ঢাকা ০৩:০৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫

উড়ে যায় সমঝোতা, মাথা তোলে বিভেদের কাঁটা

  • আপডেট সময় : ০৫:০৩:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫
  • ৮ বার পড়া হয়েছে

জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের বৈঠক- ফাইল ছবি

  • শুভ কিবরিয়া

খুন-খারাপি ঘটছে। বোমা-ককটেল ফাটছে। পুলিশের ভাষ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পারস্পরিক বিভেদও বাড়ছে। শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্র একই অবস্থা। এর মধ্যেই জেলায় জেলায় ডিসি নিয়োগ হচ্ছে, সেটাও ঘটছে মধ্যরাতে। রাজপথে দাবি-দাওয়ার আন্দোলন থামছে না। জাতীয় প্রেসক্লাব কিংবা শহীদ মিনারে গেলেই দেখা যাবে নানা বিষয়ে দাবিদাওয়া তুলে আন্দোলনরতদের ক্রমাগত চলমান কর্মসূচি। ঢাকার রাজপথে হাঁটলেই টের পাওয়া যাবে দেশে উত্তেজনা বাড়ছে।

দেশজুড়ে কোথাও জোর নির্বাচনি হাওয়া না বইলেও কোথাও কোথাও বড় দলের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বিরোধের দেখা মিলছে। এরকম একটা অবস্থায় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দল পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এক দারুণ অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
নির্বাচন সামনে নিয়েও নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।
এই যে অবস্থা যাকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
‘তৈরি করা নাটক’ বলছেন, সেটা আসলে সবারই
ক্ষমতায় যাবার মরিয়া প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ।

বিএনপি চায় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বিষয়ে যে গণভোট হবার কথা সেটা সংসদ নির্বাচনের দিনেই হোক। জামায়াত সেটা চায় না। তারা চায় সংসদ নির্বাচনের আগেই হোক গণভোট। আবার উচ্চকক্ষে সদস্য মনোনয়ন প্রশ্নেও আছে বিরোধ। জামায়াত চায় পিআর বা আনুপাতিক ভোটের হারে উচ্চকক্ষে সদস্য নির্বাচন করা হোক। বিএনপি সেটা চায় না। তারা চায় সংসদের নির্বাচনে পাওয়া আসনের অনুপাতেই উচ্চকক্ষে সদস্য নির্বাচন করা হোক।

সরকার এই বিরোধ মেটাতে আলটিমেটাম দিয়ে বলেছে রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে ফায়সালা না করলে সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে নিজেই তার মতামত দেবে। সেটাই কার্যকর হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্যের আলোচনা শেষে বল এখন সরকার ঠেলে দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই। যদিও অনেকেই বলছেন, তারপরও সরকার তলে তলে একটা সমঝোতার চেষ্টা করছেন। আপসরফা হিসেবে দুই বিবদমান দলের মনরক্ষা হয় এরকম একটা ফর্মুলা আবিষ্কারের চেষ্টা সরকার করছেন। কি সেটা?
ক). গণভোট আর সংসদের নির্বাচন একদিনেই আয়োজন করা।
খ). উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি বা আনুপাতিক ভোটের হারে সদস্য নির্বাচন করা।
অনেকের মত, ঠেলাঠেলি করলেও বিএনপি ও জামায়াত শেষে এই আপসে সাড়া দেবে, নিজেদের স্বার্থেই। বাস্তবে সেটা ঘটে কিনা, নাকি, এসব নিয়েই রাজপথে শক্তিপ্রদর্শনে নামে এই দুই দল ও তাদের জোটসঙ্গীরা সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

সমঝোতা নয় কেন…
রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিশদ ও বছরব্যাপী আলোচনার শেষেও রাজনৈতিক সমঝোতার বদলে রাজনৈতিক বিভাজন বাড়ছে কেন? কেন ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের রক্তক্ষয়ী আত্মদানের পরেও এর অংশীজন বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে পারছে না। বরং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্ররা পরষ্পরবিরোধী অবস্থান নিচ্ছেন।

এর কারণ মূলত আগাম নির্বাচন ও ক্ষমতায় যাবার নিশ্চয়তার লড়াই। আগামী সংসদ নির্বাচনে সবাই ক্ষমতার অংশীজন হতে চান। কেনো দলই বিরোধী দলে যেতে নারাজ। বিএনপি বড় দল হিসাবে ধারণা করছে জনভোটেই তারাই আগামী দিনে নিশ্চিতভাবে সরকার গঠন করতে পারবে। অতীতে বিশেষত ১৯৯১ সালের ভোটের হিসাবে দেখলে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে তারাই ভোটের বড় অংশের দাবিদার। সুতরাং ২৩৭ সংসদীয় আসনে নিজ দলের প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে বাকি ৬৩ আসনে শরিক বা সমমনাদের মনোনয়ন দেবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সরকার গঠনের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী বিএনপি। ফলে তারা যে কোনো মূল্যে যত তাড়াতাড়ি হোক নির্বাচন চায় এবং ক্ষমতায় যেতে চায়। এই যাত্রায় বিএনপি তার একসময়ের শরিক জোটসঙ্গী জামায়াত ইসলামীকে তাদের থেকে দূরে রাখতে চায়।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী আন্দোলন-রাজপথ পেরিয়ে এখন একটা খুব কমফোর্ট জোনে অবস্থান করছে, এরকম একটা রাজনৈতিক আচরণ তাদের প্রকাশ্য। ভোটের হিসাবে তারা যে এগিয়েছে সেটা তাদের রাজনৈতিক আচরণে প্রকাশও করতে চায়। সেটা কিছুটা শক্তিমান হয়েছে, ডাকসু-রাকসু-জাকসু-চাকসুতে ছাত্রসংসদের ভোটে তাদের ছাত্র সংগঠনের বিজয়ে। যদিও বাংলাদেশে ছাত্রসংসদের ভোট আর সারাদেশের সংসদ নির্বাচনের ভোট-রকমে, আকারে, আয়োজনে মোটেই এক নয়।

যদিও ১৯৯১ ও তার পরবর্তীকালে কোনো ভোটেই জনরায় তাদের পক্ষে খুব ঝাঁকিয়ে বসেছে সেটা প্রমাণিত নয়। তারপরও আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে জামায়াত ভোটের মাঠে দাঁও মারতে পারে এরকম একটা আওয়াজ তারা তুলেছে। সেই আওয়াজের মার্কেটিংও সফলভাবে করেছে। বিএনপির আগেই ৩০০ আসনের প্রার্থী ঠিকঠাক করে তাদের নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে রেখেছে। ক্ষমতার অংশীজন হবার স্বপ্নঘোরে মাতোয়ারা এখন জামায়াত।

ছাত্রদের রাজনৈতিক দল এনসিপি এখন পর্যন্ত কোনো জোটের বাতাস গায়ে লাগায়নি। যদিও বিএনপি বা জামায়াত দুই দলের সঙ্গেই নানাভাবে জোট ও ভোটের সমীকরণের অংক মেলানোর চেষ্টা তারা করেছে বলে আওয়াজ উঠেছে। কিন্তু অংকে মিলছে না। ফলে, শাপলাকলি প্রতীক পেয়ে আপাতত সন্তুষ্ট এনসিপি একাই একশো হয়ে ভোটের মাঠে একক প্রার্থী দেবার কথা ঘোষণা করেছে।

কিন্তু যেসব দল ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে হাতে হাতে রেখে মাঠে থেকেছে, তারা এখন আলাদা আলাদা হয়ে পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

এককথায়, সবাই ক্ষমতার অংশীজন হতে চায়। কোন দলই এখন আর ক্ষমতার বাইরে, এমনকি বিরোধী দলেও থাকতে চায় না।

আওয়ামী লীগ, তার শরিক ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা বা অনুপস্থিতি এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে, মাঠে থাকা সকল রাজনৈতিক দলই ভাবছে তারা সরকারে থাকবে। যেসব ছোট দল ব্যক্তিসর্বস্ব, সেসব ছোট দলের বড় নেতারাও এখন জোটের ছায়ায় সরকারের অংশীজন হতে মরিয়া। বিএনপির অঘোষিত, প্রার্থী না দেওয়া ৬৩ সংসদীয় আসন এখন তাদের লক্ষ্য।

কাজেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এক দারুণ অচলাবস্থা বিরাজ করছে। নির্বাচন সামনে নিয়েও নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। এই যে অবস্থা যাকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘তৈরি করা নাটক’ বলছেন, সেটা আসলে সবারই ক্ষমতায় যাবার মরিয়া প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ। এমনকি খোদ মির্জা সাহেবের দলের অনেক নেতার বোলচালেও সেই ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী নেশাঘোর আচরণ প্রকাশ পাচ্ছে। কেউ কেউ দলীয় সভায় দলের প্রধানের নাম বলতে গিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসকের নাম উচ্চারণও করে ফেলছে, কেউ কেউ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে উত্তেজনায় জাতীয়তাবাদী ঘোলও খাচ্ছে।
এসবই হচ্ছে ক্ষমতায় যাবার নিশ্চিত স্বপ্নঘোর।

ভোটের হিসাব ও স্বপ্নফানুস…
বাস্তবে কোন দলের ভোটবেজ কী, ভোটব্যাংকের আসনওয়ারী সাইজ কি, সেটা অনুমানমাত্র। হাতে কোন বাস্তব এবং হালনাগাদ ডাটা নেই। কোনো দলেরই ভোটব্যাংকের কোনো সঠিক অনুমান নেই। থাকার সুযোগও নেই। গত কয়েক দশকে সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাবে এই তথ্য জানার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে।

এবার মোট ভোটার প্রায় ১২ কোটি ৫০ লাখের মত। মোট ভোটারের একটা বড় অংশ প্রায় ৪ কোটি ভোটার প্রথমবারের মত ভোট দেবেন। এই জেনজি ভোটাররা দল দেখে, না প্রতীক দেখে, না প্রার্থী দেখে ভোট দেবে, সে বিষয়ে অনুমান করার কোনো সুযোগ নেই।

কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের একটা বড় অংশ ভোটের বাইরে থাকলেও যে অংশটি ভোটের মাঠে থাকবে, তাদের সম্মিলিত ভোটও নির্বাচনি ফলাফলে বাড়তি প্রভাব রাখতে সক্ষম হতে পারে। কিন্তু এই ভোটের কোনো সম্মিলিত অবয়ব হবার চাইতে এই ভোট আসন ভেদে, প্রার্থীভেদে, অঞ্চলভেদে নিজস্ব অস্তিত্ব সুরক্ষার্থেই ব্যবহৃত হবে। এই ভোট দল, অঞ্চল, প্রার্থী ভেদে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভাজিত হবে। ফলে এই ভোটারদের কোন কালেকটিভ প্রভাব এই নির্বাচনে থাকার সুযোগ কম। এই খণ্ডিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ ভোটের প্রভাব প্রার্থীভেদে, আসনভেদে কিভাবে প্রভাব রাখবে সেটা পূর্বানুমান করা প্রায় অসম্ভব।

এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বড় আকারে প্রভাব ফেলতে পারে। বড় দলের মনোনয়ন বঞ্চিত অনেক নেতাকে যেমন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে দেখা যেতে পারে তেমনি অনেক নতুন মানুষও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে আবির্ভূত হতে পারেন। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বহু সম্ভাবনাময় দলীয় প্রার্থীর ভোটজীবনে সর্বনাশ ডেকে আনতে পারেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেককেই ডামি প্রার্থী হিসাবে মাঠে দেখা যেতে পারে। তারা কোন দলীয় প্রার্থীর জন্য আশীর্বাদ, কারও জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিতে পারেন।

রাজনৈতিক অহমিকা এবং….
বাস্তবে ভোট সম্পর্কে হাতের কাছে কোন রিয়েল ভোটডাটার অভাবই রাজনৈতিক দলগুলোকে অহংকারী করে তুলছে। বিগত এক দশকে রাজনৈতিক দলগুলোর নতুন সদস্য রিক্রুটিং সম্পর্কেও কোনো বাস্তব বা হালনাগাদ তথ্য নেই। ফলে সবাই হাওয়াতে ভাসছেন। সে কারণে কথিত বড়, ছোট সব রাজনৈতিক দলকেই হাওয়ার ওপর ভরসা করে নিজেদের ভোটের হিসাব করতে দেখা যাচ্ছে। দেশ, সংবিধান, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক ঐকমত্য সম্পর্কে গত এক বছরে মিডিয়ায় বড় বড় কথা বলে অনেকেই ধারণা করছেন টকশো এবং মিডিয়ার কল্যাণে তারা জনরাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছেন। ফলে সবাই তাদের যেমন চেনেন, জানেন, সেইরকম ভাবেই ভোটের বাক্সেও তাদের প্রতি জনসমর্থনের প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটবে, না, ঠিক তার উল্টো ঘটবে, সেটা ঠাওর করতে না পারার কারণেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন সম্পর্কে একটা বাড়তি অহমিকায় ভুগছেন। সেটাই তাদের নানা ইস্যুতে অহঙ্কারী করে তুলছে।
এই ভুল ও আহমিকাপূর্ণ প্রবণতা পরিহার করতে না পারলে দুটো সর্বনাশ ঘটতে পারে।
এক. নির্বাচনের পূর্বেই রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ ও বিবাদ সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনাকে সুদূর-পরাহত করে তুলতে পারে।

দুই. ফ্যাসিবাদী শক্তি নানা উপায়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বিশৃঙ্খল করে তুলে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

সানা/আপ্র/১১/১১/২০২৫

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

উড়ে যায় সমঝোতা, মাথা তোলে বিভেদের কাঁটা

আপডেট সময় : ০৫:০৩:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫
  • শুভ কিবরিয়া

খুন-খারাপি ঘটছে। বোমা-ককটেল ফাটছে। পুলিশের ভাষ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পারস্পরিক বিভেদও বাড়ছে। শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্র একই অবস্থা। এর মধ্যেই জেলায় জেলায় ডিসি নিয়োগ হচ্ছে, সেটাও ঘটছে মধ্যরাতে। রাজপথে দাবি-দাওয়ার আন্দোলন থামছে না। জাতীয় প্রেসক্লাব কিংবা শহীদ মিনারে গেলেই দেখা যাবে নানা বিষয়ে দাবিদাওয়া তুলে আন্দোলনরতদের ক্রমাগত চলমান কর্মসূচি। ঢাকার রাজপথে হাঁটলেই টের পাওয়া যাবে দেশে উত্তেজনা বাড়ছে।

দেশজুড়ে কোথাও জোর নির্বাচনি হাওয়া না বইলেও কোথাও কোথাও বড় দলের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বিরোধের দেখা মিলছে। এরকম একটা অবস্থায় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দল পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এক দারুণ অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
নির্বাচন সামনে নিয়েও নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।
এই যে অবস্থা যাকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
‘তৈরি করা নাটক’ বলছেন, সেটা আসলে সবারই
ক্ষমতায় যাবার মরিয়া প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ।

বিএনপি চায় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বিষয়ে যে গণভোট হবার কথা সেটা সংসদ নির্বাচনের দিনেই হোক। জামায়াত সেটা চায় না। তারা চায় সংসদ নির্বাচনের আগেই হোক গণভোট। আবার উচ্চকক্ষে সদস্য মনোনয়ন প্রশ্নেও আছে বিরোধ। জামায়াত চায় পিআর বা আনুপাতিক ভোটের হারে উচ্চকক্ষে সদস্য নির্বাচন করা হোক। বিএনপি সেটা চায় না। তারা চায় সংসদের নির্বাচনে পাওয়া আসনের অনুপাতেই উচ্চকক্ষে সদস্য নির্বাচন করা হোক।

সরকার এই বিরোধ মেটাতে আলটিমেটাম দিয়ে বলেছে রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে ফায়সালা না করলে সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে নিজেই তার মতামত দেবে। সেটাই কার্যকর হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্যের আলোচনা শেষে বল এখন সরকার ঠেলে দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই। যদিও অনেকেই বলছেন, তারপরও সরকার তলে তলে একটা সমঝোতার চেষ্টা করছেন। আপসরফা হিসেবে দুই বিবদমান দলের মনরক্ষা হয় এরকম একটা ফর্মুলা আবিষ্কারের চেষ্টা সরকার করছেন। কি সেটা?
ক). গণভোট আর সংসদের নির্বাচন একদিনেই আয়োজন করা।
খ). উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি বা আনুপাতিক ভোটের হারে সদস্য নির্বাচন করা।
অনেকের মত, ঠেলাঠেলি করলেও বিএনপি ও জামায়াত শেষে এই আপসে সাড়া দেবে, নিজেদের স্বার্থেই। বাস্তবে সেটা ঘটে কিনা, নাকি, এসব নিয়েই রাজপথে শক্তিপ্রদর্শনে নামে এই দুই দল ও তাদের জোটসঙ্গীরা সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

সমঝোতা নয় কেন…
রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিশদ ও বছরব্যাপী আলোচনার শেষেও রাজনৈতিক সমঝোতার বদলে রাজনৈতিক বিভাজন বাড়ছে কেন? কেন ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের রক্তক্ষয়ী আত্মদানের পরেও এর অংশীজন বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে পারছে না। বরং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্ররা পরষ্পরবিরোধী অবস্থান নিচ্ছেন।

এর কারণ মূলত আগাম নির্বাচন ও ক্ষমতায় যাবার নিশ্চয়তার লড়াই। আগামী সংসদ নির্বাচনে সবাই ক্ষমতার অংশীজন হতে চান। কেনো দলই বিরোধী দলে যেতে নারাজ। বিএনপি বড় দল হিসাবে ধারণা করছে জনভোটেই তারাই আগামী দিনে নিশ্চিতভাবে সরকার গঠন করতে পারবে। অতীতে বিশেষত ১৯৯১ সালের ভোটের হিসাবে দেখলে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে তারাই ভোটের বড় অংশের দাবিদার। সুতরাং ২৩৭ সংসদীয় আসনে নিজ দলের প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে বাকি ৬৩ আসনে শরিক বা সমমনাদের মনোনয়ন দেবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সরকার গঠনের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী বিএনপি। ফলে তারা যে কোনো মূল্যে যত তাড়াতাড়ি হোক নির্বাচন চায় এবং ক্ষমতায় যেতে চায়। এই যাত্রায় বিএনপি তার একসময়ের শরিক জোটসঙ্গী জামায়াত ইসলামীকে তাদের থেকে দূরে রাখতে চায়।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী আন্দোলন-রাজপথ পেরিয়ে এখন একটা খুব কমফোর্ট জোনে অবস্থান করছে, এরকম একটা রাজনৈতিক আচরণ তাদের প্রকাশ্য। ভোটের হিসাবে তারা যে এগিয়েছে সেটা তাদের রাজনৈতিক আচরণে প্রকাশও করতে চায়। সেটা কিছুটা শক্তিমান হয়েছে, ডাকসু-রাকসু-জাকসু-চাকসুতে ছাত্রসংসদের ভোটে তাদের ছাত্র সংগঠনের বিজয়ে। যদিও বাংলাদেশে ছাত্রসংসদের ভোট আর সারাদেশের সংসদ নির্বাচনের ভোট-রকমে, আকারে, আয়োজনে মোটেই এক নয়।

যদিও ১৯৯১ ও তার পরবর্তীকালে কোনো ভোটেই জনরায় তাদের পক্ষে খুব ঝাঁকিয়ে বসেছে সেটা প্রমাণিত নয়। তারপরও আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে জামায়াত ভোটের মাঠে দাঁও মারতে পারে এরকম একটা আওয়াজ তারা তুলেছে। সেই আওয়াজের মার্কেটিংও সফলভাবে করেছে। বিএনপির আগেই ৩০০ আসনের প্রার্থী ঠিকঠাক করে তাদের নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে রেখেছে। ক্ষমতার অংশীজন হবার স্বপ্নঘোরে মাতোয়ারা এখন জামায়াত।

ছাত্রদের রাজনৈতিক দল এনসিপি এখন পর্যন্ত কোনো জোটের বাতাস গায়ে লাগায়নি। যদিও বিএনপি বা জামায়াত দুই দলের সঙ্গেই নানাভাবে জোট ও ভোটের সমীকরণের অংক মেলানোর চেষ্টা তারা করেছে বলে আওয়াজ উঠেছে। কিন্তু অংকে মিলছে না। ফলে, শাপলাকলি প্রতীক পেয়ে আপাতত সন্তুষ্ট এনসিপি একাই একশো হয়ে ভোটের মাঠে একক প্রার্থী দেবার কথা ঘোষণা করেছে।

কিন্তু যেসব দল ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে হাতে হাতে রেখে মাঠে থেকেছে, তারা এখন আলাদা আলাদা হয়ে পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

এককথায়, সবাই ক্ষমতার অংশীজন হতে চায়। কোন দলই এখন আর ক্ষমতার বাইরে, এমনকি বিরোধী দলেও থাকতে চায় না।

আওয়ামী লীগ, তার শরিক ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা বা অনুপস্থিতি এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে, মাঠে থাকা সকল রাজনৈতিক দলই ভাবছে তারা সরকারে থাকবে। যেসব ছোট দল ব্যক্তিসর্বস্ব, সেসব ছোট দলের বড় নেতারাও এখন জোটের ছায়ায় সরকারের অংশীজন হতে মরিয়া। বিএনপির অঘোষিত, প্রার্থী না দেওয়া ৬৩ সংসদীয় আসন এখন তাদের লক্ষ্য।

কাজেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এক দারুণ অচলাবস্থা বিরাজ করছে। নির্বাচন সামনে নিয়েও নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। এই যে অবস্থা যাকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘তৈরি করা নাটক’ বলছেন, সেটা আসলে সবারই ক্ষমতায় যাবার মরিয়া প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ। এমনকি খোদ মির্জা সাহেবের দলের অনেক নেতার বোলচালেও সেই ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী নেশাঘোর আচরণ প্রকাশ পাচ্ছে। কেউ কেউ দলীয় সভায় দলের প্রধানের নাম বলতে গিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসকের নাম উচ্চারণও করে ফেলছে, কেউ কেউ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে উত্তেজনায় জাতীয়তাবাদী ঘোলও খাচ্ছে।
এসবই হচ্ছে ক্ষমতায় যাবার নিশ্চিত স্বপ্নঘোর।

ভোটের হিসাব ও স্বপ্নফানুস…
বাস্তবে কোন দলের ভোটবেজ কী, ভোটব্যাংকের আসনওয়ারী সাইজ কি, সেটা অনুমানমাত্র। হাতে কোন বাস্তব এবং হালনাগাদ ডাটা নেই। কোনো দলেরই ভোটব্যাংকের কোনো সঠিক অনুমান নেই। থাকার সুযোগও নেই। গত কয়েক দশকে সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাবে এই তথ্য জানার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে।

এবার মোট ভোটার প্রায় ১২ কোটি ৫০ লাখের মত। মোট ভোটারের একটা বড় অংশ প্রায় ৪ কোটি ভোটার প্রথমবারের মত ভোট দেবেন। এই জেনজি ভোটাররা দল দেখে, না প্রতীক দেখে, না প্রার্থী দেখে ভোট দেবে, সে বিষয়ে অনুমান করার কোনো সুযোগ নেই।

কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের একটা বড় অংশ ভোটের বাইরে থাকলেও যে অংশটি ভোটের মাঠে থাকবে, তাদের সম্মিলিত ভোটও নির্বাচনি ফলাফলে বাড়তি প্রভাব রাখতে সক্ষম হতে পারে। কিন্তু এই ভোটের কোনো সম্মিলিত অবয়ব হবার চাইতে এই ভোট আসন ভেদে, প্রার্থীভেদে, অঞ্চলভেদে নিজস্ব অস্তিত্ব সুরক্ষার্থেই ব্যবহৃত হবে। এই ভোট দল, অঞ্চল, প্রার্থী ভেদে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভাজিত হবে। ফলে এই ভোটারদের কোন কালেকটিভ প্রভাব এই নির্বাচনে থাকার সুযোগ কম। এই খণ্ডিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ ভোটের প্রভাব প্রার্থীভেদে, আসনভেদে কিভাবে প্রভাব রাখবে সেটা পূর্বানুমান করা প্রায় অসম্ভব।

এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বড় আকারে প্রভাব ফেলতে পারে। বড় দলের মনোনয়ন বঞ্চিত অনেক নেতাকে যেমন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে দেখা যেতে পারে তেমনি অনেক নতুন মানুষও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে আবির্ভূত হতে পারেন। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বহু সম্ভাবনাময় দলীয় প্রার্থীর ভোটজীবনে সর্বনাশ ডেকে আনতে পারেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেককেই ডামি প্রার্থী হিসাবে মাঠে দেখা যেতে পারে। তারা কোন দলীয় প্রার্থীর জন্য আশীর্বাদ, কারও জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিতে পারেন।

রাজনৈতিক অহমিকা এবং….
বাস্তবে ভোট সম্পর্কে হাতের কাছে কোন রিয়েল ভোটডাটার অভাবই রাজনৈতিক দলগুলোকে অহংকারী করে তুলছে। বিগত এক দশকে রাজনৈতিক দলগুলোর নতুন সদস্য রিক্রুটিং সম্পর্কেও কোনো বাস্তব বা হালনাগাদ তথ্য নেই। ফলে সবাই হাওয়াতে ভাসছেন। সে কারণে কথিত বড়, ছোট সব রাজনৈতিক দলকেই হাওয়ার ওপর ভরসা করে নিজেদের ভোটের হিসাব করতে দেখা যাচ্ছে। দেশ, সংবিধান, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক ঐকমত্য সম্পর্কে গত এক বছরে মিডিয়ায় বড় বড় কথা বলে অনেকেই ধারণা করছেন টকশো এবং মিডিয়ার কল্যাণে তারা জনরাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছেন। ফলে সবাই তাদের যেমন চেনেন, জানেন, সেইরকম ভাবেই ভোটের বাক্সেও তাদের প্রতি জনসমর্থনের প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটবে, না, ঠিক তার উল্টো ঘটবে, সেটা ঠাওর করতে না পারার কারণেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন সম্পর্কে একটা বাড়তি অহমিকায় ভুগছেন। সেটাই তাদের নানা ইস্যুতে অহঙ্কারী করে তুলছে।
এই ভুল ও আহমিকাপূর্ণ প্রবণতা পরিহার করতে না পারলে দুটো সর্বনাশ ঘটতে পারে।
এক. নির্বাচনের পূর্বেই রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ ও বিবাদ সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনাকে সুদূর-পরাহত করে তুলতে পারে।

দুই. ফ্যাসিবাদী শক্তি নানা উপায়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বিশৃঙ্খল করে তুলে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

সানা/আপ্র/১১/১১/২০২৫