বশির আহমেদ দশকের পর দশকজুড়ে একই শিকড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। তিনি ইহজগতে বিচরণ করেছেন তার নিজস্ব দর্শন, ধ্যান ও জ্ঞানে। কোনো শক্তি তাকে টলাতে পারেনি তার মস্তিষ্কে পূর্বনির্ধারিত অসাধারণ শিল্পশৈলী থেকে। তিনি সারা জীবন সংগীতে মগ্ন থেকেছেন ধ্যানরত সাধুর মতো। তার মধ্যে সেন্স অব হিউমার ছিল অসাধারণ। একই সঙ্গে ছিলেন সফল স্বামী ও পিতা। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও তিনি ছিলেন সংসারী- স্নেহবৎসল পিতা ও স্ত্রী অনুরাগী। জীবনের বিভিন্ন স্তরের সাফল্যের মধ্যে যে দুটিতে সাফল্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেখানেই ছিলেন সফলতম ব্যক্তি। এ বিষয় নিয়েই এবারের সাহিত্য পাতার প্রধান রচনা
বশির আহমেদ ১৯৫৬ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে বাংলাদেশেরই আরেক কৃতিসন্তান শ্রীমতী গীতা দত্তের সঙ্গে বোম্বের একটি ছবিতে কণ্ঠ দেন। ওই সময় হিজ মাস্টার্স ভয়েস তার রেকর্ড বের করে। তারপর ঢাকায় এসে তালাত মাহমুদের পাশাপাশি গজল পরিবেশন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন বশির আহমেদ। এই গজল অনুষ্ঠানে বশির আহমেদ কণ্ঠটা এমন করে উপস্থাপন করলেন যে, শ্রোতা ও আয়োজকরা রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। যেন একই মঞ্চে দুই তালাত মাহমুদ!
‘তালাশ’ ছবির সাফল্যের পর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, ভাষা ও সংস্কৃতি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলো। লাহোর, তথা পাকিস্তানের বিপুল সাফল্য, নেপালের পাহাড়ি ইশারা, জন্মভূমি ভারত- সবকিছু ফেলে তিনি স্থায়ীভাবে বসত করলেন ঢাকায়। উর্দু সাহিত্যে এমএ ডিগ্রিপ্রাপ্ত বশির আহমেদ বাংলা ভাষায় অসংখ্য গান গাইলেন। এমনকি বাংলায় গানও নিজে রচনা করেছেন বিএ দীপ ছদ্মনামে।
১৯৩৯ সালের ১৯ নভেম্বর কলকাতার খিদিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন বশির আহমেদ। তার বাবার নাম নাসির আহমেদ। তার সংগীত শিক্ষা শুরু হয় ওস্তাদ বেলায়েত হোসেন খাঁ (বাঁকা) কাছে। পরে সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করেন কিংবদন্তি গায়ক ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁর কাছে। ঘর-সংসার ও সাধনা নিয়েই তিনি আজীবন তার উর্বর সময়টাকে সযত্নে লালন করে গেছেন। তার স্ত্রী ছিলেন আরেক কিংবদন্তি গায়িকা নেপালের সন্তান মিনা বশির।
সত্তর ও আশির দশকে বশির আহমেদ ও মিনা বশিরের কয়েকটি দ্বৈত গান ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। এই জাদুকরী কণ্ঠের অধিকারী সংগীতশিল্পীর গুণের কথাগুলো একটু আগেভাগে বললে, পরবর্তী অধ্যায়ে তার সংগীত ও কর্মজীবন, ব্যক্তি বশির আহমেদকে পাঠকেরা বুঝতে পারবেন সহজে। নায়োকোচিত চেহারা, ব্যক্তিত্ব, স্বল্পভাষী ও পাণ্ডিত্য সহজেই অন্যান্য ব্যক্তিত্ব, এমনকি সমসাময়িক অনেক গায়কদের থেকে তাকে নিমিষেই চিনিয়ে দিতো তিনি বশির আহমেদ। তিনি রাগী স্বভাবের—এটা অনেকের চোখে পড়তো, কিন্তু ভেতরে যে তার কোমলতা ও পাহাড় সমান মানবতা লুকিয়ে ছিলো—এটা সহজে কারোর চোখে পড়তো না।
বশির আহমেদ একটা গান তৈরি করতে বা গাইতে সময় নিতেন। তাতে একদিনের জায়গায় হয়তো সাতদিন লাগবে, গানটা তো চিরস্থায়ী হতে পারে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে–এমনকি বাংলাদেশের ষাট-সত্তর আর আশির দশকের শেষদিক পর্যন্ত গায়ক-গায়িকারা গান গাইতে সময় নিতেন। গীতিকার উৎকৃষ্ট লিরিক তৈরি করতেন, সুরকার সময় নিয়ে হারমোনিয়ামে সুর তুলতেন আর সেই সময়ের বাঘা বাঘা শিল্পীরা সময় নিয়ে সেই গানের বাণী, সুর ও গায়কী আত্মস্থ করতেন। বশির আহমেদ সেই কাতারের প্রথমদিকের একজন সাধক। তাই আজও তার গান অমর, আর তিনি অবিনশ্বর।
‘যা রে যাবি যদি যা, পিঞ্জর খুলে দিয়েছি, যা কিছু কথা ছিল বলে দিয়েছি।’ গানটির মতোই এক কিংবদন্তি উড়াল দিলেন অনন্তলোকে। তিনি একাধারে ছিলেন গজল শিল্পী, উর্দু ও বাংলা ছায়াছবির অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা। ম্যাডাম নূরজাহান, গীতা দত্ত প্রমুখ কিংবদন্তির সাথে দ্বৈত কণ্ঠের গান করেন তিনি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এসে তিনি দেশকে ভালোবেসে এই দেশেই থেকে যান। তিনি উর্দু ভাষাভাষি হয়েও খুব দ্রুত বাংলা আয়ত্ত করে গান গেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। সত্তর দশকে অসংখ্য বাংলা আধুনিক গান ও সিনেমার গান করে বাংলা গানের সাম্রাজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেন। তার কণ্ঠ, সুর ও গায়কীতে এ দেশের মানুষের মনের কথা ও আবেগ প্রতিফলিত হতো। এই দিকটা ভাববার বিষয় বৈকি। কী করে তিনি এ দেশের মানুষের মন জয় করলেন এত স্বল্প সময়ে। তিনি অসংখ্য বাংলা আধুনিক গান ও সিনেমার গানের স্রষ্টা, যে গানগুলো ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
আজও জনপ্রিয় ওইসব অমর গান- যার অন্যতম একটি গান ‘যা রে যাবি যদি যা’ গানটি আজও শ্রোতাদের শিহরিত করে। একজন সংগীতশিল্পী, একজন সাধক ও একজন দেশপ্রেমিক। তিনি বশির আহমেদ। বাংলাদেশকে আর বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবেসে আজীবন গান গেয়েছেন যিনি, তিনি কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী বশির আহমেদ। আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো এত বড় মাপের কণ্ঠশিল্পীর কাছে সংগীতের তালিম নেওয়ার। এখানে একটু বলে নিই, ওস্তাদজীর সান্নিধ্যে আসার বহুকাল আগে থেকেই ওস্তাদজী ছিলেন আমার মনের কোণে তার গানের মাধ্যমে। শৈশব থেকেই তার গান শুনে তাকে অন্তরে ধারণ করেছিলাম।
জীবদ্দশায় বশির আহমেদ প্রতিষ্ঠা করেন সারগাম সাউন্ড স্টেশন; যা এখন তার মেয়ে হোমায়রা বশির ও ছেলে রাজা বশিরের নিরলস প্রচেষ্টায় উচ্চতর মাত্রায় পৌঁছেছে। বশির আহমেদ-মিনা বশির দম্পতির বড় সন্তান হোমায়রা বশির ও ছোট সন্তান রাজা বশির গানের জগতেই আছেন।
কলকাতার খিদিরপুরে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম তার। বাবা নাসির আহমেদ ও মা মোমেনা খাতুন। দিল্লির সওদাগর পরিবারের সদস্য হিসেবেই বেশি পরিচিতি ছিল তার। চার ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠতম বশির আহমেদ ছেলেবেলা থেকেই গানপাগল ছিলেন। সেই সময়ে রমজান মাসে খিদিরপুরে সেহরির সময় রোজাদার মুসলমানদের ঘুম ভাঙানোর জন্য মহল্লার তরুণরা সমবেত কণ্ঠে বিশেষ ধরনের ইসলামি গান গাইতো। এই ধরনের গানকে বলা হতো ‘কাফেলা’ গান। বছরে একবার এই কাফেলা গানের প্রতিযোগিতা হতো খিদিরপুরে। এই কাফেলা গানের প্রতিযোগিতায় প্রতি বছর প্রথম স্থান অধিকারী বশির আহমেদ কিশোর বয়সেই খিদিরপুরে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।
কাফেলা গান যখন বশির আহমেদ করতেন, কতোই বা বয়স তার। ১৫ হবে। তবে তিনি মাঝেমধ্যে পান খেতেন। এই বয়সে তার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়েছে। কাফেলা গানের প্রতিযোগিতায় তিনি প্রতিবারই প্রথম হচ্ছিলেন, তার অজান্তেই তিনি অনেকের শত্রুতে পরিণত হলেন। কে বা কারা তার পানের সাথে সিঁদুর মিশিয়ে দেয়। তার জীবনে এত বড় বিপত্তি ও বিপদ কমই হয়েছে। এই সিঁদুর হজম করে তিনি গানে ঠিকই প্রথম হলেন। তারপরের পরিস্থিতি হয়েছিল ভয়াবহ।
বশির আহমেদের কণ্ঠ বসে গেল। এরপর কথা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিলেন। কেউ বলল, গরম হালুয়া কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে গলায় ঝুলিয়ে দিতে। অনেক চেষ্টার পরও স্বর ফিরল না। এদিকে কথা বলতে না পেরে তিনি পাগল-প্রায়। যে ব্যক্তি গান করার জন সব সময় মুখিয়ে থাকেন, তিনি গান তো দূরের কথা, গলা দিয়ে স্বরই বেরুচ্ছিল না। তিনি অস্থির ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। পরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। ডাক্তার ওষুধ দিলেন এবং তিনমাস সময় বেঁধে দিলেন কথা না বলে থাকার। সেই তিনমাস তার জীবনে ছিল চরম দুঃসময় ও হতাশার। তিনি তার প্রয়োজন ও অন্যান্য কাজে কাগজে লিখে জানাতেন।
বশির আহমেদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার সেইন্ট বারনাবাস হাইস্কুলে। এই স্কুল থেকেই তিনি মেট্রিক পাস করেন। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে পরে তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু সাহিত্যে পড়াশোনা করেন এবং এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তার সংগীতে হাতেখড়ি হয় ওস্তাদ বেলায়েত হোসেন খাঁর কাছে। সুরপাগল বশির আহমেদ মাত্র ১৫ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন সুরের সন্ধানে। তিনি বোম্বে চলে যান এবং সেখানে গীতিকার রাজা মেহেদির বাসায় ওঠেন। বোম্বে চলচ্চিত্র জগতের সুরকার নওশাদের সহকারী ছিলেন মোহাম্মদ শফি। মোহাম্মদ শফির সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে বশির আহমেদের। তার সহযোগিতায় বোম্বে সংগীত জগতে গান গাইবার সুযোগ পান তিনি। ১৯৫৪-৫৫ সালে গীতা দত্ত এবং আশা ভোঁসলের সাথে দ্বৈত কণ্ঠে গান করেন বশির আহমেদ। বোম্বেতে তিনি ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খানের সান্নিধ্যে আসেন এবং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নেন।
বশির আহমেদ জানিয়েছেন, তিনি ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের পানের পিকদানি এগিয়ে দিতেন। তিনিও তখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু ওস্তাদের প্রতি সম্মানবোধ তার ছিল। বোম্বে থাকার সময়ই শিল্পী তালাত মাহমুদের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে বশির আহমেদের। ১৯৬০ সালে চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং গুলিস্তান সিনেমা হলের মালিক দোসানীর আমন্ত্রণে তালাত মাহমুদের সাথে ঢাকায় আসেন বশির আহমেদ। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহ শহরে একই মঞ্চে উভয়ে সংগীত পরিবেশন করেন। এরপর মাঝে মাঝেই ঢাকায় আসতেন।
বশির আহমেদ ১৯৬৩ সালে ঢাকায় নির্মিত উর্দু চলচ্চিত্র ‘তালাশ’-এ গান করেন। চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে ব্যস্ততা বাড়তে থাকলে ১৯৬৪ সালে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। ষাটের দশকে ঢাকায় নির্মিত উর্দু-বাংলা দ্বিভাষিক চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বশির আহমেদের। ১৯৬৯ সালে ‘ময়নামতি’ ছায়াছবিতে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘ডেকো না আমারে তুমি কাছে ডেকো না’ এবং গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’ গান দুটির সুরকার ও গায়ক ছিলেন বশির আহমেদ। গান দুটির আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা তাকে বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক ও গায়ক হিসেবে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা এনে দেয়।
ষাট ও সত্তরের দশকে দেশের সংগীত বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল রেডিও। এ সময়ে রেডিওতে তিনি ‘তোমার কাজল কেশ ছড়ালো বলে’, ‘আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো’, ‘যদি যেতে চাও যাও চলে যাও’ প্রভৃতি গান করেন। এসব গানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংগীতপ্রিয় সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন বশির আহমেদ। শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেওয়া বশির আহমেদের গায়কীতে নিজস্ব একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। রাগপ্রধান, অলংকারধর্মী বাংলা গান তিনি অত্যন্ত সহজে, মাধুর্যমণ্ডিত করে গাইতে পারতেন। বাংলা চলচ্চিত্র এবং আধুনিক ধারার বাংলা সংগীতের অনেক জনপ্রিয় গানের সুরকার ও গায়ক বশির আহমেদ।
বশির আহমেদের স্ত্রী মীনা বশিরও জননন্দিত শিল্পী ছিলেন। একক কণ্ঠে এবং বশির আহমেদের সাথে দ্বৈত কণ্ঠে অনেক জনপ্রিয় গান করেছেন। বশির আহমেদ ছিলেন আপাদমস্তক সংগীতময় মানুষ। গান গাওয়া, সুর রচনা, সংগীত পরিচালনা ছাড়াও তিনি গান শিখিয়েছেন অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের। তার শিষ্যরা অনেকেই আজ প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী। সংগীতক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বশির আহমেদ ২০০৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। দেরিতে হলেও তিনি এই স্বীকৃতি পেয়েছেন, এটা জীবদ্দশায় তার জন্য আনন্দদায়ক ছিল, ভাবতে ভালো লাগে।
বশির আহমেদ ছিলেন সব্যসাচী। লম্বা কাঠামোর অধিকারী বশির আহমেদ ছিলেন সুদর্শন। সিনেমার হিরোর অফারও তার কাছে এসেছিল। বোম্বেতে তিনি উপমহাদেশের বরেণ্য ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর কাছে তালিম নিয়ে প্রচুর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কবি ও গীতিকার।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তাফিজ তার ‘সাগর’ ছবির জন্য গান লিখতে বশির আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বশির আহমেদ ওই ছবির গান লেখেন এবং চমৎকারভাবে গেয়েছিলেন ‘যো দেখা প্যায়ার তেরা’। একইভাবে রবিন ঘোষও তার ছবির গান লেখার জন্য বশির আহমেদকে অনুরোধ করেন।
১৯৬৪ সালে ‘কারোয়ান’ ছবির জন্য বশির আহমেদ গান লিখেছিলেন এবং অসাধারণ গেয়েছিলেন ‘যব তোম একেলে হোগে হাম ইয়াদ আয়েঙ্গে।’ গানটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। রেডিও পাকিস্তানে ষাটের দশকে সবচেয়ে বেশি বাজতো গানটি।
১৯৬৩ সালে ঢাকাভিত্তিক উর্দু বা বাংলা চলচ্চিত্র ‘তালাশ’-এর দ্বৈত সংস্করণে বশির আহমেদকে প্রথমবারের মতো যুক্ত করা হয়। ১৯৬০-এর দশকে মাসুদ রানা এবং আহমেদ রুশদির মতো শিল্পীদের আধিপত্য সত্ত্বেও তিনি ঢাকাভিত্তিক উর্দু চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্লেব্যাক পুরুষ কণ্ঠশিল্পী হয়ে ওঠেন এবং অনেক সুপারহিট গান গেয়েছিলেন। তিনি ১৯৬৭ সালে ‘দর্শন’ চলচ্চিত্রে ৮টি গান গেয়েছিলেন এবং ৮টি গানই তিনি লিখে অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেন। সেসবের বেশিরভাগই সুপার হিট ছিল। পাকিস্তানে তার সর্বশেষ ছবি হিল স্টেশন ছিল সম্ভবত ১৯৭২ সালে।
ফজল-এ-খোদার খুব ঘনিষ্ঠজন ছিলেন বশির আহমেদ। ব্যক্তিগত পরিসরে বশির আহমেদকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে ফজল-এ-খোদার ছেলে ওয়াসিফ-এ-খোদার। তিনি লিখেছেন, ‘চিত্রালী, পূর্বাণী না সিনেমা ঠিক মনে নেই, এর কোনো একটিতে একবার সুরকার ও গীতিকার জুটির তালিকা ছাপা হয়েছিল। সেখানে ছিল বশির আহমেদের সঙ্গে ফজল-এ-খোদার নাম। ফজল-এ-খোদা আমার পিতা। আমাদের বাসায় নিয়মিত আসতেন বশির আহমেদ। শিল্পী বশির আহমেদের সঙ্গে আমার বাবার সম্পর্ক এতাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে, তিনি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিলেন।’
প্রথমেই বলতে হয় ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের কথা। সময় টেলিভিশনে এই গানের ওপর এক অনুষ্ঠানে ফজল-এ-খোদা বলেছিলেন, ‘আমি বশিরের জন্যই গানটি লিখেছিলাম।’ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তার ‘সংগীতভাবনা’ নামের প্রবন্ধের বইয়ে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ শিরোনামের লেখা থেকে জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো যায়- এ রকম একটি গানের কাঠামো এবং সুর নিয়ে বশির আহমেদের সঙ্গে তার কথা হয়। তিনি গানটি লেখার পর বশির আহমেদকে দিয়েছিলেন কিন্তু তখন তা রেকর্ড করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে মোহাম্মদ আবদুল জব্বার নিজের সুরে গানটি রেকর্ড করেন। তারপর অনেক দিন কেটে গেছে।
বাংলা গানকে বশির আহমেদ মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন। মাতৃভাষা উর্দু হলেও বাংলাতেও গান লিখেছেন অজস্র। বাংলা গানের প্রতি তার ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ তার গান গ্রহণ করে। আমৃত্যু তিনি আমাদের গানের ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছেন তার মেধা দিয়ে, তার প্রতিভা দিয়ে। ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল তিনি ঢাকায় পরলোকগমন করেন।
আমাদের দেশে শুধু সংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা খুব কঠিন। সেই কঠিন কাজটিকেই জীবনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বশির আহমেদ। শত প্রতিকূলতার মুখেও বিশুদ্ধ সংগীতকে কখনো বিসর্জন দেননি। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করেছেন সংগীত শিল্পের সাধক হয়ে। তার জীবন তার সংগীত আমাদের উত্তর-প্রজন্মকে প্রেরণা জোগাবে, আলো দেখাবে।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ


























