এস এম পারভেজ তমাল : যুদ্ধ জিনিসটা কারো জন্যই কাম্য নয়। যুদ্ধ কোনো দেশের জন্য সুফল বয়ে আনে না। এর প্রভাব অন্যান্য দেশেও পড়ে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কেবল দেশ দুটির নয়, বিশ্বের জন্য অকল্যাণই বয়ে আনবে।
আমি দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়াতে ছিলাম। যদি এখানে রাশিয়ার দিক থেকে চিন্তা করা হয় তাহলে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায় তখনো কিন্তু বলা হয়েছিল স্বাধীনতার পর বাকি দেশগুলোর ন্যাটোভুক্ত করা হবে না। পরবর্তী সময়ে তা আর হয়নি। বেশির ভাগ দেশকে ন্যাটোর সদস্য করা হয়েছে।
এখন রাশিয়ার ব্যাপারটা হয়েছে যে, তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাদের চারপাশে ন্যাটো ঘিরে ফেলতে চাইছে। এখানে ন্যাটোর ভূমিকা অনেক বড়। তারা চিন্তা করছে তাদের দল আরও ভারী করতে। ইউক্রেন এলে সেটা সোনায় সোহাগা হয়। এটা হলো একটা দিক। এখন রাশিয়ার প্রশ্ন হলো, যে ইউক্রেন রাশিয়ার অংশ ছিল, সেটি এখন পশ্চিম সীমান্তে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। এখানকার অধিকাংশ লোক রাশান ভাষায় কথা বলে। সেখানে রাশান ভাষায় কথা বলার অধিকার, রাশান ভাষায় পড়াশোনা করার অধিকার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেখানে যে মাইগ্রেশন তৈরি হয়েছে, তা বিশাল। রাশিয়াতে ইউক্রেন থেকে পাঁচ-ছয় মিলিয়ন লোক চলে আসছে। তো এই কথাগুলো কিন্তু সারা পৃথিবী শুনছে না।
এখন যে স্যাংশন (রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা) দেয়া হয়েছে সারা বিশ্ব মিলিয়ে, তাকে সর্বকালের সর্ববৃহৎ স্যাংশন বলা যায়। যেখানে স্যাংশন কেবল অর্থনৈতিকভাবে নয়, বরং সংস্কৃতির ওপরে স্যাংশন, সাধারণ জনগণের ওপরে এবং স্পোর্টসের ওপরে স্যাংশন আসছে। সাধারণ জনগণ যারা রাশিয়ার বাইরের আছে, তাদের ওপরেও স্যাংশন।
যদি উদাহরণসরূপ বলি, আমার মেয়ের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দিয়েছে লন্ডনে। তো এ রকম কিন্তু স্বাভাবিকভাবে শুধু দেশের ওপরে স্যাংশন হচ্ছে না, স্যাংশন হচ্ছে সাধারণ জনগণের মধ্যে। রাশিয়াতে স্যাংশন হওয়াতে বিভিন্ন প্রোডাক্টের ওপরে স্যাংশন চলে আসছে। আইটি প্রযুক্তির বাইরে সাধারণ যে জিনিস সেটাও এক ধরনের গ্যাম্বল।
স্যাংশনের ফলে অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ছে সব বিদেশি কোম্পানিতেও। রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় সংকীর্ণ অর্থনীতি, কিন্তু দেশটি তো গ্লোবাল নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত। রাশিয়াতে ৪০ শতাংশ বিজনেস ছিল বাইরের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে, যারা গ্লোবাল কোম্পানি। এখন তারা সবাই কাজ ছাড়াচ্ছে এবং সব বন্ধ করে দিচ্ছে। যার ফলে প্রাথমিকভাবে প্রায় ৮ লাখ লোক বেকার হচ্ছে। সাধারণ সব কোম্পানি কিন্তু আর রাশিয়াতে আসবে না।
তো এই রকম পর্যায়ে গেলে দেখা যাবে যে, এখানে অনেক ধরনের লোকের ব্যবসার পাশাপাশি এসব কোম্পানিরও ক্ষতি হচ্ছে। এর প্রথম প্রভাব হলো যে, রাশিয়ার মুদ্রাস্ফীতি অনেক বেশি হওয়ার কারণে লোকজন কর্মসংস্থান হারাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্যাংশনের প্রভাব পড়ছে। ফলে রাশিয়াতে যারা আছে তারা অর্থনৈতিকভাবে বিশেষ চাপের মধ্যে আছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরে অনেক প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে যেমন- গার্মেন্টস ব্যবসায় আমাদের ক্ষতি হবে, এর প্রভাব পড়বে। আমরা ইমার্জিং মার্কেট হিসেবে রাশিয়াকে বেছে নিয়েছিলাম, সেখানে আমাদের বিজনেস বাড়ছিল। দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল, প্রযুক্তিগতভাবে আমাদের ব্যবসা বাড়ছিল, সেগুলোর ওপরেও সমস্যা তৈরি হবে। তবে আমরা আশা করছি, আমাদের সরকার নিশ্চয় এমন একটা পলিসি করবে, যার মাধ্যমে এই সমস্যা যেন গুরুতর না হয়। এর জন্য আমি মনে করি, সরকার বিশেষভাবে এগিয়ে আসবে এবং নিশ্চয় দ্রুত একটা সমাধানের পথ খুঁজে বের করবে।
অন্যদিকে, রাশিয়া পৃথিবীর ১৩ শতাংশ তেলের রপ্তানিকারক। তার অধিকাংশ তেল যায় ইউরোপে। যদি সবাই রাশিয়া থেকে তেল নেয়া বন্ধ করে তাহলে এর প্রভাব পড়বে ব্যাপক। আশার কথা ইউরোপ অন্যান্য ক্ষেত্রে স্যাংশন জারি করলেও, তেল ও গ্যাস এর বাইরে রেখেছে। আমেরিকার স্যাংশনের প্রভাবে দেশটিতে তেলের দাম প্রতি গ্যালন তিন ডলার থেকে আজকে পাঁচ ডলার ২০ সেন্ট হয়েছে। এতে আমেরিকাতে তেলের দাম ৬০ শতাংশ বেড়েছে। তেল ছাড়াও বিভিন্ন রকমের পণ্য, যেমন- মিনারেল, স্টীল, অ্যালুমিনিয়াম এবং বিভিন্ন রকমের ধাতুর দাম বেড়েছে। কারণ, সব মেটালের বড় একটা অংশের রপ্তানিকারক রাশিয়া। এর মধ্যে রাশিয়া আর ইউক্রেন মিলিয়ে কিছু খাদ্যদ্রব্য রপ্তানিতে সারা বিশ্বে তাদের অবস্থান এক থেকে তিনের মধ্যে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তাই স্বাভাবিকভঅবেই সবকিছুর দামের ওপরই একটা প্রভাব পড়বে। এখান থেকে সাপ্লাই চেইন নষ্ট হচ্ছে। তাই বলা যায় এটাতে প্রভাব আসবে তা নিঃসন্দেহে। এর প্রভাব থেকে দূরে থাকতে পারবে না বাংলাদেশ। এখানে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়বে এটা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। তেল, রট, আটা-ময়দাসহ বিভিন্ন জিনিসের দাম ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে। পোশাক রপ্তানিকারকরা রাশিয়ায় শিপমেন্ট বন্ধ রেখেছেন। অন্যান্য পণ্যের আমদানি-রপ্তানিও শঙ্কায়।
যুদ্ধ এক দিনে হয় না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বেধেছে অনেক দিনের সমস্যার কারণে। রাশিয়াতে উইন্টার অলিম্পিকের সময় ইউক্রেনে রেভ্যুলেশনের মাধ্যমে যে সরকার ক্ষমতাসীন হয়, সেই সরকার তো ডেমোক্রেটিক ছিল না। সেই সরকারের ধারাবাহিকতা আজকে চলছে। ক্যু করে যারা ক্ষমতা নিয়েছিল, তারা যে সরকার এখন পরিচালনা করছে, তা নিয়ে রাশিয়ার প্রশ্ন আছে। উইন্টার অলিম্পিকের সময় রাশিয়া কিছু বলেনি। কারণ, উইন্টার অলিম্পিক চলাকালে সব দেশের প্রতি একটা নির্দেশনা থাকে যে দেশে অলিম্পিক হয় তারা কোনো রকমের যুদ্ধে জড়াতে পারবে না। তো এখানে যে রেভ্যুলেশন হওয়ার মাধ্যমে ইউক্রেনে অ্যান্টি রাশান সরকার এল, সেটা নিয়েই রাশিয়ার প্রশ্ন। তারা এসেই ৫০ বছরের একটা চুক্তি বাতিল করে দেয়। চুক্তিটি ছিল ক্রিমিয়া নিয়ে, সেখানে রাশান নেভাল পোর্ট ব্যবহার করতে পারবে রাশিয়া। এটা বাতিল করে ক্ষমতা নেওয়া ইউক্রেন সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ক্রিমিয়াতে সমস্যার তৈরি হয়। রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ করে।
ইতিহাস অনুযায়ী রাশিয়ার প্রথম রাজধানীর নাম হলো কিয়েভ। রাশানদের প্রাচীন রাজধানী। ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়ার দুইটা রাজধানী। রাশান ইতিহাস শুরু হয়েছে এখান থেকেই। আর ইউক্রেন ১৯২২ সালে তৈরিই করা হয়েছে রাশানদের হাত থেকে। তারা আলাদা জাতি ছিল, তাদের গোষ্ঠী ছিল, তাদের সংস্কৃতি ছিল- এটা রাশিয়া মনে করে না। রাশানরা মনে করে ইউক্রেনের ৯০ শতাংশ মানুষ রুশ ভাষাভাষী, যা নিয়ে তৈরি হয় দ্বন্দ্বের। তাই রাশিয়া এখন রুশপন্থী সরকার দেখতে চাইছে ইউক্রেনে। বর্তমান যুদ্ধের এটিও এক বড় লক্ষ্য পুতিনের। তবে আমি মনে করি, যুদ্ধ কোনো দেশের জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। নিশ্চয় এর বিপরীতে অন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া যেত। এখানে দুই পক্ষের অবস্থানই যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিছে। রাশানরা তাদের মতো করে বলছে, এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। কারণ, ঘরের পাশে এখন যদি প্রধান প্রতিপক্ষ ন্যাটো ঘাঁটি থাকে, তাহলে নিজের নিরাপত্তার জায়গাটা কোথায়। আবার ন্যাটোর পাল্টাপাল্টি ভূমিকা যে রাশিয়া শত্রুদেশ। তাকে সব সময় চারদিক থেকে ঘিরে রাখতে হবে। এখান থেকেই আসলে যুদ্ধ এসেছে।
লেখক: সভাপতি, রাশিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। চেয়ারম্যান, এনআরবিসি ব্যাংক লিমিটেড।
ইউক্রেন রেভল্যুশনে কেন চুপ ছিল রাশিয়া
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ