ঢাকা ১২:৫২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ইসি গঠনে সংলাপ: সংবিধান ও রাজনীতি

  • আপডেট সময় : ১০:৪৩:৪৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ জানুয়ারী ২০২২
  • ১১১ বার পড়া হয়েছে

এরশাদুল আলম প্রিন্স : বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ শেষ হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। নতুন কমিশন গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইতোমধ্যে সংলাপ শুরু করেছেন। জাতীয় পার্টি (জাপা) সংলাপে অংশগ্রহণ করে দুই জনের নামও প্রস্তাব করেছে। গণফোরাম, ওয়ার্কার্স পার্টি সংলাপে অংশগ্রহণ করেছে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে চলমান রাষ্ট্রপতির সংলাপে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ১২ জানুয়ারি বিকাল চারটায় তাদের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিতে বলা হয়েছে। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রপতি কমিশন গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
সংলাপ করতে রাষ্ট্রপতির কোনও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। কমিশন গঠনে সংলাপ তার ইতিবাচক মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। সংলাপের মাধ্যমে তিনি মতৈক্যের ভিত্তিতে কমিশন গঠন করতে পারেন। চাইলে তিনি সংলাপের একটা সারসংক্ষেপ বা সুপারিশ ৪৮(৫) অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাতে পারেন। রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি বা কমিশনার হিসেবে কাদের নাম প্রস্তাব করেছেন সেটিও তার দফতরের মাধ্যমে জনগণকে জানাতে পারেন। সংবিধান অনুযায়ী এ কাজ করতে কোনও বাধা নেই।
প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে কমিশন গঠনের পরামর্শ দিতে পারেন। সেটি প্রধানমন্ত্রীর উদারতা। সেরকম হলে সংলাপের একটা ফল হয়তো পাওয়া যাবে। কাজেই সংলাপের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর ওপর।
রাষ্ট্রপতি যেহেতু সংলাপ শুরু করেছেন তাই তিনি এটি চালিয়ে যাবেন এবং সংলাপ থেকে গ্রহণযোগ্য সার্চ কমিটি ও কমিশনারদের নাম প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করবেন এটা প্রত্যাশিত। সংবিধানের ৪৮(৫) অনুচ্ছেদ মোতাবেক আপাতত এটুকুই রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারাধীন। ৪৮(৫) অনুচ্ছেদ বলছে , রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলে যেকোনও বিষয় মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী পেশ করবেন। রাষ্ট্রপতি শুধু বিবেচনার জন্য পেশ করতে পারেন। বিবেচনা করা বা না করা প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের বিবেচনার বিষয়। আর প্রধানমন্ত্রী যদি রাষ্ট্রপতির বিবেচনা গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতিকে সে অনুযায়ী কমিশন গঠনের জন্য পরামর্শ দেন, তবেই বলা যাবে সংলাপ ফলপ্রসূ হয়েছে। তা না হলে পুরো বিষয়টিই এক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
সুপারিশ ও পরামর্শের বিষয়টি পুরোই একটা দাফতরিক বিষয়। রাষ্ট্রপতির দফতর ও প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মধ্যে চিঠি চালাচালির বিষয়। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে কী সুপারিশ করেছেন সেটি চাইলে রাষ্ট্রপতি জনগণকে জানাতে পারেন। সংলাপ যেহেতু একটি রাজনৈতিক বিষয় তাই জনগণও এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই পারে। সংবিধান অনুযায়ী এ প্রশ্ন করাতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু রাষ্ট্রপতির সুপারিশ মেনে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন কিনা বা আদতে প্রধানমন্ত্রী কী পরামর্শ দিয়েছেন সে প্রশ্ন তোলার কোনও সাংবিধানিক সুযোগ নেই [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]।
কাজেই, চলমান সংলাপ রাষ্ট্রপতির একান্ত নিজস্ব এখতিয়ার আর কমিশন গঠন করা তার সাংবিধানিক এখতিয়ার। সাংবিধানিক এখতিয়ার প্রয়োগ করার জন্য তিনি ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, সংলাপ-পরামর্শ-চা চক্র করতেই পারেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, একটি আপাতত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন। আপাতত গ্রহণযোগ্য কমিশনই এখন মূল বিষয়। কারণ, ভবিষ্যতে কমিশনের কার্যক্রমই বলে দেবে এটি আসলেই স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শেষমেশ গ্রহণযোগ্য কমিশন হয়েছে কিনা। এক্ষেত্রে জন্মবৃত্তান্তের চেয়ে কর্মবৃত্তান্তই বড় কথা।
তবে, রাষ্ট্রপতি যেহেতু সংলাপ শুরু করেছেন, তাই এ মুহূর্তে একটি সার্থক সংলাপই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু লোকদেখানো সংলাপ বা নিয়ম রক্ষার সংলাপ কাম্য নয়। এর আগে আরও দুইবার সংলাপ হয়েছিল বলে এবারও সংলাপ করতে হবে বিষয়টি এমন নয়। এটা কোনও সাংবিধানিক রেওয়াজও নয়।

কমিশন গঠনে আইনের অনুপস্থিতির অভাবে রাষ্ট্রপতি সংলাপে সমাধান খুঁজছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেরকম একটি আইনের বদলে আমরা পেয়েছি রাষ্ট্রপতির সংলাপ। কাজেই সে সংলাপটি যাতে সফল হয় সেটি অন্তত জনগণ আশা করতেই পারে। বিরোধী পক্ষের মুখ বন্ধ করার জন্য সংলাপ হলে সেটি হবে নিছক কালক্ষেপণ। এতে আপাতত সরকার রাজনৈতিকভাবে বলতেই পারে যে রাষ্ট্রপতি সবার সঙ্গে সংলাপ করেই কমিশন গঠন করেছেন, এখানে সরকারের কিছু করার নেই। কিন্তু কমিশনের ভালো-মন্দের দায়ভার শেষ পর্যন্ত সরকারকেই নিতে হয়। বিগত দুই কমিশন – রকিবুদ্দিন কমিশন ও বর্তমান নুরুল হুদা কমিশনের অধীনে নির্বাচনের সুবিধা সরকার নিয়ে থাকলে এই কমিশনের ভালোমন্দের দায়ভারও সরকারকেই নিতে হবে। মাগুরা নির্বাচনের দায়ভার যদি বিএনপিকে আজও বইতে হয় তবে রকিব-হুদা কমিশনের দায়ভার কেন আওয়ামী লীগ নেবে না? সব রাজনৈতিক দল এই দায় নিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন করে।
একটি গ্রহণযোগ্য কমিশন গঠন ও একে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে দেওয়াই মূল কথা। এ কাজটি সংলাপ করেও হতে পারে, সংলাপ ছাড়াও হতে পারে। সবার সঙ্গে আলাপ করে নিজের মতো কমিশন গঠন করা সরকারের রাজনৈতিক কৌশল হতেই পারে, তবে এতে দেশের স্বার্থ রক্ষা হবে না। আর সম্মতি বা সংলাপের ভিত্তিতে যদি কমিশন গঠন হয়েও থাকে সেই কমিশনকে সরকার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে দেয় কিনা সেটাই বড় কথা। সরকারের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা ছাড়া কমিশন নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না- তা সেই কমিশন সংলাপ করেই গঠিত হোক বা না করেই হোক।
সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু তার মর্যাদা ও অবস্থান সবার ওপরে। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিতই থাকে। সংসদীয় গণতন্ত্রের আদর্শ ওয়েস্ট মিনিস্টার গণতন্ত্রেও রানির ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু তার মর্যাদা সবার ওপরে। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রপতির অনেক ক্ষমতা ছিল। রাষ্ট্রপতি সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংসদ ভেঙে দিতে পারতেন। তিনি একাই আইন জারি করতে পারতেন। এতে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বাধীনতার পর আমাদের সংবিধান প্রণেতারা সেই প্রেক্ষাপটেই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত করতে চেয়েছেন। সেই সীমিত ক্ষমতার ব্যবহার করে এখন তিনি শুধু সংলাপ করতে পারেন বা চা খাওয়ার দাওয়াত দিতে পারেন।
আগের বারের সংলাপের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশন সদস্যদের নাম প্রস্তাব করেছে। সেই কমিশনের ভূমিকা আমরা দেখেছি। বর্তমান এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতির মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে ২০২৩-এর মার্চে। সবারই মেয়াদ একদিন শেষ হয়ে যায়। রয়ে যায় কর্ম। ইয়াজ উদ্দিনের কর্মও রয়ে গেছে, বর্তমান রাষ্ট্রপতির কর্মও রয়ে যাবে। রাষ্ট্রপতি বা রাজনীতিকদের কর্ম রাজনৈতিক ইতিহাসেরই অংশ। শামসুল হুদা কমিশন ও নুরুল হুদা কমিশন যেমন এক নয়, আবু হেনা কমিশন আর রকিবুদ্দিন কমিশনও এক নয়।
সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। সংবিধান বা কোনও আইনই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা কমিশনারদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনে অন্তরায় নয়। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের পূর্ণ ম্যান্ডেট তাদের রয়েছে। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের মূল কথা সেটাই। সংবিধানের রক্ষক সুপ্রিম কোর্টও এক রায়ে সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, “ৃরঃ ধঢ়ঢ়বধৎং ঃযধঃ ঃযব ঊষবপঃরড়হ ঈড়সসরংংরড়হ যধং মরাবহ ধ ঢ়ষবহধৎু ঢ়ড়বিৎ ঃড় ংঁঢ়বৎরহঃবহফবহপব, ফরৎবপঃরড়হ ধহফ পড়হঃৎড়ষ ড়ভ ঃযব ঢ়ৎবঢ়ধৎধঃরড়হ ড়ভ ঃযব বষবপঃড়ৎধষ ৎড়ষষং ভড়ৎ বষবপঃরড়হ ধহফ ঃযবৎবভড়ৎব, যিধঃবাবৎ ঢ়ড়বিৎ রং হবপবংংধৎু ভড়ৎ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব সঁংঃ নব ঢ়ৎবংঁসবফ ঃড় নব ঃযবৎব ঁহষবংং ঃযবৎব রং ধহ ড়ঁংঃবৎ নু বীঢ়ৎবংংরড়হ ড়ভ ঃযব ঢ়ৎড়ারংরড়হ.” কাজেই যে কমিশনই গঠিত হোক… সংলাপের মাধ্যমে হোক বা না হোক, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে কমিশন কী ভূমিকা রাখে সেটাই বিবেচ্য (অনফঁষ গড়সবহ ঈযড়ফিযঁৎু ধহফ ঙঃযবৎং াং. ইধহমষধফবংয ধহফ ঙঃযবৎং)।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ইসি গঠনে সংলাপ: সংবিধান ও রাজনীতি

আপডেট সময় : ১০:৪৩:৪৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ জানুয়ারী ২০২২

এরশাদুল আলম প্রিন্স : বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ শেষ হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। নতুন কমিশন গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইতোমধ্যে সংলাপ শুরু করেছেন। জাতীয় পার্টি (জাপা) সংলাপে অংশগ্রহণ করে দুই জনের নামও প্রস্তাব করেছে। গণফোরাম, ওয়ার্কার্স পার্টি সংলাপে অংশগ্রহণ করেছে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে চলমান রাষ্ট্রপতির সংলাপে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ১২ জানুয়ারি বিকাল চারটায় তাদের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিতে বলা হয়েছে। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রপতি কমিশন গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
সংলাপ করতে রাষ্ট্রপতির কোনও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। কমিশন গঠনে সংলাপ তার ইতিবাচক মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। সংলাপের মাধ্যমে তিনি মতৈক্যের ভিত্তিতে কমিশন গঠন করতে পারেন। চাইলে তিনি সংলাপের একটা সারসংক্ষেপ বা সুপারিশ ৪৮(৫) অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাতে পারেন। রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি বা কমিশনার হিসেবে কাদের নাম প্রস্তাব করেছেন সেটিও তার দফতরের মাধ্যমে জনগণকে জানাতে পারেন। সংবিধান অনুযায়ী এ কাজ করতে কোনও বাধা নেই।
প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে কমিশন গঠনের পরামর্শ দিতে পারেন। সেটি প্রধানমন্ত্রীর উদারতা। সেরকম হলে সংলাপের একটা ফল হয়তো পাওয়া যাবে। কাজেই সংলাপের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর ওপর।
রাষ্ট্রপতি যেহেতু সংলাপ শুরু করেছেন তাই তিনি এটি চালিয়ে যাবেন এবং সংলাপ থেকে গ্রহণযোগ্য সার্চ কমিটি ও কমিশনারদের নাম প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করবেন এটা প্রত্যাশিত। সংবিধানের ৪৮(৫) অনুচ্ছেদ মোতাবেক আপাতত এটুকুই রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারাধীন। ৪৮(৫) অনুচ্ছেদ বলছে , রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলে যেকোনও বিষয় মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী পেশ করবেন। রাষ্ট্রপতি শুধু বিবেচনার জন্য পেশ করতে পারেন। বিবেচনা করা বা না করা প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের বিবেচনার বিষয়। আর প্রধানমন্ত্রী যদি রাষ্ট্রপতির বিবেচনা গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতিকে সে অনুযায়ী কমিশন গঠনের জন্য পরামর্শ দেন, তবেই বলা যাবে সংলাপ ফলপ্রসূ হয়েছে। তা না হলে পুরো বিষয়টিই এক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
সুপারিশ ও পরামর্শের বিষয়টি পুরোই একটা দাফতরিক বিষয়। রাষ্ট্রপতির দফতর ও প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মধ্যে চিঠি চালাচালির বিষয়। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে কী সুপারিশ করেছেন সেটি চাইলে রাষ্ট্রপতি জনগণকে জানাতে পারেন। সংলাপ যেহেতু একটি রাজনৈতিক বিষয় তাই জনগণও এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই পারে। সংবিধান অনুযায়ী এ প্রশ্ন করাতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু রাষ্ট্রপতির সুপারিশ মেনে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন কিনা বা আদতে প্রধানমন্ত্রী কী পরামর্শ দিয়েছেন সে প্রশ্ন তোলার কোনও সাংবিধানিক সুযোগ নেই [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]।
কাজেই, চলমান সংলাপ রাষ্ট্রপতির একান্ত নিজস্ব এখতিয়ার আর কমিশন গঠন করা তার সাংবিধানিক এখতিয়ার। সাংবিধানিক এখতিয়ার প্রয়োগ করার জন্য তিনি ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, সংলাপ-পরামর্শ-চা চক্র করতেই পারেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, একটি আপাতত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন। আপাতত গ্রহণযোগ্য কমিশনই এখন মূল বিষয়। কারণ, ভবিষ্যতে কমিশনের কার্যক্রমই বলে দেবে এটি আসলেই স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শেষমেশ গ্রহণযোগ্য কমিশন হয়েছে কিনা। এক্ষেত্রে জন্মবৃত্তান্তের চেয়ে কর্মবৃত্তান্তই বড় কথা।
তবে, রাষ্ট্রপতি যেহেতু সংলাপ শুরু করেছেন, তাই এ মুহূর্তে একটি সার্থক সংলাপই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু লোকদেখানো সংলাপ বা নিয়ম রক্ষার সংলাপ কাম্য নয়। এর আগে আরও দুইবার সংলাপ হয়েছিল বলে এবারও সংলাপ করতে হবে বিষয়টি এমন নয়। এটা কোনও সাংবিধানিক রেওয়াজও নয়।

কমিশন গঠনে আইনের অনুপস্থিতির অভাবে রাষ্ট্রপতি সংলাপে সমাধান খুঁজছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেরকম একটি আইনের বদলে আমরা পেয়েছি রাষ্ট্রপতির সংলাপ। কাজেই সে সংলাপটি যাতে সফল হয় সেটি অন্তত জনগণ আশা করতেই পারে। বিরোধী পক্ষের মুখ বন্ধ করার জন্য সংলাপ হলে সেটি হবে নিছক কালক্ষেপণ। এতে আপাতত সরকার রাজনৈতিকভাবে বলতেই পারে যে রাষ্ট্রপতি সবার সঙ্গে সংলাপ করেই কমিশন গঠন করেছেন, এখানে সরকারের কিছু করার নেই। কিন্তু কমিশনের ভালো-মন্দের দায়ভার শেষ পর্যন্ত সরকারকেই নিতে হয়। বিগত দুই কমিশন – রকিবুদ্দিন কমিশন ও বর্তমান নুরুল হুদা কমিশনের অধীনে নির্বাচনের সুবিধা সরকার নিয়ে থাকলে এই কমিশনের ভালোমন্দের দায়ভারও সরকারকেই নিতে হবে। মাগুরা নির্বাচনের দায়ভার যদি বিএনপিকে আজও বইতে হয় তবে রকিব-হুদা কমিশনের দায়ভার কেন আওয়ামী লীগ নেবে না? সব রাজনৈতিক দল এই দায় নিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন করে।
একটি গ্রহণযোগ্য কমিশন গঠন ও একে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে দেওয়াই মূল কথা। এ কাজটি সংলাপ করেও হতে পারে, সংলাপ ছাড়াও হতে পারে। সবার সঙ্গে আলাপ করে নিজের মতো কমিশন গঠন করা সরকারের রাজনৈতিক কৌশল হতেই পারে, তবে এতে দেশের স্বার্থ রক্ষা হবে না। আর সম্মতি বা সংলাপের ভিত্তিতে যদি কমিশন গঠন হয়েও থাকে সেই কমিশনকে সরকার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে দেয় কিনা সেটাই বড় কথা। সরকারের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা ছাড়া কমিশন নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না- তা সেই কমিশন সংলাপ করেই গঠিত হোক বা না করেই হোক।
সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু তার মর্যাদা ও অবস্থান সবার ওপরে। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিতই থাকে। সংসদীয় গণতন্ত্রের আদর্শ ওয়েস্ট মিনিস্টার গণতন্ত্রেও রানির ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু তার মর্যাদা সবার ওপরে। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রপতির অনেক ক্ষমতা ছিল। রাষ্ট্রপতি সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংসদ ভেঙে দিতে পারতেন। তিনি একাই আইন জারি করতে পারতেন। এতে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বাধীনতার পর আমাদের সংবিধান প্রণেতারা সেই প্রেক্ষাপটেই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত করতে চেয়েছেন। সেই সীমিত ক্ষমতার ব্যবহার করে এখন তিনি শুধু সংলাপ করতে পারেন বা চা খাওয়ার দাওয়াত দিতে পারেন।
আগের বারের সংলাপের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশন সদস্যদের নাম প্রস্তাব করেছে। সেই কমিশনের ভূমিকা আমরা দেখেছি। বর্তমান এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতির মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে ২০২৩-এর মার্চে। সবারই মেয়াদ একদিন শেষ হয়ে যায়। রয়ে যায় কর্ম। ইয়াজ উদ্দিনের কর্মও রয়ে গেছে, বর্তমান রাষ্ট্রপতির কর্মও রয়ে যাবে। রাষ্ট্রপতি বা রাজনীতিকদের কর্ম রাজনৈতিক ইতিহাসেরই অংশ। শামসুল হুদা কমিশন ও নুরুল হুদা কমিশন যেমন এক নয়, আবু হেনা কমিশন আর রকিবুদ্দিন কমিশনও এক নয়।
সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। সংবিধান বা কোনও আইনই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা কমিশনারদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনে অন্তরায় নয়। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের পূর্ণ ম্যান্ডেট তাদের রয়েছে। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের মূল কথা সেটাই। সংবিধানের রক্ষক সুপ্রিম কোর্টও এক রায়ে সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, “ৃরঃ ধঢ়ঢ়বধৎং ঃযধঃ ঃযব ঊষবপঃরড়হ ঈড়সসরংংরড়হ যধং মরাবহ ধ ঢ়ষবহধৎু ঢ়ড়বিৎ ঃড় ংঁঢ়বৎরহঃবহফবহপব, ফরৎবপঃরড়হ ধহফ পড়হঃৎড়ষ ড়ভ ঃযব ঢ়ৎবঢ়ধৎধঃরড়হ ড়ভ ঃযব বষবপঃড়ৎধষ ৎড়ষষং ভড়ৎ বষবপঃরড়হ ধহফ ঃযবৎবভড়ৎব, যিধঃবাবৎ ঢ়ড়বিৎ রং হবপবংংধৎু ভড়ৎ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব সঁংঃ নব ঢ়ৎবংঁসবফ ঃড় নব ঃযবৎব ঁহষবংং ঃযবৎব রং ধহ ড়ঁংঃবৎ নু বীঢ়ৎবংংরড়হ ড়ভ ঃযব ঢ়ৎড়ারংরড়হ.” কাজেই যে কমিশনই গঠিত হোক… সংলাপের মাধ্যমে হোক বা না হোক, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে কমিশন কী ভূমিকা রাখে সেটাই বিবেচ্য (অনফঁষ গড়সবহ ঈযড়ফিযঁৎু ধহফ ঙঃযবৎং াং. ইধহমষধফবংয ধহফ ঙঃযবৎং)।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট