বিশেষ প্রতিনিধি: ভরা মৌসুম প্রায় শুরু। তবু বাজারে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না মাছের রাজা ইলিশ। দুই মাসের নিষেধাজ্ঞার পর প্রত্যাশা ছিল নদীতে বা সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়বে ইলিশ। কিন্তু সেই আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে।প্রত্যাশা নিয়ে সাগরে বা নদীতে জাল ফেলেও জেলেরা তীরে ফিরছেন অনেকটাই খালি হাতে। জেলেরা তেমন ইলিশ পাচ্ছেন না। সাগরে গিয়ে তাদের খরচও উঠছে না। ইলিশ না পাওয়ার জন্য জেলেরা প্রথমদিকে বৃষ্টি না হওয়াকে দায়ী করলেও এখন বলছেন অন্য কথা। ইলিশ অধ্যুষিত এলাকা ভোলা, পিরোজপুর ও পাথরঘাটার জেলেদের সঙ্গে কথা বলে একটা সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে এমনই তথ্য।
মৎস্য বিভাগ বলছে, একটানা তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নাও হতে পারে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশ গভীর জলের মাছ হওয়ায় নদীর গভীরতা কমলে জালে সহজে ধরা পড়ে না। তাছাড়া বৃষ্টি ও পানিপ্রবাহ বাড়লে ইলিশ বেশি পাওয়া যায়। আবহাওয়া পরিবর্তন, নদীর নিরাপত্তা সংকট, ডুবোচর, গবেষণার ঘাটতি এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার অভাবে ইলিশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
জানা গেছে, সরকারের দেওয়া দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে গত ১ মে থেকে মেঘনা, ইলিশা ও কালাবদর নদীতে ইলিশ ধরতে নেমেছেন জেলেরা। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ইলিশ এখনও মিলছে না। ফলে দেশের বিভিন্ন ইলিশ আড়তে সরবরাহ কমেছে। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম হওয়ায় বেড়েছে ইলিশের দাম।
বরিশালের উত্তরে ভোলার কালাবদর নদ থেকে দক্ষিণে সাগরমোহনার বলেশ্বর নদী-কোথাও মিলছে না মিঠাপানির ইলিশ। আগে যেখানে জাল ফেললেই মিলতো মণকে মণ ইলিশ, সেখানে এখন সারা দিন চেষ্টা করেও পাওয়া যাচ্ছে না ৪-৫টির বেশি। সাগরপাড়ের পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ্বর নদীর জেলেরা বলছেন, নদ-নদীতে ইলিশের এই সংকট এখন পুরো দক্ষিণাঞ্চলে। সাগরের ইলিশে মোকাম ভরলেও মিলছে না জগদ্বিখ্যাত মিঠাপানির সুস্বাদু ইলিশ। যাকে বিলুপ্তির শঙ্কা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা আরো বলছেন, মূলত চার কারণে ভরা মৌসুমেও দেখা মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশের। কারণগুলো হলো- ইলিশ গভীর জলের মাছ হওয়ায় নদীর গভীরতা কমলে সহজে জালে ধরা পড়ে না। তবে বৃষ্টি ও পানিপ্রবাহ বাড়লে ইলিশ বেশি পাওয়া যায়। আবহাওয়া পরিবর্তন, নদীর নিরাপত্তা সংকট, ডুবোচর, গবেষণার ঘাটতি এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার অভাবে ইলিশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলেও মনে করেন বিশিষজ্ঞরা।
বছরের সর্বোচ্চ দাম: পটুয়াখালীর বাজারে বছরের সবচেয়ে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে জাতীয় মাছ ইলিশ। বাজারে সরবরাহ কম। একইসঙ্গে বৈরী আবহাওয়ায় জেলেরা সমুদ্রে না যেতে পারায় ক্রেতাদের জন্য ইলিশ এখন ‘স্বপ্নের মাছ’ হয়ে উঠেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য এই মাছ আর দৈনন্দিন খাবারের অংশ নয়, বরং বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পটুয়াখালী পৌর নিউমার্কেট এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, মাছ বিক্রেতারা মাত্র ৩০-৪০টি ইলিশ নিয়ে বসে আছেন। চারপাশে ক্রেতাদের ভিড় থাকলেও অনেকেই দাম শুনে ফিরে যাচ্ছেন। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের আবদার রাখতে বাধ্য হয়েই বেশি দামে ইলিশ কিনছেন। বর্তমানে বাজারে ৪০০-৪৫০ গ্রামের একটি ইলিশ কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে ১৬০০ টাকায়, ৫০০-৬০০ গ্রামের ইলিশ ১৮০০ টাকা, ৬০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ২১০০ টাকা এবং ৮০০-৯০০ গ্রামের ইলিশ ২৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এর চেয়েও বড়, ৯০০-১০০০ গ্রামের ইলিশের কেজি ২৫০০ টাকা ছুঁয়েছে। অথচ এই ইলিশ আগে সর্বনিম্ন ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৯০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে।
ইলিশ কিনতে এসে দাম শুনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফিরোজ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘ইলিশ মাছের যে দাম, আমাদের মতো মানুষের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। আমাদের আয় বুঝে ব্যয় করতে হয়।’
ক্রেতা জাকির হোসেন বলেন, ‘বাজারে অন্যান্য মাছের তুলনায় ইলিশ মাছ খুবই কম। এজন্য দামও অনেক বেশি। ইলিশ খাওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এত দামে কেনা সম্ভব না। দাম কমলে হয়তো পরে কিনবো।’
উচ্চমূল্যের কারণে বিক্রিও কম বলে জানান বিক্রেতা জলিল মৃধা। তিনি বলেন, ‘মাছ কম আসছে। এজন্য আমরা অনেক কম বিক্রি করছি। লাভও কম হচ্ছে। কাস্টমার আসে, দাম জিজ্ঞেস করে চলে যায়। বিক্রি করতে পারছি না।’
আরেক বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সমুদ্রে জেলেরা ঠিকমতো মাছ ধরতে পারছে না। বৈরী আবহাওয়া ও বৃষ্টির কারণে মাছের জোগান কমে গেছে। বাজারে চাহিদা বেশি কিন্তু সরবরাহ নেই। তাই দাম বেড়ে গেছে।’ এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘৫৮ দিনের অবরোধ শেষে জেলেরা যখন সমুদ্রে মাছ শিকারে গিয়েছিলেন, তখন অতিরিক্ত তাপমাত্রায় তারা তেমন মাছ ধরতে পারেননি। এরপর আবার টানা বৃষ্টিপাত ও বৈরী আবহাওয়ায় জেলেরা গভীর সমুদ্রে যেতে পারছেন না। ফলে ইলিশসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের সরবরাহ কমে গেছে। এ কারণেই ইলিশের দাম বর্তমানে বেশি।’ তিনি আরো বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং জেলেরা নিয়মিত মাছ ধরতে পারলে বাজারে সরবরাহ বাড়বে। তখন দামও কমে আসবে। সাধারণ মানুষের নাগালে ইলিশ ফিরে আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভরা মৌসুমে ইলিশের সংকটের জন্য অবাধে জাটকা শিকারকে দায়ী করা হচ্ছে। সরকার এবং মৎস্য বিভাগ জাটকা নিধন প্রতিরোধে কাজ করলেও চাপিলা নামে লাখ লাখ টন ইলিশের বাচ্চা (যা মূলত জাটকা) বিক্রি হচ্ছে, সেদিকে কারও নজর নেই। বাজারে বিক্রি হওয়া এসব চাপিলা বাঁচানো না গেলে বাঁচবে না মিঠাপানির ইলিশ। এছাড়াও জেলেরা জানিয়েছেন, ইদানিং নতুন এক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে মাছ শিকার করছেন অসাধু জেলেরা। ওই রাসায়নিক দ্রব্যটি পানিতে ফেললে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ভিড় করে। এক্ষেত্রে ছোট-বড় কিংবা পোনার কোনো ভেদাভেদ না রেখেই তা শিকার ও বিক্রি করেন জেলেরা। এর সঙ্গে রয়েছে খুঁটি বেড়া আর চায়না দুয়ারিসহ বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক জালে মাছ শিকার। এসব কারণেই নদ-নদী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ইলিশ।
ইলিশ বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, ভারতে ইলিশ প্রজনন মৌসুমের সময়কাল মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য জুন। একই সমুদ্রে খুব কাছাকাছি পানিসীমায় ভারত ও বাংলাদেশ দুইটি দেশ। অথচ বাংলাদেশের পানিসীমায় প্রজনন মৌসুম নির্ধারিত হয়েছে ১৫ জুন থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত। এখানে নিশ্চয়ই কোনো ত্রুটি রয়েছে। দুই দেশের সময়সীমা তো একই হওয়ার কথা। তার ওপর নিষেধাজ্ঞা চলাকালে বাংলাদেশের পানিসীমায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যায় হাজার হাজার ভারতীয় ট্রলার। এসব কারণেও কমে যাচ্ছে মিঠাপানির ইলিশ।
গবেষণা সংস্থা ইমেজ অ্যান্ড ইনফরমেশনের দেওয়া তথ্যমতে মিঠাপানির ইলিশের জন্যই বিখ্যাত বাংলাদেশ। ডিম ছাড়ার সময় হলে লবণাক্ত সাগর ছেড়ে নদ-নদীর গভীরে প্রবেশ করে উজানঠেলা ইলিশ। বিপরীত স্রোতে দ্রুতগতিতে চলতে গিয়ে মিঠাপানির ঘর্ষণে ইলিশের শরীর থেকে লবণ খসে চর্বির একটা আস্তর পড়ে। এই চর্বির কারণেই বাড়ে ইলিশের স্বাদ। যে স্বাদের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। একটি ইলিশ যত বেশি উল্টো স্রোতের বিপরীতে দৌড়াবে তত বেশি স্বাদের হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্য বিজ্ঞানী ও ইলিশ গবেষক, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, ‘জেলেরা যা বলছেন, তা সংকটের একটি কারণ হলেও প্রধান নয়। কেবল বরিশাল অঞ্চল যদি ধরেন, তাহলে এই অঞ্চলের রয়েছে ৭টি নদীমোহনা। এ নদীগুলো দিয়েই মূলত সাগর থেকে অভ্যন্তরভাগের পদ্মা, মেঘনাসহ অন্যান্য নদীতে আসে ইলিশ। সাগরের কম স্বাদের ইলিশ মিঠাপানির সংস্পর্শে এসে পায় দুর্দান্ত স্বাদ তৈরির উপকরণ। সাম্প্রতিক সময়ে এসব নদীমোহনায় জেগেছে অসংখ্য চর-ডুবোচর। যে কারণে নদ-নদীতে ঢুকতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে ইলিশের ঝাঁক। আরেকটি কারণ হচ্ছে-নদীমোহনায় শিল্পায়ন। বরগুনার তালতলীতে নির্মিত হয়েছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই কেন্দ্র নির্মাণে লাখ লাখ টন বালু তোলা হয়েছে তিন নদী-বিশখালী, বলেশ্বর ও পায়রার মোহনা থেকে। এতে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে, তেমনই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিয়মিত আসা কয়লাবাহী জাহাজের চলাচল ও কেন্দ্র চালু থাকাবস্থায় সৃষ্ট কম্পনেও বিঘ্নিত হচ্ছে ইকো সিস্টেম। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে বুড়াগৌরাঙ্গ আর আগুনমুখা নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে। বিচরণক্ষেত্র তথা চলাচলের পথে যদি বাধা পায় তাহলে মিঠাপানি অর্থাৎ নদনদী ইলিশশূন্য হবে, সেটাই স্বাভাবিক। শিল্পায়নের দূষণ আর উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে নদ-নদীতে যে চর-ডুবোচরের সমস্যা, তা দূর করা না গেলে মিঠাপানির ইলিশের সংকট কখনোই কাটবে না।’
এ প্রসঙ্গে একজন সরকারি মৎস্য কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ইলিশ কম পাওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনও একটি কারণ হতে পারে। সাধারণত ইলিশ ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রার ওপরে হলে পানির নিচ থেকে ওপরে আসে না। এ বছর অত্যন্ত গরম থাকায় ইলিশ পেতে সমস্যা হচ্ছে। কারণ এ বছর বেশিভাগ সময় দেশের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে ছিল। এর ফলে ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৭৯ লাখ টন পূরণ নাও হতে পারে।’
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৬৫ হাজার টনে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট ইলিশের উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন। ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জেলেদের ভিজিএফের পরিমাণ মাসিক ১০ কেজি থেকে ৪০ কেজিতে উন্নীতকরণসহ বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৫ দশমিক ৭১ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়। আরো জানা গেছে, গত ১২ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৩ শতাংশ। ২০১৬ সালে ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতিও পেয়েছে। এমনকি দেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান এখন এক শতংশেরও বেশি।
সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘ইলিশের দাম অস্বাভাবিকভাবে যেন না বাড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ইলিশের মূল্য ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবৈধ উপায়ে মাছ ধরার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ জাল আটক ও ধ্বংস করা হচ্ছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আইন অমান্যকারী জেলেদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ নদীর নাব্যতা সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নাব্যতা সংকটের ফলে ইলিশ মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ও চলাচলের পথ পরিবর্তিত হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। ইলিশের প্রজনন ও চলাচল নিশ্চিত করতে নাব্যতা সংকটকে একটি বড় ইস্যু হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার।’