নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতরে বিমান বাহিনীর একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে; আহত ও দগ্ধ হয়েছে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী।
আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর জানিয়েছে, বিমান বাহিনীর ‘এফ-৭ বিজিআই’ প্রশিক্ষণ বিমানটি সোমবার (২১ জুলাই) দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়নের পরপরই বিধ্বস্ত হয়। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় পাইলটসহ ২০ জন নিহত এবং ১৭১ জন আহত হয়েছেন বলেও আইএসপিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়। এই ঘটনার খবর প্রচার হওয়ার পর থেকেই হতাহতদের জন্য পুরো জাতি শোকে স্তব্ধ।
শিশু শিক্ষার্থীদের শোকে স্তব্ধ পুরো জাতি
স্কুলের একটি অ্যাকাডেমিক ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরে যায়। অনেক দূর থেকেও সেখানে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। জ্বলন্ত উড়োজাহাজটির আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল বলেন, বিমানটি একটি ভবনের গেটে আছড়ে পড়ে। সেটি অ্যাকাডেমিক ভবন। সেখানে স্কুলের বাচ্চাদের ক্লাস চলছিল। আগুনে অনেকেই সেখানে দগ্ধ হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে অনেককে স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়। তাদের একটি অংশকে প্রাথমিকভাবে উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল, কুর্মিটোলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। দগ্ধদের অধিকাংশকে পাঠানো হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঘটনাস্থালে সাংবাদিকদের বলেন, তাদের কর্মীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৯ জনের লাশ উদ্ধার করে। অর্ধশতাধিক আহত ও দগ্ধকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক এসেছে। সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। তাদের মধ্যে একজন মৃত। দগ্ধদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। তাদের সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক। নিহতদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালের প্রশাসন শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরা পনের জনকে চিকিৎসা দিয়েছি। তাদের দুইজন শিক্ষক ও বাকিরা শিক্ষার্থী। যাদের কম বার্ন তাদের আমরা এখানে চিকিৎসা দিচ্ছি। কয়েকজন অভজার্ভেশনে আছে। যাদের ৩০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে তাদের বার্ন ইউনিটে রেফার করা হচ্ছে। অল্প আঘাত নিয়ে কয়েকজন এসেছিলেন তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রাইমারি শাখায় বিধ্বস্ত হয়েছে বিমান, ভেতরে ছিল ছোট শিশুরা: রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাথমিক শাখার ঠিক পাশেই সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনার সময় ক্লাস চলছিল প্রাথমিক শ্রেণির শিশুদের। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে স্কুল ভবন। আর ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিক শিশুরা ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে, অনেকেই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে দৌড়ে মাঠে চলে আসে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাইলস্টোন কলেজের মূল ক্যাম্পাসের উত্তর পাশে খেলার মাঠ ঘেঁষা অংশেই বিমানটি পড়ে। পাশেই অবস্থিত প্রাইমারি শাখার ভবন। দুর্ঘটনার পরপরই ছুটে আসেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা। অনেক মা-বাবাকে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সন্তানদের নাম ধরে ডেকে কাঁদতে দেখা যায়।
নাবিলা নামের কলেজ শাখার এক শিক্ষার্থী বলেন, বিকট শব্দ হতেই ক্লাসের শিশুরা ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করে। আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না— কী হয়েছে? জানালার পাশে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল। কিছু শিক্ষার্থী দৌড়ে নিচে নেমে যায়। বাচ্চারা ভেতরেই ছিল। কেউ বের হতে পারেনি। ফারজানা হক নামের এক অভিভাবক বলেন, হঠাৎ একটা বড় আওয়াজ হলো। তাকিয়ে দেখি ধোঁয়া উঠছে। স্কুলের পাশেই আগুন আর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল। শিশুদের কাঁদতে দেখেছি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মহিদুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পরপরই এলাকার নিরাপত্তার বাড়ানো হয়েছে। ছোট-ছোট শিশুদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্কুল কর্তৃপক্ষ একসঙ্গে কাজ করেছে।
সিএমএইচের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন পাইলটের মৃত্যু: রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম মারা গেছেন। দুর্ঘটনার পর তিনি সিএমএইচের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
সোমবার (২১ জুলাই) দুপুর থেকে পাইলটের মৃত্যুর গুঞ্জন শোনা গেলেও বিকেলে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় বলা হয়, পাইলটের মৃত্যুসহ এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ১৯। এর আগে বিমান বিধ্বস্তের পরপর গুরুতর আহত অবস্থায় পাইলট তৌকিরকে সিএমএইচে নেওয়া হয়। ফ্লাইট ল্যাফটেন্যান্ট তৌকির পাবনা ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। এক বছর আগে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের বিষয়ে জানতে জরুরি নম্বর: রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের বিষয়ে যোগাযোগের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরুরি ফোন নম্বর দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। নম্বরগুলো হচ্ছে: ১. মিলিটারি রেসকিউ ব্রিগেড: ০১৭৬৯-০২৪২০২, সিএমএইচ বার্ন ইউনিট: ০১৭৬৯-০১৬০১৯, সিএমএইচ ইমার্জেন্সি: ১০৭৬৯০১৩৩১১। ২. মাইলস্টোন স্কুল: অ্যাডমিন অফিসার: ০১৮১৪-৭৭৪১৩২, ভাইস প্রিন্সিপাল: ০১৭৭১-১১১৭৬৬। ৩. ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ৯৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করা হলে পুলিশের ইমার্জেন্সি সেল থেকে বার্ন ইউনিটগুলোর সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দেওয়া হবে।
মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক: রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং দেশের এই শোকাবহ মুহূর্তে সংহতি প্রকাশে মঙ্গলবার (২২ জুলাই) শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সোমবার (২১ জুলাই) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগামীকাল মঙ্গলবার দেশের সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পাশাপাশি সব সরকারি, বেসরকারি ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশি মিশনেও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। আহত-নিহতদের জন্য দেশের সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।
প্রসঙ্গত, সোমবার দুপুর ১টার পর রাজধানীর উত্তরায় দুর্ঘটনায় পড়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান। বিমানটি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে গিয়ে পড়ে এবং বিধ্বস্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বিমান ও স্কুল ভবনটিতে আগুন ধরে যায়। যে ভবনে এটি বিধ্বস্ত হয় সেখানে বহু স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থী ছিল বলে জানা গেছে। যাদের বেশিরভাগই হতাহত হয়েছে।
দুর্ঘটনার পরপর উদ্ধার অভিযান শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। উত্তরাসহ আশপাশের ৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং হতাহতদের উদ্ধার করা শুরু করে। পরে উদ্ধার অভিযানে যোগ দেয় বিজিবি ও সেনাবাহিনী। বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে হতাহতদের হাসপাতালে নেওয়া হয়।
এ ঘটনায় দগ্ধ অন্তত ৫০ জনকে ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। যারা সবাই গুরুতর দগ্ধ হয়েছে। এছাড়া উত্তরা এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালে আরো বহু দগ্ধ ও আহত শিক্ষার্থী ভর্তি আছে। দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা কত তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে বিকেল ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ১৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। দুপুর ১টা ৬ মিনিটে এটি উড্ডয়ন করে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি উত্তরা মাইলস্টোন কলেজের ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হয়। বিমানটির পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর। তিনি গুরুতর আহত হন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
রাষ্ট্রপতির শোক: রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
সোমবার (২১ জুলাই) বিকেলে এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় রাষ্ট্রপতি নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন।
প্রধান উপদেষ্টা শোক: এ ঘটনায় শোক জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শোক বার্তায় তিনি বলেন, বিমান বাহিনীর এফ-৭বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় আমি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। দুর্ঘটনায় বিমানসেনা ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক-কর্মচারীসহ অন্যান্যদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। জাতির জন্য এটি একটি গভীর বেদনার ক্ষণ।
প্রধান উপদেষ্টার কর্মসূচি স্থগিত: রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই প্রেক্ষাপটে স্থগিত করা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২৫-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল প্রধান উপদেষ্টার। তবে জাতীয় শোক পালনের কারণে অনুষ্ঠানটি স্থগিত করা হয়েছে।