প্রত্যাশা ডেস্ক: ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাত এক সপ্তাহ অতিক্রম করেছে। ১৩ জুন (শুক্রবার) ভোররাতে ইসরায়েল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাসহ বিভিন্ন স্থানে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে এ সংঘাতের সূত্রপাত হয়। এর পর থেকে প্রতিদিনই হামলা, পাল্টা জবাব ও হুমকি চলছে। একনজরে সাত দিনে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে যা যা ঘটেছে-
১৩ জুন: ভোররাতে ইরানের আট শহরে কয়েক শ বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় ইরানের সেনাপ্রধান ও ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধানসহ অন্তত ২০ জন সামরিক কমান্ডার নিহত হন। ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতাঞ্জ, তাবরিজ শহরের পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্র ও দুটি সামরিক ঘাঁটি, ইস্পাহান, আরাক ও কেরমানশাহ শহরে ভূগর্ভস্থ একটি ক্ষেপণাস্ত্র মজুতকেন্দ্রে হামলার খবর পাওয়া যায়। এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি হামলার জবাবে সকালে দেশটিতে ড্রোন হামলা চালায় ইরান। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, ইরান ১০০টি ড্রোন পাঠালেও সব কটি ভূপাতিত করা হয়।
১৪ জুন: ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। তেল আবিব, মধ্য ইসরায়েলসহ বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড জানায়, তারা ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি ও বিমানঘাঁটিগুলো লক্ষ্য করে এ হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের তিনটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে দুই পাইলটকে আটক করার দাবি করে ইরান। জবাবে ইসরায়েল ইরানের অন্তত তিনটি প্রদেশে হামলা চালায়।
১৫ জুন: ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে দুই ধাপে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ইরান। এর মধ্যে একটি হামলা ইসরায়েলের বন্দরনগরী হাইফায় আঘাত হানে। এ ঘটনায় অন্তত ১৫ জন আহত হন। ইসরায়েলের বাত ইয়াম শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ইরানের হামলায় কয়েক ডজন ভবন বিধ্বস্ত হয়। জবাবে তেহরানসহ ইরানের বিভিন্ন শহরে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েল। তেহরানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবন, ইস্পাহানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামরিক ঘাঁটি ও মাশহাদ বিমানবন্দরে একটি বিমানে আঘাতে হানে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র। ইসরায়েলি হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) গোয়েন্দা শাখার প্রধান ও দুই জেনারেল নিহত হন। পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ওপর হামলার হুমকি দেয় ইসরায়েল।
১৬ জুন: তেহরানে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। শহরের পশ্চিমে একটি সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হানে ইসরায়েল। দেশটি ঘোষণা দিয়ে তেহরানে ইরানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনে বিমান হামলা চালায়। হামলায় বিধ্বস্ত হয় মধ্য ইরানের কেরমানশাহ শহরের ফারাবি হাসপাতাল।
জবাবে ইসরায়েলের হাইফা ও তেল আবিব শহর লক্ষ্য করে একাধিক পাল্টা হামলা চালায় ইরান। হাইফাভিত্তিক বাজান গ্রুপ জানায়, তাদের বিদ্যুৎ ও স্টিম উৎপাদনকেন্দ্রে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং পরিশোধন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। অন্তত ৩ জন নিহত হয়েছেন।
১৭ জুন: ইরানের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ, বিশেষ করে ইস্পাহান, তাবরিজ এবং রাজধানী তেহরানে ব্যাপক বোমা হামলা চালায় ইসরায়েল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করে, তারা ১২টি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ঘাঁটি ও মজুতকেন্দ্র ধ্বংস করেছে। ইসরায়েল দাবি করে, তারা এক হামলায় ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের খাতাম আল-আনিবিয়া শাখার প্রধান আলী সাদমানিকে হত্যা করেছে। ইসরায়েলি হামলার জবাবে ইরান উত্তর ইসরায়েল ও তেল আবিব লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। হামলায় ইসরায়েলের একটি সামরিক গোয়েন্দা কেন্দ্র ও মোসাদের একটি পরিকল্পনা ঘাঁটি আক্রান্ত হয়েছে বলে দাবি করে তেহরান। এদিকে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যে এদিন জি-৭ সম্মেলন থেকে আগেভাগে চলে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা এখন ইরানের আকাশ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখেছি।’ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যা করা হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।
১৮ জুন: তেহরান, ইস্পাহান প্রদেশ ও কারাজ অঞ্চলে বিস্ফোরণ ও বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। দেশটি দাবি করেছে, তারা অস্ত্রাগার ও দুটি সেন্ট্রিফিউজ তৈরির কারখানাসহ ৪০টি লক্ষ্যবস্তু সফলভাবে ধ্বংস করেছে। এদিন ইরান ১২তম বারের মতো ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড জানায়, দূরপাল্লার সেজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালানো হয়। লক্ষ্য ছিল দখলকৃত গোলান মালভূমি ও দক্ষিণ ইসরায়েলে আঘাত হানা। তেল আবিব ও এর পূর্বাংশে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। ইরানে সাময়িকভাবে ইন্টারনেট সেবা সীমিত করা হয়েছে বলে জানায় দেশটির তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। তবে সাইবার নিরাপত্তা ও ইন্টারনেটবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা নেটব্লকস জানায়, ইরানে প্রায় পুরোপুরিভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে ভাষণ দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি এ সংঘাতে জড়ায়, তবে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ইরানকে হামলা করতেও পারি, নাও করতে পারি।’
১৯ জুন: ইসরায়েল নাতাঞ্জ ও খোনদাব পারমাণবিক স্থাপনাসহ ইরানের বহু স্থানে হামলা চালায়। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা তেহরানে ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সদর দপ্তর ধ্বংস করেছে। কারাজ শহর ও পায়াম বিমানবন্দরের কাছেও বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ইরানের আরাক শহরে ভারী পানির (ডিউটেরিয়াম অক্সাইড মিশ্রিত থাকে) পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। অন্যদিকে ইরানের ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র দক্ষিণ ইসরায়েলের বিরসেবা শহরের সোরোকা হাসপাতালে আঘাত হানে। এ ঘটনায় দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। কিন্তু ইরানি বার্তা সংস্থা ইরনার দাবি, হাসপাতাল নয়, এ হামলার মূল লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ও গ্যাভ-ইয়াম টেকনোলজি পার্কে অবস্থিত গোয়েন্দা ঘাঁটি। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জানান, ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবেন, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে যুক্ত হবে কি না। ইসরায়েলের তথ্যমতে, ইরানি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২৪ জন নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের ৫ হাজার ১১০ জনকে বাস্তুচ্যুত ঘোষণা করা হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্টস বলেছে, ইসরায়েলের হামলায় ইরানে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৩৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ হাজার ৩২০ জনের বেশি। (সূত্র: আল-জাজিরা, বিবিসি, এএফপি। সৌজন্যে: প্রআ অনলাইন)