লাইফস্টাইল ডেস্ক: ভাগ-পূর্ব নদীয়া বা আজকের কুষ্টিয়া ঐতিহ্য ও ভ্রমণপ্রিয়দের অনিবার্য পর্যটন গন্তব্য। সাদা চোখে কুষ্টিয়া প্রথাশাসিত আর দশটি জনপদের মতো হলেও এ মাটির প্রতিটি পরত সৃষ্টিশীল কীর্তিমানের জন্ম ও স্মৃতিধন্য, প্রাচীন স্থাপনা সোনালি ঐতিহ্যে উজ্জ্বল। এর মধ্যে কয়েকটি হলো-
জগতি: সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথের স্মৃতিকথা ও দিনলিপিতে জানা যাচ্ছে, উনিশ শতকেও এখানকার যাতায়াত ছিল নৌকানির্ভর। কুষ্টিয়ার শিলাইদহে যাতায়াত ও বসবাসের সময় নৌকা–বজরাই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান ভ্রমণযান। কুঠিবাড়িতে সেই নিদর্শন আজও বর্তমান। এই পটভূমিতেই কলকাতার সঙ্গে এই অঞ্চলের রেল যোগাযোগ গড়ে তুলতে ১৮৬১ সালে জগতি স্টেশনের গোড়াপত্তন।
জগৎ থেকে জগতি নাম হয়েছে কি না, জানা নেই। বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন রেলস্টেশনটির কর্মব্যস্ত সকাল-সন্ধ্যা-রাত কবেই কালের গর্ভে বিলীন, খয়েরি রঙের ভবনটিও বিলীয়মান, আমার স্মৃতি-অলিন্দের ঘটনারা কেবল জাগরূক। আমার জন্ম ও তারুণ্যের একটি অমোচনীয় স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে জগতি। আমার মহীয়সী মা কি জানতেন যে জগতি গ্রামে স্টেশন তৈরির ঠিক শতবর্ষ পরে তার গর্ভে লেখকের জন্ম হবে! তারুণ্যেই আবার সে স্টেশনটির সঙ্গে জুড়ে যাবে?
ভগ্নিপতির কর্মসূত্রে ১০০ বছর পর জগতে জন্মানো তরুণের সঙ্গে জগতির যোগাযোগ হয়ে ওঠে নিবিড়। রেল কোয়ার্টারে থাকা, স্টেশনের ওপর দিয়ে ট্রেনে যাতায়াত, স্টেশনকেন্দ্রিক ব্যস্ততার জীবন থেকেই লেখালেখির প্রণোদনা। ঢং ঢং ঘণ্টা, কাউন্টারে দীর্ঘ সারি, অপেক্ষমাণদের হাঁসফাঁস, হকারের হাঁকডাক, সাদা কোটওয়ালা টিকিট চেকারের তির্যক দৃষ্টি, লাল-সবুজ পতাকা হাতে গার্ডের ব্যস্ততা, চশমা আঁটা স্টেশনমাস্টারের গম্ভীর পায়চারি, ইউনিফর্মধারী রেল পুলিশের খবরদারি, পোর্টারদের কর্মকুশল সিগন্যালিং, কুলি-মুটেদের হইচই স্টেশনটির সঙ্গে গড়ে তোলে নিবিড় যোগ।
ওইসব আটপৌরে কোলাহলের মর্যাদা তখন বোঝা যায়নি। ভ্রামণিক চোখে সম্প্রতি ঘুরতে ঘুরতে উপলব্ধি হলো, অতিমূল্যবান সেই সব দিন আজ বিলীন ও বিলীয়মান। জগতিতে এখন ট্রেন থামে না। স্টেশন ভবনটি খাঁ খাঁ। তবে তেমন করে কান পাতলে আজও শোনা যায় শত বছরের মানুষের ব্যস্ত পদধ্বনি।
রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ: রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন শাহর সাক্ষাৎ হয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। নৌকায় চেয়ারে বসা লালনের দুর্লভ চিত্রকর্মটি যে রবীন্দ্র–অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথকৃত, আর ১৮৮৯ সালে আঁকা, তাতে সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ সালে শিলাইদহে জমিদারি পরিচালনা করতে আসেন, সে বছরেরই অক্টোবরে লালনের মহাপ্রয়াণ। তবে মুখোমুখি দেখা হওয়াটা বড় কথা নয়, লালন ও বাউল দর্শন, কবি গগন হরকরার সুর, শিলাইদহ-খোরশেদপুরের প্রকৃতি, পদ্মা-গড়াইয়ের সরল গ্রামীণ জীবন যে রবীন্দ্রসাহিত্যের অন্যতম প্রেরণা, তা বলাই বাহুল্য। রবীন্দ্রমনীষী প্রফেসর সৈয়দ আকরম হোসেন, ড. আনোয়ারুল করীম, ড. আবুল আহসান চৌধুরীসহ অনেক গবেষকের কলমেও এটা উঠে এসেছে।
কুমারখালীর খোরশেদপুর গ্রামের নীলকর শেলি আর পদ্মার ঘূর্ণিস্রোত দহ থেকে যে শিলাইদহ, কুঠিবাড়িই তার মূল আকর্ষণ। আমার প্রিয় শিক্ষক রবীন্দ্রমনীষী সৈয়দ আকরম হোসেনের সঙ্গে শিলাইদহ ভ্রমণে গেলে বললেন, ‘চলো, রবীন্দ্র জমিদারির কাছারিবাড়ি আর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ দাতব্য চিকিৎসালয় খুঁজে দেখি।’ অদূরে গ্রামের মধ্যে খুঁজে পাই কাছারি ভবন এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি। তবে অরক্ষায় আর অযত্নে দাতব্য কেন্দ্রটি আজ বিলীয়মান। যে খোরশেদপুরের একাংশ থেকে শিলাইদহ, বিশ্বপরিচিতির জেরে সেই খোরশেদপুরই আজ অবহেলার শিকার। বিস্মৃতির অন্তরালে খোরশেদপুরের প্রতিষ্ঠাতা দরবেশ খোরশেদ উল মুলকের নাম ও সমাধি। অথচ দরবেশের স্মৃতি রক্ষায় জমিদারির উদ্যোগে সমাধিটি বাঁধাই করিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
লাহিনীপাড়ায় বিষাদ-সিন্ধু: মীর মশাররফ হোসেনের দিনলিপিতে ঘুরেফিরেই এসেছে সংসারে টানাটানির কথা। নবাবি সেরেস্তায় কাজ করলেও অভাব মীরের সঙ্গ ছাড়েনি। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা বিষাদ-সিন্ধু ঘরে ঘরে পঠিত হতো। বিষাদ-সিন্ধু বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার খরচের অনেকাংশ নির্বাহ হতো। বিষাদসিন্ধুর মানি অর্ডারের জন্য তিনি মুখিয়ে থাকতেন।
কুমারখালীর লাহিনীপাড়ায় মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটায় এখন পাঠাগার ও মিলনায়তন। কাস্টডিয়ান মীর মাহবুবুল আলম মীরের পঞ্চম পুরুষ। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তত্ত্বাবধানে নিয়ে মীরের স্মৃতিকে গুরুত্বে না নিলেও গড়াইবিধৌত গ্রাম ভ্রমণে মীরের স্মৃতির অনেকটাই পাওয়া যায়। বাড়তি পাওয়া পাঠাগার চত্বরের বিশেষ কেতার প্রবেশতোরণ, কংক্রিট–স্তম্ভে উৎকীর্ণ তার অমূল্য বাণী, যার একটায় লেখা, ‘হায় রে অর্থ, হায় রে পাতকী অর্থ! তুই জগতের সব অনর্থের মূল।’
ছেঁউড়িয়া- লালন সমাধি: ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি, ওহে দয়াময়,/পারে লয়ে যাও আমায়’, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’-এর মতো আধ্যাত্মিক গান ফকির লালন শাহকে জগদ্বিখ্যাত করেছে। ১৭৭২ বা ১৭৭৪ সালে ভাঁড়রা গ্রামে ভূমিষ্ঠ হন লালন। শতবর্ষ পেরোনো জীবনে শুধু অধ্যাত্মসাধনায়ই বুঁদ ছিলেন না, তৈরি করতে সক্ষম হন নিজ দর্শনের বিপুল অনুসারী। বাউলতত্ত্বের বিরোধীদের থেকে নিজেদের রক্ষা করেছেন। সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথকে জমিদারের লাঠিয়ালদের হাত থেকে বাঁচাতে তার বাড়িতে পাহারা দিতেও দ্বিধা করেননি।
লালন শাহর আখড়া নামে পরিচিত সমাধি কমপ্লেক্সটি বাউলপ্রেমীদের পাশাপাশি ভ্রমণপ্রেমীদেরও আকর্ষণের কেন্দ্র। তোরণ পেরিয়ে সবুজ চত্বরের মধ্যে লালনের সমাধি। লালনের জন্ম ও মৃত্যুতিথিতে লালন মেলাসহ সংবৎসর পর্যটকে মুখর থাকে লালন দরগাহ।
কাঙালের কাল- এমএন প্রেস: কুমারখালীর অকুতোভয় সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথের এম এন প্রেসের ঠিকানা এখন কাঙাল জাদুঘর। কলম্বিয়ান ইগল জনরার প্রেসটি ইংল্যান্ডের ক্লাইম্বার ডিক্সন কোম্পানির তৈরি। সরকারি নিলাম থেকে প্রেসটি কিনে এম এন প্রেস নামে কুমারখালীতে স্থাপন করেন কাঙাল হরিনাথ। বাল্যবন্ধু মথুরানাথ মৈত্রেয়সহ বন্ধুরা প্রেসটি কিনতে সাহায্য করেন বলে প্রেসের এই নাম। কাঙাল হরিনাথ সম্পাদিত গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা, মীর মশাররফ সম্পাদিত হিতকরী, কাঙালের উপন্যাস বিজয় বসন্ত, মীর মশাররফের বিষাদ–সিন্ধু এই প্রেস থেকেই ছাপা হয়। প্রেসটি হয়ে ওঠে উনিশ শতকে সাহিত্যিক তৈরির সূতিকাগার।
এ লেখক শতবর্ষ প্রাচীন মুদ্রণযন্ত্র এমএন প্রেস থেকে সিসার হরফের কম্পোজে পত্রিকা প্রকাশের স্মৃতিগর্বী। কম্পোজ ও ছাপার কাজে যুক্ত ছিলেন কাঙালেরই চতুর্থ পুরুষ অশোক মজুমদার ও তার স্ত্রী গীতা মজুমদার। সজ্জিত হরফ প্রেসের পাটাতনে সাজিয়ে হাতল চেপে ধীরগতিতে চলত ছাপার কাজ। মানুষ ও মেশিনের মিশেলে চলত মুদ্রণযন্ত্রের ছাপার কাজ।
কুমারখালীতে জন্ম নেওয়া হরিনাথ বহুমাত্রিক প্রতিভা। সাহিত্য-সাংবাদিকতার সুবাদে ‘গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ’ তকমা পান। লালন শাহর পরোক্ষ শিষ্য হরিনাথ ‘কাঙাল’, ‘ফিকিরচাঁদ’ ভণিতায় বাউলগান রচনা ও গানের দল গঠন করেন। প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসের পাশাপাশি হরিনাথ রচিত বিজয় বসন্তকে ‘বিশুদ্ধ সংস্কৃতিবহুল বাংলা’য় লেখা প্রথম উপন্যাস বলে মন্তব্য করেছেন গবেষক
শিবনাথ শাস্ত্রী।
কুমারখালীতে গেলে আরও দেখবেন পাড়ায় পাড়ায় বিলীয়মান ভবন। কুষ্টিয়া জেলা হওয়ার আগেই কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তের বাইরে লালন, রবীন্দ্র, মশাররফ, কাঙাল, জলধর সেনের জন্ম ও পদচারণে আরেকটি বুদ্ধিবৃত্তের গোড়াপত্তন হয়েছিল যে জনপদে, তার নাম কুমারখালী।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ