নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকার শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অন্যতম রাজু ওরফে পাকিস্তানি রাজুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত দিবাগত রাত একটার দিকে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ আবুল কালাম ভূঁইয়া তাকে গ্রেপ্তারের তথ্য নিশ্চিত করে জানান, পাকিস্তানি রাজুর বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। জেনেভা ক্যাম্পসহ মোহাম্মদপুর থানা এলাকার মাদক কারবারিদের সম্পর্কে ওসি বলেন, ‘আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, সে অনুযায়ী আমরা মাদক কারবারিদের আটক করছি। এরা বারবার স্থান পরিবর্তন করে। একজনকে আটক করলে সিন্ডিকেটের বাকিরা পালিয়ে যায়। তবুও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রতি মাসে মাদক বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানায় কম হলেও মামলা হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০টা। এরা ছাড়া পেয়ে আবার এসে একই ব্যবসা শুরু করে।’
পাকিস্তানি রাজুর ইয়াবা সাম্রাজ্য : আটকেপড়া পাকিস্তানি পরিবারের যুবক রাজু। মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পে ঠাঁই হয়েছিল তার পরিবারের। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে ফেরত যায় পরিবারটি। প্রায় ১৪ বছর আগে দেশটি থেকে ফের বাংলাদেশে ফিরে আসে তারা। আবার ক্যাম্পেই ঠাঁই নেয়। সাত সদস্যের পরিবারটির একজন ‘রাজু’ ওরফে ‘বাবা রাজু’ ওরফে ‘পাকিস্তানি রাজু’। এসব পরিচিতি পাওয়ার আগে তাকে ক্যাম্পে সবাই চিনত পানদোকানি রাজু নামে।
রাজু জেনেভা ক্যাম্পকে ঘিরে গড়ে তুলেছেন ‘ইয়াবা সাম্রাজ্য’। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রীতিমতো ডিলার নিয়োগ দিয়ে দিনের পর দিন বিক্রি করে আসছেন সর্বনাশা নেশার মাদক ইয়াবা। তার সিন্ডিকেটের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যান রাজু। এখন তাদের গোটা পরিবারই ইয়াবার কারবারে জড়িত বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
একটি সংবাদসংস্থার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, একজন নারী এবং ছয়জন পুরুষসহ সাত সদস্যের এই পরিবারটি মোহাম্মদপুরের জেনেভা পাকা ক্যাম্পের রিয়াজের সাউন্ড দোকানের গলির একটি ঘরে বাস করছে। আর ক্যাম্পের বি ব্লকে পাঁচটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন রাজু। করোনাকালের শুরুতে রাজুর ইয়াবা কারবার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল সংবাদমাধ্যমটি। তারপর আত্মগোপনে চলে যান তিনি। সম্প্রতি আবার ফেরেন জেনেভা ক্যাম্পে। ক্যাম্পের জি ব্লকে শুরু করেন ইয়াবা কারবার। জেনেভা ক্যাম্পের পূর্ব দিকের জে ব্লকের মূল সড়কের উপর দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে যারা ইয়াবা বিক্রি করেন তাদের নিয়ন্ত্রক এই রাজু। জেনেভা ক্যাম্প সূত্র জানায়, পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর ভ্রমণভিসা নিয়ে ফের বাংলাদেশে আসে রাজুর পরিবার। জেনেভা ক্যাম্পের এইচ ব্লকের বাসিন্দা নূর ইসলাম ওরফে চারকু তাদের সার্বিক সহযোগিতা করেন। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি বাসিন্দা হিসেবে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দেন চারকু।
জনশ্রুতি আছে, বাংলাদেশ পাড়ি জমানোর আগে এই পরিবারটি পাকিস্তানে মাদক ব্যবসা ও জঙ্গি কর্মকা-ে জড়িত ছিল। পরিবারের বড় সন্তান পাকিস্তানের ‘এলিট ফোর্স রেঞ্জার্স’ এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। তাদের কর্মকা- পাকিস্তানে ফাঁস হয়ে গেলে তারা বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশে এসে প্রথমে জেনেভা ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকে একটি পান-সিগারেটের দোকানের ব্যবসা শুরু করে পরিবারটি। তবে এর আড়ালে চলত মাদক ব্যবসা। একপর্যায়ে ধীরে ধীরে গড়ে তোলে ইয়াবা ব্যবসার বিশাল সিন্ডিকেট। বর্তমানে সেই পান দোকান অন্য একজনকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নূর ইসলাম চারকু ও তার ছেলে ‘এস’ বাহিনীর সদস্য ইমরান ইয়াবার কারবারে রাজুর পরিবারকে সবরকম সহযোগিতাকারী।
জেনেভা ক্যাম্পের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজুর আরও চার ভাই রাশেদ, কাসেম, আতিক ও হামজা এবং রাজুর স্ত্রী রিমা, রাসেদের স্ত্রী ঝিনু ও কাসেমের স্ত্রী চাঁদনিও ইয়াবা কারবারে জড়িত। তবে সবচেয়ে সক্রিয় রাজু ও তার মা রেহানা। রাজুর ইয়াবা বিক্রির হিসাব রাখেন রাজুর বাবা ‘মান্ডা’ ওরফে ‘পাকিস্তানি মান্ডা’ ও রাজুর মা রেহানা।
সূত্র মতে, ইয়াবা ব্যবসা করেই রাজু চকবাজারে নিজের নামে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জেনেভা ক্যাম্পের ইয়াবা গডফাদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন পঁচিশ। র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গেল বছর মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর পর জেনেভা ক্যাম্পের আরেক ইয়াবা কারবারি ইশতিয়াক চলে যান আত্মগোপনে। রাজুর ছোট ভাইয়ের শ্বশুর ‘মেন্টাল আসলাম’ ইশতিয়াকের বোন জামাই। রাজুর ফুফু রানী জেনেভা ক্যাম্পের চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী। রাজুর ইয়াবা কারবার ও সিন্ডিকেটের বিষয়টি জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সবাই জানে। দীর্ঘসময় ধরে ইয়াবা ব্যবসা করে অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন রাজু। তাই তার কর্মকা-ে অনেকে বিরক্ত হলেও মুখ খুলতে রাজি নন কেউ। পঁচিশের মতো চিহ্নিত ইয়াবা কারবারির শাস্তি হওয়ায় খুশি ক্যাম্পের অনেকেই। তবে রাজুসহ অন্যান্য ইয়াবা ব্যবসায়ীদেরও উৎখাত করার দাবি ক্যাম্পবাসীর। জেনেভা ক্যাম্পের নন লোকাল রিলিফ কমিউনিটি জোন-এ-এর সাবেক চেয়ারম্যান এস এম সিমা কোরাইশি বলেন, ‘রাজু ও রাজুর পুরো পরিবার ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে অনেক আগে থেকেই জড়িত।’
জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবার ঠেকাতে সক্রিয় হয়েছে ক্যাম্পভিত্তিক সংগঠন মহাজির রিহেবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট মুভমেন্ট (এমআরডিএম)। সংগঠনটির সভাপতি ওয়াসি আলম বশির বলেন, ‘রাজু বর্তমানে একজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। গত তিন চারদিন পুরনো নতুন মিলিয়ে অন্তত ২০/২৫ জন শো ডাউন করেছে। তারা ধারালো অস্ত্র নিয়ে শো ডাউন করেছে। তারা চেয়েছিল অস্ত্রের মুখে মানুষকে জিম্মি করে মাদক ব্যবসাটা আবারও বড় আকারে করতে চেয়েছিল। ক্যাম্পের লোকজন থানায় বিষয়টা জানায়। তখন রাজু গ্রেপ্তার হয়।’
জেনেভা ক্যাম্প সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে জেনেভা ক্যাম্পে চিশতি রাজু, সুমন, মামুন, চুয়া সেলিম, ছট্টু, আসলাম, আরমানসহ বেশ কয়েকজন বড় মাদক ব্যবসায়ী সক্রিয় আছেন। এর আগে ২০১৮ সালে জেনেভা ক্যাম্প থেকে দুই দফায় পাঁচ শতাধিক মাদক কারবারিকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ইয়াবা সম্রাট ‘পাকিস্তানি রাজু’ গ্রেপ্তার
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ