নিজস্ব প্রতিবেদক: ঈদের আগে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে দেশের অন্যতম বড় কাপড়ের মার্কেট ঢাকার বঙ্গবাজার। ফায়ার সার্ভিসের গণমাধ্যম বিভাগের কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম দোলন জানান, সকাল ৬টা ১০ মিনিটে ওই মার্কেটে আগুন লাগার খবর পান তারা। ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের পাশাপাশি সেনা বাহিনী ও বিমানবাহিনীর দুটি দল প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় বেলা ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এরই মধ্যে বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আশপাশের আরও কয়েকটি ভবন ও মার্কেট। এনেক্সকো টাওয়ারে আগুন জ্বলতে দেখা যায় আরও কয়েক ঘণ্টা।
বঙ্গবাজারের পাশেই ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর বলে খবর পাওয়ার দুই মিনিটের মধ্যে সেখানে প্রথম ইউনিট পৌঁছায়। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ইউনিটের সংখ্যা। কিন্তু বাতাসের মধ্যে ঘিঞ্জি ওই মার্কেটের আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ওই অবস্থায় ঢাকায় ফায়ার সার্ভিসের অধিকাংশ ইউনিটকে সেখানে ডাকা হয়। বহু দূর থেকেও বঙ্গবাজারের আকাশে ধোঁয়ার কু-লী উঠতে দেখা যায়। প্রায় ২২ হাজার বর্গফুট এলাকার ওপর ঠাসাঠাসি দোকানের ভিড়ে আগুন নেভাতে পেরিয়ে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক পর্যায়ে পাশের পুলিশ সদর দপ্তরের সীমানাতেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সাময়িক বন্ধ রাখা হয় জাতীয় জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯ এর সেবা।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল-সংলগ্ন পুকুর থেকেও পানি নিতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে। বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারকে দেখা গেছে হাতিরঝিল থেকে পানি নিয়ে বঙ্গবাজারে আগুনের ওপর ছিটাতে। বড় এলাকায় টিন ও কাঠ দিয়ে নির্মিত শত শত দোকান নিয়ে এই বঙ্গবাজার। ঈদ সামনে রেখে সব দোকানেই প্রচুর নতুন পণ্য তোলা হয়েছিল। ভোরে অগ্নিকা- শুরুর পর তার বেশিরভাগই বের করার সুযোগ পাননি দোকানিরা। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বঙ্গবাজার আদর্শ মার্কেট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা পুরো মার্কেটসহ বরিশাল প্লাজায়ও ছড়িয়ে পড়ে। তবে কীভাবে সেখানে আগুন লাগল তা এখনও স্পষ্ট নয়।
ফায়ার সার্ভিসের মোট ৬৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন। তাদের মধ্যে ৮ জন আহত ও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কারও মৃত্যুর খবর এখনও আসেনি। এ অগ্নিকা-ের কারণে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার এবং আশপাশের এলাকার সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয় বেলা পৌনে ৩টা পর্যন্ত। বঙ্গবাজার-গুলিস্তান, হানিফ ফ্লাইওভারের চাঁনখারপুল অভিমুখী লেন ও বঙ্গবাজার থেকে শিক্ষাভবন অভিমুখী সড়ক বন্ধ থাকায় আশপাশের অন্যান্য সড়কে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপত্তার কারণে বঙ্গবাজার ও আশপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ রাখা হয়। ফলে সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্কও বিঘিœত হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন ভোর থেকেই সেখানে অবস্থান করে বাহিনীর কর্মীদের কাজ তদারকি করছিলেন। আগুন কীভাবে লাগল জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ বিষয়টি এখন বলা সম্ভব নয়। এই ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। প্রতিবেদন পাওয়ার পরে আগুন লাগার কারণ জানা যাবে।” আগুন নির্বাপনে বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করে ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক বলেন, “এখানে অনেক বাতাস, যার জন্য অনেক সময় লাগছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক জানান, ফায়ার সার্ভিস ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবে। কমিটি এ দুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করবে।
সব পুড়ে ছাই: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন বঙ্গবাজার চারটি ইউনিটে বিভক্ত। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট মিলিয়ে মোট দোকানের সংখ্যা ২ হাজার ৩৭০টি। সকালে ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের কাউকে কাউকে মরিয়া হয়ে মালামাল সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়। অনেকেই অসহায়ভাবে কাঁদছিলেন। একজন বলছিলেন কয়েক লাখ টাকার মাল তিনি দোকানে তুলেছিলেন ঈদ সামনে রেখে।
১৯৯৫ সালে একবার ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় বঙ্গবাজার। পরে নতুন করে গড়ে তোলা হয় ওই মার্কেট। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই সেখানে আগুন লেগে মার্কেটের গুলিস্তান ইউনিটের কয়েকটি দোকান পুড়ে যায়। পাশের আনন্দবাজারে প্রায় ২৪ বছর ধরে ব্যবসা করা আল-আমীন বলছেন, বুধবার আগুনের যে ভয়াবহতা দেখা গেছে বঙ্গবাজারে, তেমনটা তিনি আর কখনও দেখেননি। বঙ্গবাজারের মাঝামাঝি জায়গার নিচে তলায় ভুঁইয়া ফ্যাশনের মালিক মোশাররফ কামাল ভুঁইয়ার দোকানে ঈদের আগে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার পোশাক তোলা হয়েছিল। আগুন লাগার পর ধোঁয়ার কারণে দোকানে ঢুকতে না পারায় একটি পণ্যও বের করা যায়নি। তিনি বলেন, “অল্প পুঁজি দিয়ে শুরু করা এ দোকান ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল, আগুনে সব শেষ হয়ে গেলরে ভাই।”
দুপুরে ঘটনাস্থলে এসে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকার মতো হতে পারে বলে তার ধারণা। আর এই ক্ষতি পোষাতে সরকারের তরফ থেকে প্রাথমিকভাবে সাতশ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানান তিনি। দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যববসায়ীদের ক্ষতি নির্ধারণ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।”
ঈদের আগে পুড়ল বঙ্গবাজার
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ