৎ ক্রমেই আরও অন্ধকারময় হয়ে উঠছে। তারা অতীতের ট্রমা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে আছে। তাদের মধ্যে অনেকেই, যেমন ১৪ বছর বয়সি রিমা, গভীর হতাশা প্রকাশ করে। সে বলে, ‘আমরা জীবন বাঁচাতে পালিয়েছি। কিন্তু আমরা এখনো যুদ্ধের মধ্যে আছি। এখানে আমাদের কোনো জীবনই নেই।’ তার কথায় ক্যাম্পের অসংখ্য শিশুর হৃদয়ের যন্ত্রণা ফুটে ওঠে। তবে ভবিষ্যৎ এভাবে হতে হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব এখানে রয়েছে। শুধু মানবিক সহায়তাই যথেষ্ট নয়। এই শিশুদের শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং আইনি স্বীকৃতি প্রয়োজন। দারিদ্র্য ও বাস্তুচ্যুতির চক্র থেকে মুক্তি পেতে তাদেরকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। তাদের বড় হওয়ার, শেখার এবং স্বপ্ন দেখার সুযোগ দিতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকটের চূড়ান্ত সমাধান হলো তাদের প্রত্যাবাসন। তবে সেই দিন আসা পর্যন্ত, এই শিশুদের ভুলে যাওয়া যাবে না। তাদেরকে অনন্তকাল অপেক্ষার মধ্যে আটকে রাখা যাবে না। এখনই আমাদের কাজ করতে হবে। বিশ্বকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে প্রতিটি রোহিঙ্গা শিশু বেড়ে ওঠার, স্বপ্ন দেখার এবং আবার নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ পায়। তাদের ভবিষ্যৎ আমাদের আজকের পদক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ