লেবাননের নারীরা বরাবরই উপেক্ষার জীবনযাপন করে আসছে। অধিকার বলতে তাদের এমনিতেই তেমন কিছু নেই। গত কয়েক দশকে অন্য আরব দেশগুলোর মতো সামাজিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে নতুন প্রগতিশীল আইন প্রণয়ন করেও পিছিয়ে আছে দেশটি। তারা পড়ে আছে অটোমান যুগের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আইনে। এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ থেকে ১৯৪৩ সালে স্বাধীনতা পাওয়া পর্যন্ত দেশটি পরিচালনা করেছে ফরাসিরা। ফলে সাংস্কৃতিকভাবে আরব ও ইউরোপের মিশ্রণ আছে দেশটিতে। এতকিছুর পরও ওই দেশের নারীরা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে।
‘লেবাননের নারীর অধিকার’ বললে শুধু জাতিগত লেবানিজ নারীদের অধিকারের কথা বোঝায় না। এক্ষেত্রে দেশটির তিন শ্রেণির নারীর কথা বলতে হয়। এগুলো হলো জাতিগত লেবানিজ নারী, এশীয় নারী অভিবাসী; যারা মূলত গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে এবং উদ্বাস্তু।
পিছিয়ে পড়া ও পিতৃতান্ত্রিক আইন এবং রাজনৈতিক ও বিচারিক বিষয়ে ধর্মীয় হস্তক্ষেপের কারণে লেবাননে নারীদের অবস্থা বেশ ভয়াবহ।
শেষের শ্রেণির নারীরা প্রধানত আসে ফিলিস্তিন ও সিরিয়া থেকে। আর গৃহকর্মী নারীদের একটা বড় অংশ সেখানে গেছে বাংলাদেশ থেকে।
১৯২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি লেবাননে পাস হয় ‘ল ফিফটিন’। এই আইনের কারণে বিদেশিদের সঙ্গে বিবাহিত লেবানিজ নারীদের সন্তানরা অনেক আইনি ও সামাজিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যেমন তারা সরকারি চাকরি বা জমির মালিক হতে পারবে না। অন্যদিকে দেশটিতে ফিলিস্তিনি ও সিরীয় শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না লেবানন সরকার। তাদের আশঙ্কা, তাদের পুনর্বাসন হলে দেশটিতে জাতিগত ভারসাম্য নষ্ট হবে। অনেকে মনে করছেন, চলমান সংকটের কারণে লেবাননের এই উদ্বাস্তু নারীদের নাগরিকত্বের বিষয়টি শিগগির সমাধানের সম্ভাবনা নেই।
পিছিয়ে পড়া ও পিতৃতান্ত্রিক আইন এবং রাজনৈতিক ও বিচারিক বিষয়ে ধর্মীয় হস্তক্ষেপের কারণে লেবাননে নারীদের অবস্থা বেশ ভয়াবহ। এ পরিস্থিতি কেবল আর্থিক সংকটের কারণেই নয়; বরং করোনা মহামারিও এটিকে জটিল করে তুলেছিল। ওই সময় দেশটিতে পারিবারিক সহিংসতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। লেবাননে অরক্ষিত নারী অভিবাসীরা: সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লেবাননে সামগ্রিকভাবে দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখ অভিবাসী গৃহকর্মী রয়েছে। বাংলাদেশি নারীরা এই জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। অনুমান করা হয়, লেবাননে ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। নিয়োগপদ্ধতি, প্রত্যাবাসন এবং লেবাননের আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে এই সংখ্যা ওঠানামা করতে পারে। এই নারীরা সেখানে আয়-উপার্জনের জন্য গিয়ে নানাভাবে নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হন। তাদের অনেকে দেশে ফিরতে পারেন; আবার অনেকের লাশও ফিরে পান না তাদের পরিবারের সদস্যরা। অনেককেই আজীবন বয়ে বেড়াতে হয় অসহনীয় কষ্ট আর অপমান।
লেবাননে বেশির ভাগ বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এই নারীদের কাজের নির্দিষ্ট নিয়মকানুন নেই। তাদের কর্মঘণ্টা বেশি, আছে বিশ্রামের অভাব এবং তাদের জীবনযাত্রার মান শোচনীয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক সংবাদের তথ্য বলছে, ২৪ সেপ্টেম্বর লেবাননে বেশ কিছু বাংলাদেশি নিখোঁজ ও আহত হয়েছেন। দেশটিতে ইসরায়েলের হামলার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। ১ অক্টোবর থেকে তীব্র বিমান হামলার মধ্যে কয়েকশ’ লোককে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। লাখ লাখ লোক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল ছেড়ে রাস্তা, মসজিদ, অস্থায়ী কেন্দ্র এবং অন্যান্য খোলা জায়গায় যারা আশ্রয় নিয়েছে। তারা খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকটের মধ্যে অমানবিক জীবন পার করছে।
লেবাননে বাংলাদেশি দূতাবাস জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছিল। তবে আটকে পড়া অভিবাসীরা অভিযোগ করেছেন, তারা বৈরুতে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। পুরুষ কর্মীদের পাশাপাশি সেখানে বেশি মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে নারী কর্মীদের।
সংঘাতের সময় আইনের শাসন প্রায়ই দুর্বল হয়ে যায়। অভিবাসী নারীদের ওপর এর মাত্রা আরও ভয়াবহ। পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশ ও আইন এই সংঘাতময় সময়ে লেবাননের নারীদের অবস্থা আরও করুণ করে তুলেছে।
সূত্র: আরব সেন্টার-ওয়াশিংটন ডিসি, আইওএম, ইউএন মাইগ্রেশন