দিনাজপুর সংবাদদাতা: দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার আসাদুজ্জামান (৪৫) ‘বাঁশের তৈরি চোঙার ফাঁদ’ দিয়ে ইঁদুর মেরে মাসে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করছেন। তার পুঁজি হিসেবে রয়েছে ৫০টি ফাঁদ ও ফাঁদে ব্যবহারের জন্য সুগন্ধি ধান।
আসাদুজ্জামান চিরিরবন্দর উপজেলার ৮নং সাইতারা ইউনিয়নের পূর্ব খোচনা গ্রামের ফজলুল হকের ছেলে।
ইঁদুর নিধনে প্রতিদিন কোনো না কোনো কৃষকের কাছ থেকে তার ডাক পড়ে। গত সাত বছর ধরে তিনি ইঁদুর নিধনের কাজ করে আসছেন। এতে করে তার এলাকায় ধান ক্ষেতে দিন দিন ইঁদুরের উপদ্রব কমে আসছে। রক্ষা পাচ্ছে কৃষকের কষ্টের ফসল। একইসঙ্গে জনপ্রিয় ও কার্যকর হচ্ছে ইঁদুর নিধনে পরিবেশবান্ধব ও কার্যকর ‘বাঁশের তৈরি চোঙার ফাঁদ’।
আমন ধানের ক্ষেতে ইঁদুরের উপদ্রব নতুন নয়। ইঁদুরের কাছ থেকে ধানের জমি বাঁচাতে কৃষকেরা যুগে যুগে নানা কৌশল ব্যবহার করে আসছেন। বিষটোপ, পলিথিনের নিশানা, কলাগাছে লোহার তৈরি ফাঁদ ইত্যাদি ব্যবহার হয়ে আসছে। এরমধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে কৃষকরা আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় প্রযুক্তি ‘বাঁশের চোঙা ফাঁদে’। এতে তারা দারুণ সুফল পাচ্ছেন। আর এই বাঁশের তৈরি চোঙা ফাঁদ দিয়ে ইঁদুর নিধনকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন চিরিরবন্দর উপজেলার ৮নং সাইতারা ইউনিয়নের পূর্ব খোচনা গ্রামের ফজলুল হকের ছেলে আসাদুজ্জামান। মাসে আয় করছেন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
আসাদুজ্জামান বলেন, আমার বাবা ফজলুল হক নিজেদের ধানের জমিতে ইঁদুরের উপদ্রব থেকে বাঁচতে কোনো এক আদিবাসীর কাছ থেকে বাঁশের তৈরি চোঙা ফাঁদ তৈরি করা শেখেন। আমরা নিজেদের ধান ক্ষেতের ইঁদুর মারার জন্য এই ফাঁদ ব্যবহার করতাম। সেসময় দেখতাম গ্রামের মানুষ আমাদের বাড়িতে এসে বাবার কাছ থেকে বাঁশের তৈরি চোঙা ফাঁদ চেয়ে নিয়ে গিয়ে নিজেদের ধানক্ষেতে বসাতো। দিন দিন চাহিদা বাড়তে থাকে। তখন আমি বাবার কাছ থেকে এই চোঙা ফাঁদ বানাতে শিখি। প্রথমের দিকে ভাড়া দিতাম। কিন্তু তারা এর সঠিক ব্যবহার করতে পারতো না। পরে নিজেই ভাড়ায় ফাঁদ বসাতে শুরু করি। তখন ফাঁদে একটি ইঁদুর আটকা পড়লে ৩০ টাকা নিতাম। বর্তমানে ৫০ টাকা করে নিই।
তিনি বলেন, প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি ফাঁদ বসাই। চলতি আমন মৌসুমে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টা পর্যন্ত ইঁদুর ফাঁদে আটকা পড়ে। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩২টি ইঁদুর আটকা পড়ার রেকর্ড আছে। মঙ্গলবার ৪০টি ফাঁদ বসিয়েছিলাম। বুধবার সকালে ফাঁদগুলো তুলে দেখি ২৬টি ইঁদুর আটকা পড়েছে। এতে ১৩০০ টাকা পেয়েছি। গড়ে প্রতি মাসে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করে থাকি। যা দিয়ে আমার তিন ছেলে-মেয়ের পড়া লেখাসহ ৬ জনের সংসার চলে যায়।
তিনি বলেন, এই কাজ করার কারণে অনেকে আমাকে আদিবাসী, সাঁওতাল, মেথর, সুইপার পর্যন্ত বলেছে। কিন্তু আমি কারও কথায় কান না দিয়ে আমার স্ত্রীর সহযোগিতায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়ছে। আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থে এই কাজ করে যেতে চাই।
আসাদুজ্জামান বলেন, ইঁদুর মারা আমার নেশা হয়ে গেছে। গত ৬ মাসে প্রায় ৩ হাজার ইঁদুর মেরেছি।
এ ব্যাপারে চিরিরবন্দর উপজেলার খোচনা গ্রামের ইয়াকুব আলী বলেন, ধান ক্ষেতে ইঁদুর আক্রমণ করলে এক বিঘা জমিতে (৪৮ শতাংশ) ২ থেকে ৫ মণ ধানের ক্ষতি করতে পারে ইঁদুর। আসাদুজ্জামান ইঁদুর মারতে শুরু করে এই এলাকায় ইঁদুরের উপদ্রব কমেছে। শত শত বিঘা জমির ধান রক্ষা পাচ্ছে। সে এখন কৃষকের নয়নের মণি।
বানুপাড়া গ্রামের কৃষক নির্মল চন্দ্র রায় বলেন, আসাদুজ্জামান আমার দুটি ক্ষেতে ইঁদুর মারার জন্য ২০টি ফাঁদ বসিয়ে ইঁদুর মেরেছে। আমার জমিতে ১১টি ইঁদুর মারায় তাকে আমি খরচ বাবদ ৫৫০ টাকা দিয়েছি। সে এখন এই কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে।
চিরিরবন্দর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জোহরা সুলতানা বলেন, এখন পর্যন্ত ক্ষেতে ইঁদুর নিধনের যতগুলো পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে তার মধ্যে স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত এই বাঁশের ফাঁদ পরিবেশবান্ধব ও সবচেয়ে কার্যকর। ইঁদুর আমাদের ক্ষেতের অনেক ক্ষতি সাধন করে। সেই জায়গা থেকে আসাদুজ্জামান ইঁদুর নিধন করে কৃষকের ধান রক্ষা করছেন। এজন্য তাকে উপজেলা থেকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। বিষয়টি আমি জেলা অফিসকে জানিয়েছি। তিনি ইঁদুর নিধন করে যেমন জীবিকা নির্বাহ করছেন, তেমনি আদিবাসীরা কার কাছ থেকে ইঁদুর কিনে নিয়ে মাংসের চাহিদা পূরণ করছেন।
এসি/আপ্র/০৯/১০/২০