ঢাকা ০৭:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসরায়েলের চরমপন্থি শক্তি ও ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ

  • আপডেট সময় : ০৫:৩৬:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪
  • ৫ বার পড়া হয়েছে

মুহাম্মাদ শোয়াইব : ইসরায়েলের চ্যানেল ১৩ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন গভিরের বিতর্কিত কার্যকলাপ ও পরিকল্পনার বিষয়ে তথ্য ফাঁস হয়েছে। প্রতিবেদনে জানা গেছে, বেন গভির সশস্ত্র মিলিশিয়া গঠন করে জেরুজালেমে উত্তেজনা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তার স্ত্রীর প্রভাবের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এই তথ্যগুলো ইসরায়েলে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ফাঁস হওয়া তথ্য অনুযায়ী বেন গভিরের লক্ষ্য ধর্মীয় জায়নবাদের মাধ্যমে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তন করা এবং বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রভাব বিস্তার করা। তার পরিকল্পনার একটি মূল উদ্দেশ্য হলো পশ্চিম তীর ও গাজায় নতুন বসতি স্থাপন এবং জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়ার পথ প্রস্তুত করা।
প্রতিবেদনটি জোর দিয়ে বলেছে যে, বেন গভির সশস্ত্র বসতি স্থাপনকারীদের সক্রিয় ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করছেন এবং জেরুজালেমের পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার পরিকল্পনা করছেন। বিশেষ করে আল-আকসা মসজিদের বিরুদ্ধে তার কার্যক্রম ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য চরম হুমকি সৃষ্টি করছে। তার এসব পরিকল্পনার কারণে ইসরায়েলের বিচারবিভাগীয় উপদেষ্টা তাকে বরখাস্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ফাঁসকৃত তথ্যে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, বেন গভির জেরুজালেমের অভ্যন্তরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে ইসরায়েলি আইন সেনাবাহিনীকে জেরুজালেমের অভ্যন্তরে কাজ করতে অনুমতি দেয় না। কারণ জেরুজালেমকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি পশ্চিম তীর বা গাজা স্ট্রিপের মতো দখলকৃত এলাকা নয়। শহরের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো নিয়ম নেই।
১৯৬৭ সালে ইসরায়েল জেরুজালেম সংযুক্ত করলেও এর ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের অধিকারের প্রশ্নে বৈষম্য বজায় রেখেছে। জেরুজালেমে সশস্ত্র ব্যক্তিদের উপস্থিতি মূলত ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নয়; বরং বিশেষ পুলিশ বাহিনীর যাদের ‘বর্ডার গার্ড’ বলা হয়। এই বাহিনী ইসরায়েলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন কাজ করে; যা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সেনাবাহিনীর কার্যক্রম থেকে ভিন্ন।
এই ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো বেন গভিরের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপকে সামনে এনেছে এবং ইসরায়েলের ভেতরে ও বাইরে এক গভীর আলোচনা শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তার কর্মকাণ্ড অঞ্চলটির স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদী হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
একইভাবে এ প্রতিবেদনটি ইসরায়েলি দখলদার প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার বিভ্রান্তি এবং বিশেষ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন গভির তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। জেরুজালেমে উত্তেজনা বাড়াতে তার এই প্রচেষ্টা ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতাকে প্রকাশ করছে।
ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো ইসরায়েলের ভেতরে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী; যিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে, তিনি নিজেই উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য কাজ করছেনÑ এমন অভিযোগ উঠেছে। এটি ইসরায়েলি সরকারের কার্যকারিতার এক সুস্পষ্ট অবনতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘সভ্য রাষ্ট্র’ হিসেবে গর্ব করা ইসরায়েল এখন একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসনের পরিবর্তে মিলিশিয়ার মতো আচরণ করছে বলে অনেকে মনে করছেন।
এই ফাঁসের সাথে বেন গভিরের পাশাপাশি আরও দুটি চরমপন্থি ব্যক্তিত্বের নাম এসেছেÑ
হানমাল ডরফম্যান: বেন গভিরের নেতৃত্বাধীন ‘ইহুদি মহত্ত্ব’ দলের নেতা।
বেন্টজি গোপস্টেইন: চরমপন্থি ‘লেহাভা’ সংগঠনের নেতা; যিনি বর্ণবাদী মতাদর্শের জন্য পরিচিত।
বিশেষত ফাঁস হওয়া তথ্যগুলোতে বেন্টজি গোপস্টেইনের উপস্থিতি তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। গোপস্টেইন কোনো সরকারি কর্মকর্তা নন। বরং ‘ইহুদি জাতিগত বিশুদ্ধতা’ প্রচারের জন্য একটি বেসরকারি সংগঠনের নেতা।
২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘লেহাভা’ সংগঠনটি চরমপন্থি এবং বেসরকারি হিসেবে পরিচিত। এটি ২০২১ সালে বাব আল-আমাউদ বিদ্রোহের মতো ঘটনায় ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে আরবদের বিরুদ্ধে ‘মৃত্যুর জন্য মৃত্যু’ সেøাগান তুলে উত্তেজনা ছড়ায়।
ইসরায়েলের রাজনৈতিক মহলে আলোচিত প্রশ্নটি হলো, জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী কেন এমন একটি সংগঠনের নেতার সাথে দেখা করছেন; যাকে ইসরায়েল নিজেই একটি বেসরকারি ও চরমপন্থি সংগঠন হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করে? এটি ইঙ্গিত করে যে বেন গভির তার মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করলেও নিজেকে এখনো একটি চরমপন্থি ধর্মীয় আন্দোলনের অংশ মনে করেন।
অন্যদিকে ইসরায়েলে যা ‘গভীর রাষ্ট্র’ নামে পরিচিত, সেটি বেন গভিরের কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এবং তার প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য এই ফাঁস হওয়া ঘটনাগুলোকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
এটি ইসরায়েলের ধর্মীয় ইহুদিবাদী আন্দোলনের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জয়েন্টগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করারও একটি অংশ হতে পারে।
ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো ইতামার বেন গভির এবং ইসরায়েলি সরকারের বিচারবিভাগীয় উপদেষ্টার মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ও দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করেছে।
বিচারবিভাগীয় উপদেষ্টা বেন গভিরকে বরখাস্ত করার দাবি করেছেন; যার প্রতিক্রিয়ায় বেন গভির সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং নিজেও উপদেষ্টাকে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়েছেন। এই দ্বন্দ্বে তিনি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে চাপ দিয়েছেন—তাকে হয় বেন গভিরের পক্ষ নিতে হবে, নয়তো বিচারবিভাগীয় উপদেষ্টার।
এটি ইসরায়েলি রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি গভীর চিত্র তুলে ধরেছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সহজেই বেন গভিরকে ত্যাগ করবেন না। কারণ তার রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখতে এবং বিশেষ করে বিচারবিভাগীয় সংস্কার প্রচেষ্টার জন্য বেন গভিরের সমর্থন তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
নেতানিয়াহু সম্ভবত এই বিশৃঙ্খলাকে তার নিজের রাজনৈতিক এজেন্ডা—বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা—অর্জনের একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন। যদিও এর মানে ধর্মীয় ইহুদিবাদী আন্দোলনের প্রতি আরও বেশি প্রভাব ছেড়ে দেওয়া, তবু তিনি নিশ্চিত করতে চান যে, তিনি ক্ষমতায় থাকবেন এবং বিচারিক তদন্ত এড়িয়ে যাবেন।
যদি বিচার বিভাগীয় উপদেষ্টা সফলভাবে বেন গভিরকে পদ থেকে সরাতে পারেন, তাহলে এটি ধর্মীয় জায়নবাদী আন্দোলনের শক্তিকে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল করবে।
এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যেখানে স্মোট্রিচ তার দলের সদস্যদের সঙ্গে সরকার থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন, যা নেতানিয়াহুর জন্য একটি বড় রাজনৈতিক সংকট তৈরি করবে।

জেরুজালেম সংক্রান্ত ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো বেন গভিরের বিপজ্জনক পরিকল্পনা এবং ধর্মীয় জায়নবাদী এজেন্ডার গভীরতাকে উন্মোচন করেছে। তার এই পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য হলো যেকোনো উপায়ে জেরুজালেমে উত্তেজনা সৃষ্টি করা; যাতে বড় ধরনের নিরাপত্তা অভিযানের ন্যায্যতা তৈরি করা যায়।
উদাহরণস্বরূপÑ ফাঁস হওয়া তথ্য অনুসারে বেন্টজি গোপস্টেইন একটি ফিলিস্তিনি বাড়িতে অস্ত্র রেখে তা ‘আবিষ্কার’ করার প্রস্তাব দেন, যাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যায় এবং সংঘর্ষ বাধিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে জেরুজালেম থেকে উৎখাত করা সম্ভব হয়।
এই ঘটনা দেখায় যে বেন গভির ও তার অনুসারীরা কেবল সুযোগের অপেক্ষা করেন না; বরং তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পিতভাবে সংঘর্ষের অজুহাত তৈরি করেন। তাই জেরুজালেমের ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে সংঘর্ষ আসন্ন এবং এটি এড়ানোর চেষ্টা না করে বরং মানসিক, নৈতিক এবং সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত হওয়া জরুরি।
আগামী সংঘর্ষের ফলাফল ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। হয় তারা জনপ্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমে দখলদারিত্বকে রুখে দেবে এবং তাদের অধিকার রক্ষা করবে, নয়তো জেরুজালেমকে চিরতরে হারাবে।
জেরুজালেম হারানোর অর্থ শুধু এই শহর বা আল-আকসা মসজিদ নয়, বরং সমগ্র পশ্চিম তীর দখলদারদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কারণ, দখলদাররা বিশ্বাস করে যে জেরুজালেম নিয়ন্ত্রণ করা মানেই গোটা অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি তাদের হাতে তুলে নেওয়া।
ইসরায়েলের বর্তমান সরকার ও তাকে নিয়ন্ত্রণকারী ধর্মীয় ইহুদিবাদী আন্দোলনের নেতাদের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করা আজ অত্যন্ত জরুরি। ইয়েটজ্যাক ব্রিকের মতো সতর্কতা দেওয়ার জন্য ফিলিস্তিনি সংস্করণের প্রয়োজন না হলেও ফিলিস্তিনিদের চারপাশে যা ঘটছে তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই নেতাদের প্রতিটি কথা ও পদক্ষেপকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। কারণ তারা যা বলে তা শুধু বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; তা সরাসরি মাঠে বাস্তবায়িত হয় এবং কঠোর সিদ্ধান্তে রূপান্তরিত হয়।
এই প্রতিবেদনে যাদের নাম উল্লেখ করা হলো, তারা অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ বা কৌশলগত চিন্তাবিদ নন; বরং তারা একদল ধর্মীয় উন্মাদনায় আবৃত চরমপন্থি, যারা বিশ্বাস করে যে তারা এক অলৌকিক যুগে বাস করছে। তারা এই সময়টিকে সীমাহীনভাবে তাদের লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ হিসেবে দেখে।
এই বিশ্বাস তাদের আরও বিপজ্জনক করে তোলে। কারণ তারা তাদের কর্মকাণ্ডের পরিণতি নিয়ে খুব একটা চিন্তা করে না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যতই চরম বা অবাস্তব হোক, তারা নির্দ্বিধায় তা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যায়।
এই চরমপন্থি মানসিকতা দমন করার একমাত্র উপায় হলো একটি সংগঠিত গণপ্রতিরোধ। গণ আন্দোলন তাদের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়া তাদের ছেড়ে দেওয়া মানে তাদের চরম স্বপ্নকে একটি তিক্ত বাস্তবে পরিণত হতে দেওয়া।
যে পরিস্থিতি সামনে আসছে, তা এড়ানো সম্ভব না হলেও সক্রিয়ভাবে এর মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হওয়া অপরিহার্য। সংঘর্ষ এবং প্রতিরোধের মাধ্যমে কেবল দখলদারদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করা সম্ভব।
ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য এটি কেবল টিকে থাকার সংগ্রাম নয়; এটি তাদের পরিচয়, তাদের ভূমি এবং তাদের ভবিষ্যৎ রক্ষার লড়াই।

লেখক: কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ইসরায়েলের চরমপন্থি শক্তি ও ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ

আপডেট সময় : ০৫:৩৬:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪

মুহাম্মাদ শোয়াইব : ইসরায়েলের চ্যানেল ১৩ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন গভিরের বিতর্কিত কার্যকলাপ ও পরিকল্পনার বিষয়ে তথ্য ফাঁস হয়েছে। প্রতিবেদনে জানা গেছে, বেন গভির সশস্ত্র মিলিশিয়া গঠন করে জেরুজালেমে উত্তেজনা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তার স্ত্রীর প্রভাবের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এই তথ্যগুলো ইসরায়েলে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ফাঁস হওয়া তথ্য অনুযায়ী বেন গভিরের লক্ষ্য ধর্মীয় জায়নবাদের মাধ্যমে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তন করা এবং বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রভাব বিস্তার করা। তার পরিকল্পনার একটি মূল উদ্দেশ্য হলো পশ্চিম তীর ও গাজায় নতুন বসতি স্থাপন এবং জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়ার পথ প্রস্তুত করা।
প্রতিবেদনটি জোর দিয়ে বলেছে যে, বেন গভির সশস্ত্র বসতি স্থাপনকারীদের সক্রিয় ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করছেন এবং জেরুজালেমের পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার পরিকল্পনা করছেন। বিশেষ করে আল-আকসা মসজিদের বিরুদ্ধে তার কার্যক্রম ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য চরম হুমকি সৃষ্টি করছে। তার এসব পরিকল্পনার কারণে ইসরায়েলের বিচারবিভাগীয় উপদেষ্টা তাকে বরখাস্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ফাঁসকৃত তথ্যে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, বেন গভির জেরুজালেমের অভ্যন্তরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে ইসরায়েলি আইন সেনাবাহিনীকে জেরুজালেমের অভ্যন্তরে কাজ করতে অনুমতি দেয় না। কারণ জেরুজালেমকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি পশ্চিম তীর বা গাজা স্ট্রিপের মতো দখলকৃত এলাকা নয়। শহরের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো নিয়ম নেই।
১৯৬৭ সালে ইসরায়েল জেরুজালেম সংযুক্ত করলেও এর ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের অধিকারের প্রশ্নে বৈষম্য বজায় রেখেছে। জেরুজালেমে সশস্ত্র ব্যক্তিদের উপস্থিতি মূলত ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নয়; বরং বিশেষ পুলিশ বাহিনীর যাদের ‘বর্ডার গার্ড’ বলা হয়। এই বাহিনী ইসরায়েলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন কাজ করে; যা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সেনাবাহিনীর কার্যক্রম থেকে ভিন্ন।
এই ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো বেন গভিরের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপকে সামনে এনেছে এবং ইসরায়েলের ভেতরে ও বাইরে এক গভীর আলোচনা শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তার কর্মকাণ্ড অঞ্চলটির স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদী হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
একইভাবে এ প্রতিবেদনটি ইসরায়েলি দখলদার প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার বিভ্রান্তি এবং বিশেষ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন গভির তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। জেরুজালেমে উত্তেজনা বাড়াতে তার এই প্রচেষ্টা ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতাকে প্রকাশ করছে।
ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো ইসরায়েলের ভেতরে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী; যিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে, তিনি নিজেই উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য কাজ করছেনÑ এমন অভিযোগ উঠেছে। এটি ইসরায়েলি সরকারের কার্যকারিতার এক সুস্পষ্ট অবনতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘সভ্য রাষ্ট্র’ হিসেবে গর্ব করা ইসরায়েল এখন একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসনের পরিবর্তে মিলিশিয়ার মতো আচরণ করছে বলে অনেকে মনে করছেন।
এই ফাঁসের সাথে বেন গভিরের পাশাপাশি আরও দুটি চরমপন্থি ব্যক্তিত্বের নাম এসেছেÑ
হানমাল ডরফম্যান: বেন গভিরের নেতৃত্বাধীন ‘ইহুদি মহত্ত্ব’ দলের নেতা।
বেন্টজি গোপস্টেইন: চরমপন্থি ‘লেহাভা’ সংগঠনের নেতা; যিনি বর্ণবাদী মতাদর্শের জন্য পরিচিত।
বিশেষত ফাঁস হওয়া তথ্যগুলোতে বেন্টজি গোপস্টেইনের উপস্থিতি তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। গোপস্টেইন কোনো সরকারি কর্মকর্তা নন। বরং ‘ইহুদি জাতিগত বিশুদ্ধতা’ প্রচারের জন্য একটি বেসরকারি সংগঠনের নেতা।
২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘লেহাভা’ সংগঠনটি চরমপন্থি এবং বেসরকারি হিসেবে পরিচিত। এটি ২০২১ সালে বাব আল-আমাউদ বিদ্রোহের মতো ঘটনায় ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে আরবদের বিরুদ্ধে ‘মৃত্যুর জন্য মৃত্যু’ সেøাগান তুলে উত্তেজনা ছড়ায়।
ইসরায়েলের রাজনৈতিক মহলে আলোচিত প্রশ্নটি হলো, জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী কেন এমন একটি সংগঠনের নেতার সাথে দেখা করছেন; যাকে ইসরায়েল নিজেই একটি বেসরকারি ও চরমপন্থি সংগঠন হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করে? এটি ইঙ্গিত করে যে বেন গভির তার মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করলেও নিজেকে এখনো একটি চরমপন্থি ধর্মীয় আন্দোলনের অংশ মনে করেন।
অন্যদিকে ইসরায়েলে যা ‘গভীর রাষ্ট্র’ নামে পরিচিত, সেটি বেন গভিরের কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এবং তার প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য এই ফাঁস হওয়া ঘটনাগুলোকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
এটি ইসরায়েলের ধর্মীয় ইহুদিবাদী আন্দোলনের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জয়েন্টগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করারও একটি অংশ হতে পারে।
ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো ইতামার বেন গভির এবং ইসরায়েলি সরকারের বিচারবিভাগীয় উপদেষ্টার মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ও দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করেছে।
বিচারবিভাগীয় উপদেষ্টা বেন গভিরকে বরখাস্ত করার দাবি করেছেন; যার প্রতিক্রিয়ায় বেন গভির সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং নিজেও উপদেষ্টাকে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়েছেন। এই দ্বন্দ্বে তিনি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে চাপ দিয়েছেন—তাকে হয় বেন গভিরের পক্ষ নিতে হবে, নয়তো বিচারবিভাগীয় উপদেষ্টার।
এটি ইসরায়েলি রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি গভীর চিত্র তুলে ধরেছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সহজেই বেন গভিরকে ত্যাগ করবেন না। কারণ তার রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখতে এবং বিশেষ করে বিচারবিভাগীয় সংস্কার প্রচেষ্টার জন্য বেন গভিরের সমর্থন তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
নেতানিয়াহু সম্ভবত এই বিশৃঙ্খলাকে তার নিজের রাজনৈতিক এজেন্ডা—বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা—অর্জনের একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন। যদিও এর মানে ধর্মীয় ইহুদিবাদী আন্দোলনের প্রতি আরও বেশি প্রভাব ছেড়ে দেওয়া, তবু তিনি নিশ্চিত করতে চান যে, তিনি ক্ষমতায় থাকবেন এবং বিচারিক তদন্ত এড়িয়ে যাবেন।
যদি বিচার বিভাগীয় উপদেষ্টা সফলভাবে বেন গভিরকে পদ থেকে সরাতে পারেন, তাহলে এটি ধর্মীয় জায়নবাদী আন্দোলনের শক্তিকে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল করবে।
এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যেখানে স্মোট্রিচ তার দলের সদস্যদের সঙ্গে সরকার থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন, যা নেতানিয়াহুর জন্য একটি বড় রাজনৈতিক সংকট তৈরি করবে।

জেরুজালেম সংক্রান্ত ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো বেন গভিরের বিপজ্জনক পরিকল্পনা এবং ধর্মীয় জায়নবাদী এজেন্ডার গভীরতাকে উন্মোচন করেছে। তার এই পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য হলো যেকোনো উপায়ে জেরুজালেমে উত্তেজনা সৃষ্টি করা; যাতে বড় ধরনের নিরাপত্তা অভিযানের ন্যায্যতা তৈরি করা যায়।
উদাহরণস্বরূপÑ ফাঁস হওয়া তথ্য অনুসারে বেন্টজি গোপস্টেইন একটি ফিলিস্তিনি বাড়িতে অস্ত্র রেখে তা ‘আবিষ্কার’ করার প্রস্তাব দেন, যাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যায় এবং সংঘর্ষ বাধিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে জেরুজালেম থেকে উৎখাত করা সম্ভব হয়।
এই ঘটনা দেখায় যে বেন গভির ও তার অনুসারীরা কেবল সুযোগের অপেক্ষা করেন না; বরং তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পিতভাবে সংঘর্ষের অজুহাত তৈরি করেন। তাই জেরুজালেমের ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে সংঘর্ষ আসন্ন এবং এটি এড়ানোর চেষ্টা না করে বরং মানসিক, নৈতিক এবং সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত হওয়া জরুরি।
আগামী সংঘর্ষের ফলাফল ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। হয় তারা জনপ্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমে দখলদারিত্বকে রুখে দেবে এবং তাদের অধিকার রক্ষা করবে, নয়তো জেরুজালেমকে চিরতরে হারাবে।
জেরুজালেম হারানোর অর্থ শুধু এই শহর বা আল-আকসা মসজিদ নয়, বরং সমগ্র পশ্চিম তীর দখলদারদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কারণ, দখলদাররা বিশ্বাস করে যে জেরুজালেম নিয়ন্ত্রণ করা মানেই গোটা অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি তাদের হাতে তুলে নেওয়া।
ইসরায়েলের বর্তমান সরকার ও তাকে নিয়ন্ত্রণকারী ধর্মীয় ইহুদিবাদী আন্দোলনের নেতাদের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করা আজ অত্যন্ত জরুরি। ইয়েটজ্যাক ব্রিকের মতো সতর্কতা দেওয়ার জন্য ফিলিস্তিনি সংস্করণের প্রয়োজন না হলেও ফিলিস্তিনিদের চারপাশে যা ঘটছে তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই নেতাদের প্রতিটি কথা ও পদক্ষেপকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। কারণ তারা যা বলে তা শুধু বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; তা সরাসরি মাঠে বাস্তবায়িত হয় এবং কঠোর সিদ্ধান্তে রূপান্তরিত হয়।
এই প্রতিবেদনে যাদের নাম উল্লেখ করা হলো, তারা অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ বা কৌশলগত চিন্তাবিদ নন; বরং তারা একদল ধর্মীয় উন্মাদনায় আবৃত চরমপন্থি, যারা বিশ্বাস করে যে তারা এক অলৌকিক যুগে বাস করছে। তারা এই সময়টিকে সীমাহীনভাবে তাদের লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ হিসেবে দেখে।
এই বিশ্বাস তাদের আরও বিপজ্জনক করে তোলে। কারণ তারা তাদের কর্মকাণ্ডের পরিণতি নিয়ে খুব একটা চিন্তা করে না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যতই চরম বা অবাস্তব হোক, তারা নির্দ্বিধায় তা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যায়।
এই চরমপন্থি মানসিকতা দমন করার একমাত্র উপায় হলো একটি সংগঠিত গণপ্রতিরোধ। গণ আন্দোলন তাদের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়া তাদের ছেড়ে দেওয়া মানে তাদের চরম স্বপ্নকে একটি তিক্ত বাস্তবে পরিণত হতে দেওয়া।
যে পরিস্থিতি সামনে আসছে, তা এড়ানো সম্ভব না হলেও সক্রিয়ভাবে এর মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হওয়া অপরিহার্য। সংঘর্ষ এবং প্রতিরোধের মাধ্যমে কেবল দখলদারদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করা সম্ভব।
ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য এটি কেবল টিকে থাকার সংগ্রাম নয়; এটি তাদের পরিচয়, তাদের ভূমি এবং তাদের ভবিষ্যৎ রক্ষার লড়াই।

লেখক: কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক