নিজস্ব প্রতিবেদক : বেসরকারি খাতে থাকা বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) তিনটি পাটকলের ইজারা বাতিল হচ্ছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ায় ইজারা নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো এসব পাটকল চালাতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। তিন প্রতিষ্ঠানই নিজেরা চুক্তি বাতিল চেয়েছে বলে জানিয়েছে বিজেএমসি।
ইজারা বাতিল হওয়া পাটকলগুলো হলো- সিরাজগঞ্জ রায়পুরের জাতীয় জুট মিলস্, চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডের এম এম জুট মিলস্ এবং একই এলাকার আর আর জুট মিলস। ২০২২ সালে এসব পাটকল ইজারা নিয়েছিল বেসরকারি খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান রশিদ অ্যাগ্রো ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড, স্টিল মাকর্স বিল্ডিং লিমিটেড ও বেস্ট স্টাফ জুট মিল।
বিজেএমসি জানায়, গত ৫ আগস্টের পরে জাতীয় জুট মিল ও আর আর জুট মিলের চুক্তি বাতিল করেছে ইজারা নেওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া এম এম মিলের চুক্তি বাতিলের আবেদন রয়েছে, সেটা প্রক্রিয়াধীন। বিজেএমসির মুখ্য পরিচালন কর্মকর্তা নাসিমুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কারণে এসব পাটকল আর চালাতে চায় না লিজ নেওয়া ওইসব প্রতিষ্ঠান। সেটা বাতিল করছে, সে সুযোগ তাদের আছে।’ তবে এ বিষয়ে ইজারা বাতিল করা তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য নিতে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলেও কেউ বক্তব্য দেননি। প্রতিষ্ঠানগুলো বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিল বলে জানা যায়। তিনটি পাটকলের ইজারা বাতিল হওয়ার পরে আরও ১১টি পাটকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে। বিজেএমসির বন্ধ ২৫টি পাটকলের মধ্যে ২০টি ইজারা দেওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে ১৪টি পাটকল বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। বছরের পর বছর লোকসান গুনতে থাকা ২৫টি পাটকল ২০২০ সালের ১ জুলাই বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। এরপর পাটকলগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দিয়ে চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বর্তমানে ইজারা দেওয়া পাটকলগুলো হলো- খালিশপুর জুট মিলস্, কার্পেটিং জুট মিলস্, ইউএমসি জুট মিলস্, বাংলাদেশ জুট মিলস্, রাজশাহী জুট মিলস্, কেএফডি জুট মিলস্, মিলস ফারনিশিংস লিমিটেড, যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ, দৌলতপুর জুট মিলস্, গুল আহমদ জুট মিলস্ ও গলফ্রা হাবিব লিমিটেড।
জানা যায়, ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন, পরিত্যক্ত ও সাবেক ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের ৭৮টি পাটকল নিয়ে বিজেএমসি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালে মিলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮২। এরশাদ সরকারের সময় ৩৫টি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রত্যাহার করা হয় আটটি পাটকলের পুঁজি।
১৯৯০ সালের পর বিশ্বব্যাংকের পাট খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ১১টি পাটকল বন্ধ, বিক্রি ও একীভূত করা হয়। ২০০২ সালের জুনে বন্ধ হয় আদমজী জুট মিল। বিজেএমসির অধীনে থাকা ২৬টি পাটকলের মধ্যে শেষ পর্যন্ত (২০২০) চালু ছিল ২৫টি। এগুলোর মধ্যে ২২টি পাটকল ও তিনটি নন–জুট কারখানা। এসব পাটকলের মোট জমির পরিমাণ ১ হাজার ৩১৩ একর। এদিকে পুরতন এসব পাটকল ইজারার জন্য বিগত চার বছরে সাত দফা টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল। এতে অনেক চেষ্টার পরে ১৪টি মিল ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়, যার তিনটি বাতিল হলো। এতদিন এসব মিল ইজারা নিতে আগ্রহী হলেও ফের সেখানে পাটকল স্থাপনে আগ্রহ কম বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। পরিস্থিতি বিবেচনায় এসব পাটকল ইজারা নিয়ে সেখানে টেক্সটাইল শিল্প স্থাপনের সুযোগ দিয়েছিল বিজেএমসি। বিজেএমসির সব মিল অত্যন্ত পুরোনো। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা নতুন মেশিনের এক চতুর্থাংশ। শ্রমিক খরচ কয়েকগুণ। এছাড়া এসব মিলে কোনো উন্নয়নের উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়নি। তাদের (বিজেএমসির) মেশিনের খবর নেই, লিজ নিয়ে ব্যস্ত তারা।-বাংলাদেশ জুট মিল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আ. বারিক বারবার ইজারা দিতে ব্যর্থ হয়ে গত বছর পাটকল ইজারা নিয়ে পাট, পাটজাত পণ্য ছাড়াও টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদন করতে সুযোগ দেয়। যদিও আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলগুলোতে শুধু পাট বা পাটজাত পণ্য উৎপাদনের অনুমতির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ছিল। এক্ষেত্রে ইজারার মেয়াদও ১০ বছর বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়।
পাটকল ইজারা প্রক্রিয়া শুরু করার প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক দরপত্র প্রণয়নের শুরুতে দেশের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলের ইজারা নেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিল। এছাড়া ভারত ও যুক্তরাজ্যের কিছু উদ্যোক্তা পাটকলগুলোর ইজারা পেতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু সরকারের নানা শর্ত ও মধ্যমেয়াদি ইজারার সময়ের কারণে পরে আগ্রহে ভাটা পড়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অনাগ্রহের কারণ মিলগুলোর দুরবস্থা ও সরকারের নানা শর্তের বেড়াজাল বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জুট মিল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আ. বারিক। তিনি বলেন, ‘বিজেএমসির সব মিল অত্যন্ত পুরোনো। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা নতুন মেশিনের এক চতুর্থাংশ। শ্রমিক খরচ কয়েকগুণ। এছাড়া এসব মিলে কোনো উন্নয়নের উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়নি। তাদের (বিজেএমসির) মেশিনের খবর নেই, লিজ নিয়ে ব্যস্ত তারা।’ তিনি বলেন, ‘এছাড়া এ কারখানা নিয়ে ব্যাংক লোন নেওয়া যাবে না, এটা করা যাবে না ওটা করা যাবে না- এমন দুই ডজন শর্ত রয়েছে। যে বিনিয়োগ করবে তারা এত শর্ত দিয়ে কীভাবে অন্যের কারখানা চালাবে। আবার এত কম সময়ের জন্য এগুলো লিজ দেওয়া হচ্ছে। এত অল্প সময়ের জন্য কেন একজন উদ্যোক্তা এত বড় বিনিয়োগ করবেন।’