ঢাকা ০১:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

উজিরপুরের ইতিহাস : ধামুরায় ধর্মপ্রচারক মাহমুদ ইদ্রাক

  • আপডেট সময় : ০৮:৩৮:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ৯৬ বার পড়া হয়েছে

মোয়াজ্জেম হোসেন

বর্তমান (২০২৪) বরিশাল জেলার উজিরপুর একটি পুরনো জনপদ। বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ যখন এ এলাকার নাম তখন উজিরপুর, গৌরনদী, বাবুগঞ্জ, কোটালিপাড়া ছিল মূল ভূখণ্ড। তখন বরিশাল বা বাখেরগঞ্জসহ পটুয়াখালী-বরগুনার অস্তিত্ব ছিল ‘এই ডোবে-এই জাগে’ এমন চর। সুগন্ধা নদী বেষ্টিত বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী ছিল মাধবপাশা, কোটাইলপাড়া, বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠিতে। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সাথে সাথে চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী সদর বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত হয়। তৎকালে সুগন্ধা নদীর তীরে নলছিটিতেও ছিল এক সময় রাজধানী। মোট কথা- উজিরপুর-গৌরনদী এই পুরনো জনপদেই জনবসতি গড়ে উঠে প্রথম দিকে।

যেসব ভিন্নভাষী অবাঙালি ধর্মপ্রচারকদের প্রাচীন বঙ্গে আগমন ঘটেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল পির মাহমুদ ইদ্রাক। মোগল আমলে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁনের সফর সঙ্গী হিসাবে এই মহান বুজর্গ ব্যক্তির বাকলায় আগমন ঘটে।

পীর মাহমুদ ইদ্রাকের আগমনের সাথে সাথে এ এলাকায় ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে। এই খবর নবাব আলিবর্দী খাঁনের কাছে পৌঁছালে নবাব এতে পীর মাহমুদ ইদ্রাকের উপর সন্তষ্ট হন এবং তাকে এতদাঞ্চলের জমিদারি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই পীর মাহমুদ ইদ্রাক (১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে) বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার ধামুরা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। যাহা তখনকার বাকলার ইদ্রাকপুর পরগোনার ৮১৩নং তৌজি ভুক্ত।

ইদ্রাকপুর পরগনার নাম অনুসারে এই মহান বুজুর্গ ব্যক্তির নামের শেষে ইদ্রাক শব্দটি যুক্ত হয়েছে, নাকি ইদ্রাকের নাম অনুসারে ইদ্রাকপুর পরগনা হয়েছে তা সঠিকভাবে উল্লেখ না থাকলেও, নবাব আলীবর্দী খানের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হওয়ার কারণেই তিনি ইদ্রাকপুর পরগনার জমিদারি লাভ করেছিলেন এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নাই।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সিরাজউদ্দীন আহমেদ তার বরিশাল বিভাগের ইতিহাসের প্রথম খণ্ডে পীর মাহমুদ ইদ্রাকের নাম অনুসারে বাকলার একটি পরগনার নাম ইদ্রাকপুর রাখা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন। পীর মাহমুদ ইদ্রাক ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধামুরায় বসতি স্থাপন করার পর থেকে একই স্থানে ছিলেন বলে বহু সুত্র থেকে জানা গেছে। এখন তাদের ৭ম বংশধরের অনেকেই ধামুরার
মিঞা বাড়িতে বসবাস করছেন বলে জানা গেছে।

পীর মাহমুদ ইদ্রাক জমিদারি প্রাপ্তির পর, প্রজাসাধারণের সাথে যোগাযোগ ও ইসলাম প্রচারের সুবিদার্থে তখনকার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নদীকুলবর্তী (বর্তমান কচা নদী) এলাকায় হুজরাখানা স্থাপন করেছিলেন।

বর্তমানে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও সংকোচনের ফলে, তার হুজরাখানা ও মাজারটি নদীর পশ্চিমপ্রান্তে ধামুরা মূল বন্দরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। বর্তমানে মাজার সংলগ্ন মাহমুদ ইদ্রাকের নামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ও চালু আছে। এলাকার বিশিষ্ট সমাজ সেবক পল্লী চিকিৎসক বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আ,ন,ম আ: হাকিম এর প্রতিষ্ঠাতা।

পীর মাহমুদ ইদ্রাকের ইন্তেকালের পর তার পূর্বের ওসিয়ত মোতাবেক তার অনুসারীগণ তাকে নদীর প্রান্তে তার হুজরাখানা সংলগ্ন স্থানে দাফন করেন। বর্তমানে যাহা মিঞার মাজার নামে পরিচিত। মাজারটিকে ঘিরে এলাকায় অনেক সুনাম রয়েছে। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন মাজার চত্বরে আসেন এবং মানত করলে সবার মনোবাসনাই পূর্ণ হয়।

মাজারের মূল খাদেম গোলাম নবী ফকির বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ থাকায় তার ছেলে ছিদ্দিকুর রহমান ফকির বর্তমানে খাদেমের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি জানান যে, এই মাজারে কখনও কোনো গানবাজনা বা অনৈসলামিক কার্যকলাপ অনুষ্ঠিত হয় না।

বর্তমান ধামুরা-ওটরা-সাতলা সড়কসংলগ্ন ধামুরা ডিগ্রি কলেজের সাথেই পীর মাহমুদ ইদ্রাকের বসতবাড়ি, যাহা মিঞা বাড়ি নামে পরিচিত। পীর মাহমুদ ইদ্রাকের বংশধররা এখনও ঐ বাড়িতে বসবাস করছেন। তার বংশধরের ষষ্ঠ পুরুষের মোতালেব মিঞা (৯০) জানান, তাদের বাড়ির প্রধান ফটকে পীর মাহমুদ ইদ্রাক খচিত নামফলক ছিল, যা তিনি নিজে দেখেছেন। কালের পরিক্রমায় এই স্মৃতিচিহ্ন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বাড়ির দরজায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পীর মাহমুদ ইদ্রাকের নামে একখানা জামে মসজিদ।

বর্তমানে মাজারটি পরিচালনা পরিষদের পূর্ণাঙ্গ কমিটির গঠনের কাজ চলছে। পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে মাজারের উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে মাজার সংশ্লিষ্টরা জানান। প্রয়োজনীয় অর্থ, পাওয়া গেলে, বাকলায় ইসলাম প্রচারের অন্যতম ধর্ম প্রচারক পীর মাহমুদ ইদ্রাকের নাম পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

মেঘনার মুক্তি চেয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে ২৭ বিশিষ্ট নারীর স্মারকলিপি

উজিরপুরের ইতিহাস : ধামুরায় ধর্মপ্রচারক মাহমুদ ইদ্রাক

আপডেট সময় : ০৮:৩৮:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

মোয়াজ্জেম হোসেন

বর্তমান (২০২৪) বরিশাল জেলার উজিরপুর একটি পুরনো জনপদ। বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ যখন এ এলাকার নাম তখন উজিরপুর, গৌরনদী, বাবুগঞ্জ, কোটালিপাড়া ছিল মূল ভূখণ্ড। তখন বরিশাল বা বাখেরগঞ্জসহ পটুয়াখালী-বরগুনার অস্তিত্ব ছিল ‘এই ডোবে-এই জাগে’ এমন চর। সুগন্ধা নদী বেষ্টিত বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী ছিল মাধবপাশা, কোটাইলপাড়া, বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠিতে। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সাথে সাথে চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী সদর বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত হয়। তৎকালে সুগন্ধা নদীর তীরে নলছিটিতেও ছিল এক সময় রাজধানী। মোট কথা- উজিরপুর-গৌরনদী এই পুরনো জনপদেই জনবসতি গড়ে উঠে প্রথম দিকে।

যেসব ভিন্নভাষী অবাঙালি ধর্মপ্রচারকদের প্রাচীন বঙ্গে আগমন ঘটেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল পির মাহমুদ ইদ্রাক। মোগল আমলে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁনের সফর সঙ্গী হিসাবে এই মহান বুজর্গ ব্যক্তির বাকলায় আগমন ঘটে।

পীর মাহমুদ ইদ্রাকের আগমনের সাথে সাথে এ এলাকায় ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে। এই খবর নবাব আলিবর্দী খাঁনের কাছে পৌঁছালে নবাব এতে পীর মাহমুদ ইদ্রাকের উপর সন্তষ্ট হন এবং তাকে এতদাঞ্চলের জমিদারি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই পীর মাহমুদ ইদ্রাক (১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে) বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার ধামুরা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। যাহা তখনকার বাকলার ইদ্রাকপুর পরগোনার ৮১৩নং তৌজি ভুক্ত।

ইদ্রাকপুর পরগনার নাম অনুসারে এই মহান বুজুর্গ ব্যক্তির নামের শেষে ইদ্রাক শব্দটি যুক্ত হয়েছে, নাকি ইদ্রাকের নাম অনুসারে ইদ্রাকপুর পরগনা হয়েছে তা সঠিকভাবে উল্লেখ না থাকলেও, নবাব আলীবর্দী খানের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হওয়ার কারণেই তিনি ইদ্রাকপুর পরগনার জমিদারি লাভ করেছিলেন এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নাই।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সিরাজউদ্দীন আহমেদ তার বরিশাল বিভাগের ইতিহাসের প্রথম খণ্ডে পীর মাহমুদ ইদ্রাকের নাম অনুসারে বাকলার একটি পরগনার নাম ইদ্রাকপুর রাখা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন। পীর মাহমুদ ইদ্রাক ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধামুরায় বসতি স্থাপন করার পর থেকে একই স্থানে ছিলেন বলে বহু সুত্র থেকে জানা গেছে। এখন তাদের ৭ম বংশধরের অনেকেই ধামুরার
মিঞা বাড়িতে বসবাস করছেন বলে জানা গেছে।

পীর মাহমুদ ইদ্রাক জমিদারি প্রাপ্তির পর, প্রজাসাধারণের সাথে যোগাযোগ ও ইসলাম প্রচারের সুবিদার্থে তখনকার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নদীকুলবর্তী (বর্তমান কচা নদী) এলাকায় হুজরাখানা স্থাপন করেছিলেন।

বর্তমানে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও সংকোচনের ফলে, তার হুজরাখানা ও মাজারটি নদীর পশ্চিমপ্রান্তে ধামুরা মূল বন্দরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। বর্তমানে মাজার সংলগ্ন মাহমুদ ইদ্রাকের নামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ও চালু আছে। এলাকার বিশিষ্ট সমাজ সেবক পল্লী চিকিৎসক বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আ,ন,ম আ: হাকিম এর প্রতিষ্ঠাতা।

পীর মাহমুদ ইদ্রাকের ইন্তেকালের পর তার পূর্বের ওসিয়ত মোতাবেক তার অনুসারীগণ তাকে নদীর প্রান্তে তার হুজরাখানা সংলগ্ন স্থানে দাফন করেন। বর্তমানে যাহা মিঞার মাজার নামে পরিচিত। মাজারটিকে ঘিরে এলাকায় অনেক সুনাম রয়েছে। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন মাজার চত্বরে আসেন এবং মানত করলে সবার মনোবাসনাই পূর্ণ হয়।

মাজারের মূল খাদেম গোলাম নবী ফকির বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ থাকায় তার ছেলে ছিদ্দিকুর রহমান ফকির বর্তমানে খাদেমের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি জানান যে, এই মাজারে কখনও কোনো গানবাজনা বা অনৈসলামিক কার্যকলাপ অনুষ্ঠিত হয় না।

বর্তমান ধামুরা-ওটরা-সাতলা সড়কসংলগ্ন ধামুরা ডিগ্রি কলেজের সাথেই পীর মাহমুদ ইদ্রাকের বসতবাড়ি, যাহা মিঞা বাড়ি নামে পরিচিত। পীর মাহমুদ ইদ্রাকের বংশধররা এখনও ঐ বাড়িতে বসবাস করছেন। তার বংশধরের ষষ্ঠ পুরুষের মোতালেব মিঞা (৯০) জানান, তাদের বাড়ির প্রধান ফটকে পীর মাহমুদ ইদ্রাক খচিত নামফলক ছিল, যা তিনি নিজে দেখেছেন। কালের পরিক্রমায় এই স্মৃতিচিহ্ন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বাড়ির দরজায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পীর মাহমুদ ইদ্রাকের নামে একখানা জামে মসজিদ।

বর্তমানে মাজারটি পরিচালনা পরিষদের পূর্ণাঙ্গ কমিটির গঠনের কাজ চলছে। পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে মাজারের উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে মাজার সংশ্লিষ্টরা জানান। প্রয়োজনীয় অর্থ, পাওয়া গেলে, বাকলায় ইসলাম প্রচারের অন্যতম ধর্ম প্রচারক পীর মাহমুদ ইদ্রাকের নাম পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ