ঢাকা ১২:৩০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম

ইলিয়াস আলীকে গুমের পর হত্যা করা হয়

  • আপডেট সময় : ০৯:০৩:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ৩০ বার পড়া হয়েছে

বিএনপির নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলী ও মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান -ছবি সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক: ১৩ বছর আগে গুমের পর বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীকে হত্যা করা হয় বলে তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

গুম-খুনের অভিযোগে মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে মামলায় বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিলের পর সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে এক শর বেশি মানুষকে গুমের পর হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

ইলিয়াস আলী ছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। ছাত্রদলের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক সিলেট-২ আসনে দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১২ সালের এপ্রিলে ঢাকার বনানীতে বাসার কাছ থেকে ইলিয়াস আলীকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, তার পর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।

গণ-অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর আওয়ামী লীগ সরকার আমলে গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত শুরু হয়। এই গুম-খুনের অন্যতম ‘কুশীলব’ হিসেবে র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেনাবাহিনীর চাকরি হারিয়ে গ্রেফতার হন জিয়াউল। গুমের ঘটনার ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তদন্তে ইলিয়াস আলীসহ বিভিন্নজনকে গুম করার ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান তাজুল ইসলাম।

তাজুল ইসলাম বলেন, ইলিয়াস আলীকে উঠিয়ে নেওয়া, রাস্তা থেকে তাঁকে গুম করা এবং তাঁকে পরবর্তী সময় হত্যা করা হয়েছে বলে তদন্তে জানা গেছে।

২০১৫ সালে বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব (বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য) সালাহউদ্দিন আহমদকে গুম করে ভারতে পাচার করে দেওয়ার পেছনেও জিয়াউল আহসান ছিলেন বলে জানান তাজুল। তিনি আরো বলেন, ২০১৩ সালে ঢাকার তেজগাঁও থানার বিএনপি নেতা সাজিদুল ইসলাম সুমনসহ আটজনকে তুলে নেওয়ার কাজটি জিয়াউল আহসানের নির্দেশ এবং তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হয়েছিল।

ইলিয়াস আলীসহ বিরোধী নেতাদের আওয়ামী লীগ আমলে গুম হওয়ার ঘটনাগুলোয় সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছিল। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব হয়েছিল, তবে তখন কোনো সংস্থাই স্বীকার করেনি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা তখন গুমের অভিযোগগুলোকে ‘নাটক’ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন। তাজুল জানান, ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা গোলাম কিবরিয়া মিহিন, হাফেজ জাকির, চৌধুরী আলম-এমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গুমের ঘটনার পরিকল্পনাকারীও ছিলেন জিয়াউল আহসান।

গুমের পর হত্যার ঘটনায় জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ প্রসিকিউশন উপস্থাপনের পর ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। গুমের তদন্তে ৫০০ মানুষকে হত্যার বিষয়ে প্রসিকিউশনের কাছে তথ্য এসেছে বলে জানান প্রধান প্রসিকিউটর।

জিয়াউল ১৯৯১ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ২০০৯ সালে মেজর থাকাকালে তিনি র‌্যাব-২-এর উপ-অধিনায়ক হন। পরে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের দায়িত্ব পান। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হন। ২০১৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হওয়ার পর তিনি কিছুদিন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন।

২০১৭ সালে তাঁকে টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) পরিচালক করা হয়। ২০২২ সালে সংস্থাটিতে মহাপরিচালক পদ সৃষ্টি করে তাঁকে ওই পদে বসানো হয়। এরই মধ্যে তিনি পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর গত বছর ৬ আগস্ট তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

জিয়াউলের বিরুদ্ধে শতাধিক গুম-খুনের যেসব অভিযোগ: আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে সংঘটিত শতাধিক গুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনটি অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেছে প্রসিকিউশন। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে শতাধিক মানুষকে গুম ও হত্যার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়েছে।

বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) শুনানি শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগগুলো আমলে নিয়েছেন। একইসঙ্গে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ২১ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়েছে।

প্রসিকিউশনের অভিযোগের সারসংক্ষেপ: প্রসিকিউশনের দাবি, ২০০৯ সালে মেজর পদে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়নের (র‌্যাব) গোয়েন্দা বিভাগে পোস্টিং পাওয়ার পর জিয়াউল আহসান বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। এর ফলস্বরূপ ২০২৪ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণ পর্যন্ত তাকে আর কখনও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ফেরত যেতে হয়নি। তিনি পুরো সময়েই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থায় কর্মরত ছিলেন।

অভিযোগে বলা হয়, প্রয়োজনীয় কোর্স ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং কোনো ব্যাটালিয়ন, ব্রিগেড বা ফর্মেশন কমান্ডের অভিজ্ঞতা ছাড়াই তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।

২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক ও এডিজি (অপারেশনস) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অসংখ্য বলপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে তিনি সরাসরি অংশ নেন অথবা তার প্রত্যক্ষ নির্দেশ, অনুমোদন ও জ্ঞাতসারে এসব অপরাধ সংঘটিত হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগ-১: গাজীপুরে সজলসহ তিনজনকে হত্যা: অভিযোগ অনুযায়ী, ২০১১ সালের ১১ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে অবৈধভাবে আটক সজলসহ তিন থেকে চারজন বন্দীকে নিয়ে জিয়াউল আহসান ও তার দল গাজীপুরের দিকে রওনা হন। ঢাকা বাইপাস সড়কে বিভিন্ন স্থানে গাড়ি থামিয়ে পর্যায়ক্রমে বন্দীদের চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে একাধিক বন্দীকে জিয়াউল আহসান নিজ হাতে গুলি করেন। হত্যার পর লাশগুলো রাস্তার পাশে ও খালে ফেলে দেওয়া হয়। পরে পুলিশ দুটি লাশ উদ্ধার করে এবং একজনকে সজল হিসেবে শনাক্ত করা গেলেও অন্যদের পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।

অভিযোগ-২: বরগুনার বলেশ্বর নদীতে কমপক্ষে ৫০ জনকে হত্যা: প্রসিকিউশনের ভাষ্য অনুযায়ী, বরগুনার পাথরঘাটার চরদুয়ানী এলাকা ও বলেশ্বর নদীর মোহনা ছিল জিয়াউল আহসানের পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ‘হটস্পট’। গভীর রাতে বন্দীদের ট্রলার বা নৌকায় করে নদীর মাঝখানে নিয়ে গিয়ে মাথা বা বুকে বালিশ চেপে গুলি করা হতো। পরে পেট কেটে সিমেন্টের ব্লক বেঁধে লাশ পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো।
এই পদ্ধতিকে ‘গেস্টাপো’ বা ‘গলফ’ কোডনামে পরিচালনা করা হতো বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। এভাবে সাবেক বিডিআর সদস্য নজরুল ইসলাম মল্লিক ও আলকাছ মল্লিকসহ কমপক্ষে ৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগ-৩: বনদস্যু দমনের নামে সুন্দরবনে হত্যাকাণ্ড: প্রসিকিউশন জানায়, তথাকথিত বনদস্যু দমনের নামে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা অভিযান পরিচালনা করা হতো। পূর্বে আটক ও গুম থাকা ব্যক্তিদের বনদস্যু হিসেবে সাজিয়ে গভীর রাতে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ দেখানো হতো। এসব অভিযানে র‌্যাবের বাছাই করা সদস্যরা অংশ নিত এবং অনেক ক্ষেত্রে জিয়াউল আহসান নিজেই উপস্থিত থাকতেন।

এই ধারাবাহিকতায় ‘অপারেশন নিশানখালী’, ‘অপারেশন মরা ভোলা’ ও ‘অপারেশন কটকা’র মতো অভিযানে অন্তত ৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

অন্যান্য অভিযোগ ও চলমান তদন্ত: এছাড়া তদন্তে ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে ২০১০-২০১৩ সময়ে অন্তত ২০০ জনকে হত্যার অভিযোগ, বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী, সাজেদুল ইসলাম সুমন, সালাহউদ্দিন আহমেদসহ বহু ব্যক্তির গুম, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ দমন অভিযানে কমপক্ষে ৬১ জন নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক হত্যার অভিযোগসহ আরো অসংখ্য ঘটনার সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে। এসব বিষয়ে পৃথক তদন্ত চলমান রয়েছে।

চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্য: চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গাজীপুরে তিনজন হত্যা, বরগুনার পাথরঘাটায় ৫০ জন হত্যা এবং সুন্দরবনে বনদস্যু দমনের নামে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে হত্যার তিনটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে তিন শতাধিক ব্যক্তিকে গুম ও হত্যার সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।

সানা/ওআ/আপ্র/১৭/১২/২০২৫

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম

ইলিয়াস আলীকে গুমের পর হত্যা করা হয়

আপডেট সময় : ০৯:০৩:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক: ১৩ বছর আগে গুমের পর বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীকে হত্যা করা হয় বলে তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

গুম-খুনের অভিযোগে মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে মামলায় বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিলের পর সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে এক শর বেশি মানুষকে গুমের পর হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

ইলিয়াস আলী ছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। ছাত্রদলের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক সিলেট-২ আসনে দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১২ সালের এপ্রিলে ঢাকার বনানীতে বাসার কাছ থেকে ইলিয়াস আলীকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, তার পর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।

গণ-অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর আওয়ামী লীগ সরকার আমলে গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত শুরু হয়। এই গুম-খুনের অন্যতম ‘কুশীলব’ হিসেবে র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেনাবাহিনীর চাকরি হারিয়ে গ্রেফতার হন জিয়াউল। গুমের ঘটনার ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তদন্তে ইলিয়াস আলীসহ বিভিন্নজনকে গুম করার ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান তাজুল ইসলাম।

তাজুল ইসলাম বলেন, ইলিয়াস আলীকে উঠিয়ে নেওয়া, রাস্তা থেকে তাঁকে গুম করা এবং তাঁকে পরবর্তী সময় হত্যা করা হয়েছে বলে তদন্তে জানা গেছে।

২০১৫ সালে বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব (বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য) সালাহউদ্দিন আহমদকে গুম করে ভারতে পাচার করে দেওয়ার পেছনেও জিয়াউল আহসান ছিলেন বলে জানান তাজুল। তিনি আরো বলেন, ২০১৩ সালে ঢাকার তেজগাঁও থানার বিএনপি নেতা সাজিদুল ইসলাম সুমনসহ আটজনকে তুলে নেওয়ার কাজটি জিয়াউল আহসানের নির্দেশ এবং তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হয়েছিল।

ইলিয়াস আলীসহ বিরোধী নেতাদের আওয়ামী লীগ আমলে গুম হওয়ার ঘটনাগুলোয় সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছিল। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব হয়েছিল, তবে তখন কোনো সংস্থাই স্বীকার করেনি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা তখন গুমের অভিযোগগুলোকে ‘নাটক’ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন। তাজুল জানান, ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা গোলাম কিবরিয়া মিহিন, হাফেজ জাকির, চৌধুরী আলম-এমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গুমের ঘটনার পরিকল্পনাকারীও ছিলেন জিয়াউল আহসান।

গুমের পর হত্যার ঘটনায় জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ প্রসিকিউশন উপস্থাপনের পর ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। গুমের তদন্তে ৫০০ মানুষকে হত্যার বিষয়ে প্রসিকিউশনের কাছে তথ্য এসেছে বলে জানান প্রধান প্রসিকিউটর।

জিয়াউল ১৯৯১ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ২০০৯ সালে মেজর থাকাকালে তিনি র‌্যাব-২-এর উপ-অধিনায়ক হন। পরে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের দায়িত্ব পান। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হন। ২০১৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হওয়ার পর তিনি কিছুদিন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন।

২০১৭ সালে তাঁকে টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) পরিচালক করা হয়। ২০২২ সালে সংস্থাটিতে মহাপরিচালক পদ সৃষ্টি করে তাঁকে ওই পদে বসানো হয়। এরই মধ্যে তিনি পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর গত বছর ৬ আগস্ট তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

জিয়াউলের বিরুদ্ধে শতাধিক গুম-খুনের যেসব অভিযোগ: আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে সংঘটিত শতাধিক গুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনটি অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেছে প্রসিকিউশন। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে শতাধিক মানুষকে গুম ও হত্যার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়েছে।

বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) শুনানি শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগগুলো আমলে নিয়েছেন। একইসঙ্গে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ২১ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়েছে।

প্রসিকিউশনের অভিযোগের সারসংক্ষেপ: প্রসিকিউশনের দাবি, ২০০৯ সালে মেজর পদে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়নের (র‌্যাব) গোয়েন্দা বিভাগে পোস্টিং পাওয়ার পর জিয়াউল আহসান বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। এর ফলস্বরূপ ২০২৪ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণ পর্যন্ত তাকে আর কখনও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ফেরত যেতে হয়নি। তিনি পুরো সময়েই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থায় কর্মরত ছিলেন।

অভিযোগে বলা হয়, প্রয়োজনীয় কোর্স ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং কোনো ব্যাটালিয়ন, ব্রিগেড বা ফর্মেশন কমান্ডের অভিজ্ঞতা ছাড়াই তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।

২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক ও এডিজি (অপারেশনস) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অসংখ্য বলপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে তিনি সরাসরি অংশ নেন অথবা তার প্রত্যক্ষ নির্দেশ, অনুমোদন ও জ্ঞাতসারে এসব অপরাধ সংঘটিত হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগ-১: গাজীপুরে সজলসহ তিনজনকে হত্যা: অভিযোগ অনুযায়ী, ২০১১ সালের ১১ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে অবৈধভাবে আটক সজলসহ তিন থেকে চারজন বন্দীকে নিয়ে জিয়াউল আহসান ও তার দল গাজীপুরের দিকে রওনা হন। ঢাকা বাইপাস সড়কে বিভিন্ন স্থানে গাড়ি থামিয়ে পর্যায়ক্রমে বন্দীদের চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে একাধিক বন্দীকে জিয়াউল আহসান নিজ হাতে গুলি করেন। হত্যার পর লাশগুলো রাস্তার পাশে ও খালে ফেলে দেওয়া হয়। পরে পুলিশ দুটি লাশ উদ্ধার করে এবং একজনকে সজল হিসেবে শনাক্ত করা গেলেও অন্যদের পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।

অভিযোগ-২: বরগুনার বলেশ্বর নদীতে কমপক্ষে ৫০ জনকে হত্যা: প্রসিকিউশনের ভাষ্য অনুযায়ী, বরগুনার পাথরঘাটার চরদুয়ানী এলাকা ও বলেশ্বর নদীর মোহনা ছিল জিয়াউল আহসানের পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ‘হটস্পট’। গভীর রাতে বন্দীদের ট্রলার বা নৌকায় করে নদীর মাঝখানে নিয়ে গিয়ে মাথা বা বুকে বালিশ চেপে গুলি করা হতো। পরে পেট কেটে সিমেন্টের ব্লক বেঁধে লাশ পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো।
এই পদ্ধতিকে ‘গেস্টাপো’ বা ‘গলফ’ কোডনামে পরিচালনা করা হতো বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। এভাবে সাবেক বিডিআর সদস্য নজরুল ইসলাম মল্লিক ও আলকাছ মল্লিকসহ কমপক্ষে ৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগ-৩: বনদস্যু দমনের নামে সুন্দরবনে হত্যাকাণ্ড: প্রসিকিউশন জানায়, তথাকথিত বনদস্যু দমনের নামে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা অভিযান পরিচালনা করা হতো। পূর্বে আটক ও গুম থাকা ব্যক্তিদের বনদস্যু হিসেবে সাজিয়ে গভীর রাতে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ দেখানো হতো। এসব অভিযানে র‌্যাবের বাছাই করা সদস্যরা অংশ নিত এবং অনেক ক্ষেত্রে জিয়াউল আহসান নিজেই উপস্থিত থাকতেন।

এই ধারাবাহিকতায় ‘অপারেশন নিশানখালী’, ‘অপারেশন মরা ভোলা’ ও ‘অপারেশন কটকা’র মতো অভিযানে অন্তত ৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

অন্যান্য অভিযোগ ও চলমান তদন্ত: এছাড়া তদন্তে ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে ২০১০-২০১৩ সময়ে অন্তত ২০০ জনকে হত্যার অভিযোগ, বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী, সাজেদুল ইসলাম সুমন, সালাহউদ্দিন আহমেদসহ বহু ব্যক্তির গুম, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ দমন অভিযানে কমপক্ষে ৬১ জন নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক হত্যার অভিযোগসহ আরো অসংখ্য ঘটনার সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে। এসব বিষয়ে পৃথক তদন্ত চলমান রয়েছে।

চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্য: চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গাজীপুরে তিনজন হত্যা, বরগুনার পাথরঘাটায় ৫০ জন হত্যা এবং সুন্দরবনে বনদস্যু দমনের নামে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে হত্যার তিনটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে তিন শতাধিক ব্যক্তিকে গুম ও হত্যার সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।

সানা/ওআ/আপ্র/১৭/১২/২০২৫