বিশেষ সংবাদদাতা : বাংলাদেশের শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর হলেও বৈধ-অবৈধভাবে ইউরোপমুখী হচ্ছেন অনেকে। এতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেরই মরুর বুকে সলিল সমাধি হয়েছে অথবা ঠাঁই হয়েছে দুর্গম জঙ্গলের গণকবরে। সম্প্রতি লিবিয়ার ব্রেগা উপকূলে ২০ বাংলাদেশির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। প্রতি বছর এ পথে যাত্রা করতে গিয়ে প্রাণ হারান বহু অভিবাসনপ্রত্যাশী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫৬২ জন।
একই সময়ে ইউরোপের ২৮টি দেশে গেছেন মাত্র ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন। এর মধ্যে করোনার পর ২০২২ ও ২০২৩ সালের চেয়ে ২০২৪ সালে ইউরোপে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা কমেছে। ২০২৪ সালে ইউরোপে গেছেন ১৬ হাজার ৭৭ জন। অন্যদিকে ২০২৩ সালে গেছেন ৩০ হাজার ৪২৭ জন, ২০২২ সালে ২২ হাজার ৬০০ জন, ২০২১ সালে পাঁচ হাজার ৪৯ ও ২০২০ সালে এক হাজার ৫১৫ জন। ২০২৪ সালে কাজের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যান ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে ইউরোপে ১৬ হাজার ৭৭ জন। ২০২৪ সালে কাজের উদ্দেশ্যে ইউরোপের ২৮টি দেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে ইতালি গেছেন ১ হাজার ১৬৪ জন, বুলগেরিয়ায় ৪৬৫, ক্রোয়েশিয়ায় ৩ হাজার ৯৪৬, গ্রিসে ৪০৮, হাঙ্গেরিতে ৩২০, লিথুনিয়ায় ২৯৯, মাল্টায় ৪২২, পর্তুগালে ১৫০৮, পোল্যান্ডে ২০৩, রোমানিয়ায় ৩ হাজার ৫৪৯, সার্বিয়ায় ৮৭, ফিনল্যান্ডে ৩৫ জন ও আয়ারল্যান্ডে গেছেন ২২ জন। এছাড়া চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, বেলজিয়াম ও অস্ট্রিয়ায় কাজের উদ্দেশে কর্মীরা গেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশি কর্মীদের পশ্চিম ইউরোপ কিংবা পূর্ব ইউরোপে যাওয়ার সংখ্যা খুবই নগণ্য। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এটা খুবই কম। সারা বিশ্বে এখন দক্ষ শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা।
এ চাহিদা মেটাতে ইউরোপের দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নত দেশগুলো বিভিন্ন খাতে দক্ষ লোকবল নিচ্ছে। তারা বলছেন, ইউরোপ দক্ষ অভিবাসীদের গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে বিভিন্ন দেশের লোকজন প্রতিযোগিতা করে ইউরোপ যাচ্ছে। এই জায়গায় বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ইউরোপের বাজারে দখল না করার ব্যর্থতা রয়েছে। অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘ইউরোপের প্রায় সব দেশেই শ্রমিকরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আত্মীয়-স্বজন কিংবা দালালের মাধ্যমে যান। যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের এমইউ (সমঝোতা স্মারক) আছে, সেটাও সফল হচ্ছে না। ফলে এজেন্সি যার যার মতো করে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। তাও অবৈধভাবে। ইউরোপে একটা বাজার যখন ওপেন হয়, তখন কী ধরনের শ্রমিক তারা চায়, কোন ক্যাটাগরিতে শ্রমিক চায় সেটা আমাদের বুঝতে হবে। স্কিল মাইগ্রেশনের জন্য যে ইনস্টিটিউশনাল সিস্টেম গড়ে ওঠার কথা সেটা এখনো আমাদের গড়ে ওঠেনি।’
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংখ্যা আইওএমের তথ্য অনুসারে, প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা থেকে প্রচুর জনশক্তি ইউরোপের দেশগুলোতে গেলেও বাংলাদেশ থেকে এ সংখ্যা নগণ্য। কারণ, দক্ষ জনশক্তির অভাব। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১০ বছর ধরে ইউরোপের প্রায় ২৭টি দেশে জনশক্তি রপ্তানি হলেও রেগুলার মাইগ্রেশন হচ্ছে হাতেগোনা কয়েকটি দেশে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ বৈধ-অবৈধভাবে জনশক্তি পাঠাচ্ছে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ইউরোপের যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তি আছে সেগুলো অনেক পুরোনো। নতুন করে জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হচ্ছে না। আমাদের হাইকমিশন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শ্রমবাজার খোলার ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে।
কিন্তু সে রকম অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যে কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে এর নানান শর্ত বাংলাদেশ পূরণ করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে নয়টি দেশ থাকলেও গ্রিস ছাড়া অন্য কোনো দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক নেই। দক্ষিণ ইউরোপের মধ্যে ইতালির সঙ্গে চলতি বছর নতুন সমঝোতা স্মারক হওয়ার কথা রয়েছে। অস্ট্রিয়া, স্পেন ও পর্তুগালের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম ইউরোপ ও ইইউ অনুবিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ সফিউল আজম বলেন, গ্রিসের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি। সে অনুযায়ী লোক যাচ্ছে। ইতালির সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক হলে তারা সেক্টরভিত্তিক লোক নেবে। এটা হলে যারা যাবে, সবাই কাজ পাবে। কতজন যাবে সেটা চূড়ান্ত হয়নি। স্কিল-সেমি স্কিল সবাই সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, চেষ্টা করা হচ্ছে বাজার সম্প্রসারণ করার। কিন্তু দক্ষতা না থাকাটা বড় বাধা। জার্মানিতে একটা সুযোগ আছে, অপরচুনিটি কার্ড, সেখানে অ্যাপ্লাই করে শর্ত পূরণ করলে তারা যোগ্য মনে করলে এক বছরের ভিসা দেয়। একইভাবে লন্ডনেও কেয়ারগিভার, নার্সসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দক্ষ লোক নেওয়ার আবেদন আছে। এগুলো চালু আছে, অনেকে আবেদন করছে, তবে যাওয়ার সংখ্যা কম। মুহাম্মদ সফিউল আজম বলেন, ইউরোপের শ্রমবাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে না বা সংকুচিত হচ্ছে, যাই বলেন, এগুলোর কিছু কারণ তো অবশ্যই রয়েছে। আমাদের কর্মীদের দক্ষতার সংকট তো রয়েছে এখন ইমেজ সংকট অনেক বড় বাধা। কারণ শ্রমিকরা নন শেনজেনভুক্ত একটা দেশে ঢুকে সেখান থেকে শেনজেন দেশে চলে যাচ্ছে। ভাষা না জানাও বড় সংকটগুলোর একটি। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশিদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ক্রোয়েশিয়ার শ্রমবাজার। তবে ইউরোপের এই দেশটিতে শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশটির দায়িত্বপ্রাপ্ত অনাবাসী রাষ্ট্রদূত তারেক মোহাম্মদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সম্প্রতি পাঠানো এক চিঠিতে বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অপতৎপরতার কারণে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কাজের অনুমতিপত্র ও ভিসা আর দেওয়া হবে না, এমনটা দূতাবাস জেনেছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে ক্রোয়েশিয়া বাংলাদেশের ১২ হাজার ৪০০ নাগরিকের কাজের অনুমতিপত্র ও ভিসা দেয়। এর মধ্যে আট হাজার ক্রোয়েশিয়া যাননি।
বাকি চার হাজার ৪০০ ব্যক্তির মধ্যে অর্ধেক দেশটিতে কাজে থাকতে পারেন। ক্রোয়েশিয়ায় কাজের অনুমতিপত্র নিয়ে শেনজেনভুক্ত অন্য দেশে বাংলাদেশের অনেক নাগরিক অবৈধভাবে কাজ করায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। বেআইনি অভিবাসন বন্ধের জন্য পদক্ষেপ নিতেও ইইউ ক্রোয়েশিয়া সরকারকে বলেছে। এদিকে ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট আর এজেন্সির কারসাজিতে সংকট চলছে ইতালির শ্রমবাজারেও। বাংলাদেশ মাইগ্রেশন ডেভেলপমেন্ট ফোরাম জানিয়েছে, এখনো প্রায় ৪০ হাজার আবেদন ইতালি দূতাবাসে ঝুলে আছে। অনেকে লাখ টাকা জমা দিয়েও এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশ মাইগ্রেশন ডেভেলপমেন্ট ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন জয় বলেন, বাংলাদেশ ও ইতালির একটি চক্র ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট বানিয়ে প্রায় এক লাখ কর্মীর ওয়ার্ক পারমিট বের করেছে। অ্যাম্বাসি এগুলো যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ফলে অনেক লিগ্যাল আবেদন আটকে আছে। টাকা জমা দিয়ে অনেকের নিঃস্ব অবস্থা। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে অনেক অভিবাসী ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
এভাবে যাওয়ার সময় অনেকে ভয়াবহ বিপদে পড়েন, অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। অনেকেই প্রাণ হারান ভূমধ্যসাগরে। অনেকে ইউরোপে আশ্রয় নিতে পারলেও পরবর্তী সময়ে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০০ অবৈধ বাংলাদেশি দেশে ফেরত এসেছেন। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ প্রবেশে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম ছিল। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়। ২০২২ সালে ছিল তৃতীয় এবং এর আগে ২০২১ সালে এ তালিকায় শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। ২০২০ ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। ওকাপের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের অদক্ষতা আর এক দেশ থেকে আরেক দেশে পালিয়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশিদের প্রতি তাদের একটা নেগেটিভ ধারণা তৈরি হয়েছে। তখন তারা আর লোক নিতে চায় না, কারণ আমরা মার্কেটগুলো হারিয়ে ফেলি। কিন্তু এটা সঠিকভাবে ওরিয়েন্টেশন করে পাঠানো হলে, আমরা বাজার সম্প্রসারণ করতে পারতাম।’ তিনি বলেন, আমাদের বেশ কয়েকবার রোমানিয়া, ইতালির সঙ্গে চুক্তি বাতিল হয়েছে। এখন তো ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে বাতিল হওয়ার পথে। শাকিরুল ইসলাম বলেন, ইউরোপে ৮০ শতাংশ শ্রমিক সংকট আছে। সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে ইতালি ও ইউরোপে প্রতি বছর এক কোটি শ্রমিক ঘাটতির বাজারে অপরিসীম সুযোগ নেওয়া সম্ভব।