প্রত্যাশা ডেস্ক: তিন দশকেরও বেশি সময়জুড়ে দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদে নিষিদ্ধ ছিল সংগঠনটি। অথচ সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে বড় সাফল্য পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল।
মূলত জুলাই আন্দোলনের পর ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে আসেন সংগঠনটির নেতারা। গত এক বছর বিনা বাধায় নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন তারা। তবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তাদের বড় জয়ের কারণে জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব কোনদিকে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এতো দিন জুলাইয়ের অংশীজন হিসেবে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাছে ছিল এর মূল নেতৃত্ব। আর বাম ছাত্র সংগঠনগুলোও জুলাইয়ের অন্যতম অংশীজন।
কিন্তু নির্বাচনে তারা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। তাই আগের মতো তাদের স্পিরিট থাকে কিনা, তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। সংবাদসংস্থা বাংলা ট্রিবিউন এক প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করেছে।
কৃতিত্ব জাহিরের প্রবণতা: জুলাইয়ের নেতৃত্বের কৃতিত্ব নিয়ে বিভিন্ন সময় দুই পক্ষই এক ধরনের কথার লড়াই চালিয়ে আসছিল। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই ইসলামী ছাত্রশিবির দাবি করে আসছে আন্দোলনের মূল মাস্টারমাইন্ড ছিল তারা। এরই মধ্যে ২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে সামনে আনা হয় সাদিক কায়েমকে। এর পরের মাসে ২৯ অক্টোবর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি প্রকাশ করা হয়।
অপরদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান থেকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও বিভিন্ন সময়ে বলে আসছিলেন শিবিরের কোনও সমন্বয়ক ছিল না। বিশেষ করে সাদিক কায়েমের নাম ধরে বলা হয় তিনি সমন্বয়ক ছিলেন না। জুলাই নিয়ে লেখা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বইয়ের কভার পেইজে অন্য সমন্বয়কদের ছবি থাকলেও সাদিক কায়েমের ছবি রাখা হয়নি। এই নিয়ে শিবিরের এক্টিভিস্টরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান। তবে আন্দোলনে শিবিরের অবদান ছিল এবং তারা নির্যাতিত ছিল এটি স্বীকার করেন নাহিদরা।
নেতৃত্ব নিয়ে নতুন আলোচনা: এরই মধ্যে গত ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু ও ১১ সেপ্টেম্বর জাকসুর নির্বাচনে শিবিরের প্যানেল বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছে শিবিরের প্যানেল। আর ছাত্রদলসহ জুলাই আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ও বাম সংগঠনগুলো ভালো করতে পারেনি।
এ নিয়ে দেশব্যাপী নতুন করে আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক নেতারাও নিজেদের মন্তব্য তুলে ধরছেন লেখনী ও টকশোতে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন তাহলে কী জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব ভিন্ন দিকে চলে গেলো?
ডাকসু ও জাকসুতে শিবিরের উত্থান: ডাকসুতে ২৮ পদের মধ্যে ভিপি, জিএস ও এজিএসসহ ২৩টিতে জয় পেয়েছে শিবির। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের সঙ্গে ভোটের ব্যবধানও অনেক। অন্যদিকে জুলাই স্পিরিটকে ধারণ করে গড়ে ওঠা সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের অবস্থান ছিল পঞ্চম। আর বাম সংগঠনগুলোর মধ্যে একমাত্র প্রতিরোধ পরিষদের জি এস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন। বিজয়ী শিবিরের এস এম ফরহাদের ১০ হাজার ৭৯৪ ভোটের বিপরীতে তিনি পান ৪ হাজার ৯৪৯ ভোট। অবশ্য দ্বিতীয় হওয়া ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারী হামিম পেয়েছেন ৫ হাজার ২৮৩ ভোট।
অপরদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও তাক লাগানো সাফল্য পেয়েছে শিবির। ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল ঘোষণা হয়েছে ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়। সেখানে ২৫ পদের মধ্যে জিএস ও দুই এজিএসসহ ২০টিতে জয় পেয়েছে শিবিরের সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট। অবশ্য ভিপি পদে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থী আবদুর রশীদ জিতু।
সেখানে নির্বাচন শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা আগে ভোট বর্জন করে ছাত্রদলের প্যানেল। জাহাঙ্গীরনগরেও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ও বাম সংগঠনগুলো উল্লেখযোগ্য পদ পায়নি।
যা বলছেন রাজনীতিবিদরা: দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিবিরে সাফল্য ও ছাত্রদল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ এবং বাম সংগঠনগুলো পরাজয়কে নানাভাবে বিশ্লেষণ করছেন রাজনীতিবিদরা। এর মধ্য দিয়ে জুলাইয়ের নেতৃত্ব কোনদিকে যায়, সে বিষয়টি একেকজন একেকভাবে মূল্যায়ন করছেন। কেউ মনে করছেন যারাই জিতেছে বা পরাজিত হয়েছে, তারা সবাই জুলাইয়ের প্রতিনিধি। তবে নেতৃত্ব কোনো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে পড়ে কিনা, সে বিষয়টি নিয়েও পর্যালোচনা করা উচিত বলে মনে করেন তারা।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন মনে করেন, জুলাইয়ে নেতৃত্বদানকারীরাই ডাকসু ও জাকসুতে প্রতিযোগিতা করেছে। তিনি বলেন, কেউ জিতেছে, কেউ হেরেছে। তবে জুলাই তার নিজস্ব জায়গাতেই থাকবে। এক্ষেত্রে সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করা জরুরি।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মূলত শিক্ষার্থীদের মতের প্রতিফলন ঘটে। সেখানে এলাকা, কল্যাণমূলক কাজ ও সাংস্কৃতিক কাজে যারা ভালো, শিক্ষার্থীরা তাদের বেছে নেন। সে অনুযায়ী যারা ইশতেহার দিতে পেরেছে, নির্বাচনে তাদের প্যানেলই ভালো করেছে। তিনি মনে করেন, অতীতের কিছু বিতর্কিত কাজের কারণে ডাকসুতে তেমন ভালো করতে পারেনি ছাত্রদল। হল সংসদসহ সাধারণ কয়েকটি পদে বাগছাসের সাফল্য রয়েছে। আর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বের বিষয়টিকে মূল্যায়ন করা কঠিন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বের বিষয়টিকে সহজভাবে নিচ্ছি। কারণ সেখানে যারা প্রতিযোগিতা করেছে, তাদের সবাই জুলাইয়ের অংশীজন। শিক্ষার্থীরা যাদের বেছে নিয়েছে, তারাই জয়ী হয়েছেন। তবে এর মাধ্যমে জুলাইয়ের নেতৃত্ব কোনো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে চলে যায় কী না, সে বিষয়টি আরো বিবেচনায় আনতে হবে। তিনি বলেন, ছাত্র সংসদের আগে জাতীয় নির্বাচন হলে আরো ভালো হতো।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ডাকসু নির্বাচনে গ্রহণযোগ্য ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছে। আর জাকসু নানা কারণ বিতর্কিত। ভোট বর্জন ও নির্বাচন কমিশনারের সরে যাওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। তাই সেটাকে তেমন আলোচনায় আনতে চাই না।
তিনি বলেন, তারপরও ডাকসু বা জাকসুতে যারাই প্রতিযোগিতা করেছে বা নির্বাচিত হয়েছে, তারাই জুলাইয়ের অংশীজন। তাদের সবার প্রতিই সম্মান জানাতে চাই। আমি মনে করি নির্দিষ্ট কোনো সংগঠনের একচেটিয়া বিজয়ে জুলাইয়ের নেতৃত্ব ভিন্ন দিকে যায় কিনা, তা পর্যালোচনা করতে হবে। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন।
সানা/আপ্র/১৩/০৯/২০২৫