ঢাকা ১২:৪৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫

আস্থাশীল ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং ব্যবসায়িক ধারাবাহিকতা

  • আপডেট সময় : ০৩:৫৮:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫
  • ৬ বার পড়া হয়েছে

মো. আবু জাফর সামছুদ্দিন : ‘আস্থার সংকটের দরুন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসায়ীদের রক্তপ্রবাহ। নেতিবাচক তথ্য ও সুশাসনের অভাব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আমানতকারীদের আস্থা মারত্মকভাবে প্রভাবিত করে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের একটি ইতিবাচক তথ্য পারে দ্রুততম সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনাস্থা দূর করতে। আশার বিষয় হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ না করার ঘোষণা দিয়েছেন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ব্যাংক ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’

কয়েকদিন আগে একজন প্রবীণ শিল্প উদ্যোক্তার সঙ্গে ক্ষণিকের পরিচয়ে কথা হলো। বিনয়ের সঙ্গে ওনার প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলাম। আমার জানা মতে, ওই প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত। দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার বেশ ভালো লেনদেন হতো। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের লেনদেন আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পায় এবং বর্তমানে শেয়ারের মূল্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ত্রৈমাসিক আর্থিক বিবরণীতে প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের চিত্র ফুটে ওঠে।

প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত পণ্য বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়কারী এবং পরিত্যক্ত পণ্যকে রিসাইকল করে পণ্য উৎপাদন করা হয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যাপক চাহিদা সমৃদ্ধ এই পণ্যের উৎপাদন প্রায় বন্ধ। কিছু আমদানি করা কাঁচামাল ও চলতি মূলধনের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ রয়েছে বলে উদ্যোক্তা জানান। প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে বের হলো যে, তিনি ঋণখেলাপি নন। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে প্রায় এক বছর তিনি কাক্সিক্ষত মাত্রায় পণ্য আমদানি করতে পারেননি। প্রতিষ্ঠানের ঋণ হিসেবে যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কাঁচামালের অভাবে তিনি উৎপাদন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হননি, রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
আসলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রক্ত সঞ্চালক তা বুঝতে বাকি রইল না। সব ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা এবং তারল্য সংকটের কারণে অনেক শ্রম ও মেধার সম্মেলনে গড়ে ওঠা একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। হয়তো বাংলাদেশে বর্তমানে এ রকম হাজারো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দৈন্যদশার শিকার।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান একটি অতি নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। মূলধন কাঠামো, আমানতের নিরাপত্তা বিধান, তারল্য ব্যবস্থাপনা, ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই নির্ধারিত ছকে পরিচালিত হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। পাঁচ বছর ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিষয় নিয়ে মিডিয়া জগৎ অত্যন্ত সক্রিয়। এর বাইরে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান মার্জার করাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা জনসমক্ষে আসতে থাকে; বিশেষ করে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রভিশন ঘাটতি, মূলধন ঘাটতি ও তারল্য সংকটের বিষয়গুলো বিভিন্ন বক্তব্যে আসা শুরু করে। ফলে সৃষ্টি হয় আমানতকারী ও গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার সংকট। আস্থার সংকট আমানতকারীর ওপর খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতির বিষয়টি গণমানুষ খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে না। সবচেয়ে বড় আঘাত হানে আমানতকারীর আস্থার সংকট। আমানতকারীরা তখন বিভিন্ন মেয়াদি হিসাব নগদায়ন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর তা হয়ে ওঠে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। অন্যদিকে গ্রাহক চলতি মূলধন ডিসবার্সমেন্ট পেতে সমস্যার পড়ে এবং ব্যবসায়ের গতি হারিয়ে ফেলে। কাম্য স্তরে উৎপাদন এবং বণ্টন কার্যক্রম সম্পন্ন করা না গেলে ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখোমুখি হন এবং বিতরণকৃত ঋণ সমন্বয় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর প্রতিষ্ঠান লোকসানের ভারে আক্রান্ত হয়ে উৎপাদন ও বণ্টন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ফলে ওই ঋণ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। সহসা ওই ঋণ হিসাবটি আদায় করা সম্ভব হয় না। কারণ ওই ঋণ হিসাবের বিপরীতে নগদ প্রবাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। এই ঋণের বিপরীতে সৃষ্ট সম্পদ যা প্রাইমারি সিকিউরিটি হিসেবে গণ্য করা হয়, সেটির অস্তিত্ব আর থাকে না। আমানতকারীর অর্থ ফেরত প্রদানে ব্যাংকের তারল্য সংকট দেখা দেয়। ওই ঋণের ওপর প্রভিশন করতে গিয়ে ব্যাংকের মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

আস্থার সংকটের কারণে ব্যাংকব্যবস্থা প্রবাহহীন নদীর মতো ধীরে ধীরে বালুচরে পরিণত হয়, হারিয়ে ফেলে তার তেজোদীপ্ত চলার পথ। দুর্ভোগের শিকার হয় আমানতকারী ও ঋণ গ্রহণকারী। অন্যদিকে গ্রাহকের কথা একটু বলতেই হয়। একজন গ্রাহককে ব্যাংক ১০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছে। এরই মধ্যে তিনি ৯ কোটি টাকা গ্রহণ করে বাকি এক কোটি টাকার একটি মেশিন আমদানি করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আবেদন করেছেন। ব্যাংক যথাসময়ে ঋণপত্র স্থাপন করতে পারেনি অথবা ওই ব্যাংকের ঋণপত্র গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বিকল্প পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

সন্দেহাতীতভাবে এক কোটি টাকার ঋণপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ১০ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট আলোর মুখ আর কোনোদিন নাও দেখতে পারে। এটি একটি পরিত্যক্ত প্রকল্পে পরিণত হবে এবং ঋণ হিসাবটি খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। ফলস্বরূপ ব্যাংক ও গ্রাহক দুই পক্ষই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। আবার একটি চলমান প্রকল্প; যেখানে ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে; ব্যাংকের তারল্যপ্রবাহ বন্ধ হওয়ার কারণে পাঁচ কোটি টাকার স্থানীয় অথবা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ ব্যাহত হয়েছে। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানে নগদ প্রবাহ কমে আসবে এবং গ্রাহক ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবেন; যার পরিণতিতে ঋণটি খেলাপি ঋণে পরিণত হবে। ব্যবসা পরিচালনা বন্ধ হয়ে যাবে।
একজন বাণিজ্যিক পণ্য আমদানিকারকের ব্যাংকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের দুর্বলতার কারণে পণ্য আমদানি অথবা সংগ্রহ করা কাক্সিক্ষত স্তরে সম্ভব হচ্ছে না। সরবরাহের ধারাবাহিকতা না থাকার কারণে ওই ব্যবসায়ী তার পণ্যের বাজার হারাবেন। অন্যদিকে বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে পাওনা টাকা সংগ্রহ করা বিঘ্নিত হবে। ব্যাংকের ঋণ অসমন্বিত থাকবে। পর্যায়ক্রমে একদিকে তার ব্যবসা বন্ধ হবে, অন্যদিকে ব্যাংকে তার ঋণ হিসাবটি খেলাপি ঋণে পরিণত হবে।
উপর্যুক্ত তিনটি বিষয়ে আলোচনা করা হলে দেখা যাবে, একজন দক্ষ ব্যবসায়ী- যিনি ব্যবসায় ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন, দীর্ঘদিন তিনি শুধু ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে প্রতিনিয়ত রক্তশূন্যতায় পড়েন। অন্যদিকে এক সময় তিনি রক্তশূন্যতায় মৃত্যুবরণ করেন। তার এই মৃত্যুজনিত কারণে ব্যাংকের অর্থায়ন খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। ফলে ব্যাংকের তারল্য সংকট অধিকতর গভীর হয়। অতিরিক্ত প্রভিশন করার ফলে ব্যাংক লোকসানের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে এবং মূলধন ঘাটতির কবলে পড়ে। এ জন্য দায়ী কে? অবশ্যই ব্যাংক ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং আস্থাহীনতার বলি হচ্ছেন এ তিন গ্রাহক।

বর্তমান সময়ে এ রকম হাজার হাজার গ্রাহকের নিজের দক্ষতা ও সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুধু দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার কারণে তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়, যার প্রতিক্রিয়া এসে পড়ে সমগ্র ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর ও আমানতকারীদের ওপর। ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সিন্ডিকেশনের উদ্ভব হয় এবং নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায় বাজার ব্যবস্থাপনা; যার পরিণতিতে দুর্ভোগের শিকার হয় সাধারণ ভোক্তারা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান। সামান্যতম আস্থাহীনতার প্রভাব পড়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর, গ্রাহকের ওপর, আমানতের ওপর এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের ওপর।

আর্থিক খাতে সুশাসন ও পেশাদারত্বের কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টি রেগুলেটর এবং ব্যাংকিং জগতের বোদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলেও তা নিশ্চিত করা যায়নি। বিভিন্ন মহলের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলেও কোনো এক অজানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি সত্যিকার অর্থে শুধু আমাদের দেশের ব্যর্থতা নয় বরং এটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক কৌশলীদের সুনিপুণ পরিকল্পনার ফসল। কারণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা থেকেও বেশি কার্যকর। তাই এটি দুরূহ একটি কাজ। তবু সুশাসনের জন্য কাজ করা অত্যন্ত জরুরি; যা ব্যাংক ও আর্থিক খাতে কিছুটা হলেও আস্থা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে। আর সুশাসন ফিরিয়ে আনবে আস্থা।

আস্থা ব্যাংকিং সেক্টরের ধারাবাহিকতাকে সুরক্ষিত করবে। সুরক্ষা থেকে ব্যবসায়ীর ধারাবাহিকতা এবং বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। একটি গতিশীল অর্থনীতি আমরা উপভোগ করতে পারব এবং জাতি ধারাবাহিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবেÑ এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।

লেখক: ব্যাংকার ও শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ব্যাংকার্স ক্লাব অব বাংলাদেশ লিমিটেড

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আস্থাশীল ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং ব্যবসায়িক ধারাবাহিকতা

আপডেট সময় : ০৩:৫৮:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫

মো. আবু জাফর সামছুদ্দিন : ‘আস্থার সংকটের দরুন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসায়ীদের রক্তপ্রবাহ। নেতিবাচক তথ্য ও সুশাসনের অভাব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আমানতকারীদের আস্থা মারত্মকভাবে প্রভাবিত করে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের একটি ইতিবাচক তথ্য পারে দ্রুততম সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনাস্থা দূর করতে। আশার বিষয় হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ না করার ঘোষণা দিয়েছেন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ব্যাংক ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’

কয়েকদিন আগে একজন প্রবীণ শিল্প উদ্যোক্তার সঙ্গে ক্ষণিকের পরিচয়ে কথা হলো। বিনয়ের সঙ্গে ওনার প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলাম। আমার জানা মতে, ওই প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত। দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার বেশ ভালো লেনদেন হতো। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের লেনদেন আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পায় এবং বর্তমানে শেয়ারের মূল্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ত্রৈমাসিক আর্থিক বিবরণীতে প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের চিত্র ফুটে ওঠে।

প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত পণ্য বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়কারী এবং পরিত্যক্ত পণ্যকে রিসাইকল করে পণ্য উৎপাদন করা হয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যাপক চাহিদা সমৃদ্ধ এই পণ্যের উৎপাদন প্রায় বন্ধ। কিছু আমদানি করা কাঁচামাল ও চলতি মূলধনের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ রয়েছে বলে উদ্যোক্তা জানান। প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে বের হলো যে, তিনি ঋণখেলাপি নন। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে প্রায় এক বছর তিনি কাক্সিক্ষত মাত্রায় পণ্য আমদানি করতে পারেননি। প্রতিষ্ঠানের ঋণ হিসেবে যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কাঁচামালের অভাবে তিনি উৎপাদন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হননি, রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
আসলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রক্ত সঞ্চালক তা বুঝতে বাকি রইল না। সব ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা এবং তারল্য সংকটের কারণে অনেক শ্রম ও মেধার সম্মেলনে গড়ে ওঠা একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। হয়তো বাংলাদেশে বর্তমানে এ রকম হাজারো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দৈন্যদশার শিকার।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান একটি অতি নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। মূলধন কাঠামো, আমানতের নিরাপত্তা বিধান, তারল্য ব্যবস্থাপনা, ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই নির্ধারিত ছকে পরিচালিত হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। পাঁচ বছর ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিষয় নিয়ে মিডিয়া জগৎ অত্যন্ত সক্রিয়। এর বাইরে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান মার্জার করাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা জনসমক্ষে আসতে থাকে; বিশেষ করে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রভিশন ঘাটতি, মূলধন ঘাটতি ও তারল্য সংকটের বিষয়গুলো বিভিন্ন বক্তব্যে আসা শুরু করে। ফলে সৃষ্টি হয় আমানতকারী ও গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার সংকট। আস্থার সংকট আমানতকারীর ওপর খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতির বিষয়টি গণমানুষ খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে না। সবচেয়ে বড় আঘাত হানে আমানতকারীর আস্থার সংকট। আমানতকারীরা তখন বিভিন্ন মেয়াদি হিসাব নগদায়ন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর তা হয়ে ওঠে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। অন্যদিকে গ্রাহক চলতি মূলধন ডিসবার্সমেন্ট পেতে সমস্যার পড়ে এবং ব্যবসায়ের গতি হারিয়ে ফেলে। কাম্য স্তরে উৎপাদন এবং বণ্টন কার্যক্রম সম্পন্ন করা না গেলে ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখোমুখি হন এবং বিতরণকৃত ঋণ সমন্বয় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর প্রতিষ্ঠান লোকসানের ভারে আক্রান্ত হয়ে উৎপাদন ও বণ্টন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ফলে ওই ঋণ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। সহসা ওই ঋণ হিসাবটি আদায় করা সম্ভব হয় না। কারণ ওই ঋণ হিসাবের বিপরীতে নগদ প্রবাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। এই ঋণের বিপরীতে সৃষ্ট সম্পদ যা প্রাইমারি সিকিউরিটি হিসেবে গণ্য করা হয়, সেটির অস্তিত্ব আর থাকে না। আমানতকারীর অর্থ ফেরত প্রদানে ব্যাংকের তারল্য সংকট দেখা দেয়। ওই ঋণের ওপর প্রভিশন করতে গিয়ে ব্যাংকের মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

আস্থার সংকটের কারণে ব্যাংকব্যবস্থা প্রবাহহীন নদীর মতো ধীরে ধীরে বালুচরে পরিণত হয়, হারিয়ে ফেলে তার তেজোদীপ্ত চলার পথ। দুর্ভোগের শিকার হয় আমানতকারী ও ঋণ গ্রহণকারী। অন্যদিকে গ্রাহকের কথা একটু বলতেই হয়। একজন গ্রাহককে ব্যাংক ১০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছে। এরই মধ্যে তিনি ৯ কোটি টাকা গ্রহণ করে বাকি এক কোটি টাকার একটি মেশিন আমদানি করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আবেদন করেছেন। ব্যাংক যথাসময়ে ঋণপত্র স্থাপন করতে পারেনি অথবা ওই ব্যাংকের ঋণপত্র গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বিকল্প পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

সন্দেহাতীতভাবে এক কোটি টাকার ঋণপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ১০ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট আলোর মুখ আর কোনোদিন নাও দেখতে পারে। এটি একটি পরিত্যক্ত প্রকল্পে পরিণত হবে এবং ঋণ হিসাবটি খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। ফলস্বরূপ ব্যাংক ও গ্রাহক দুই পক্ষই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। আবার একটি চলমান প্রকল্প; যেখানে ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে; ব্যাংকের তারল্যপ্রবাহ বন্ধ হওয়ার কারণে পাঁচ কোটি টাকার স্থানীয় অথবা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ ব্যাহত হয়েছে। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানে নগদ প্রবাহ কমে আসবে এবং গ্রাহক ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবেন; যার পরিণতিতে ঋণটি খেলাপি ঋণে পরিণত হবে। ব্যবসা পরিচালনা বন্ধ হয়ে যাবে।
একজন বাণিজ্যিক পণ্য আমদানিকারকের ব্যাংকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের দুর্বলতার কারণে পণ্য আমদানি অথবা সংগ্রহ করা কাক্সিক্ষত স্তরে সম্ভব হচ্ছে না। সরবরাহের ধারাবাহিকতা না থাকার কারণে ওই ব্যবসায়ী তার পণ্যের বাজার হারাবেন। অন্যদিকে বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে পাওনা টাকা সংগ্রহ করা বিঘ্নিত হবে। ব্যাংকের ঋণ অসমন্বিত থাকবে। পর্যায়ক্রমে একদিকে তার ব্যবসা বন্ধ হবে, অন্যদিকে ব্যাংকে তার ঋণ হিসাবটি খেলাপি ঋণে পরিণত হবে।
উপর্যুক্ত তিনটি বিষয়ে আলোচনা করা হলে দেখা যাবে, একজন দক্ষ ব্যবসায়ী- যিনি ব্যবসায় ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন, দীর্ঘদিন তিনি শুধু ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে প্রতিনিয়ত রক্তশূন্যতায় পড়েন। অন্যদিকে এক সময় তিনি রক্তশূন্যতায় মৃত্যুবরণ করেন। তার এই মৃত্যুজনিত কারণে ব্যাংকের অর্থায়ন খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। ফলে ব্যাংকের তারল্য সংকট অধিকতর গভীর হয়। অতিরিক্ত প্রভিশন করার ফলে ব্যাংক লোকসানের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে এবং মূলধন ঘাটতির কবলে পড়ে। এ জন্য দায়ী কে? অবশ্যই ব্যাংক ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং আস্থাহীনতার বলি হচ্ছেন এ তিন গ্রাহক।

বর্তমান সময়ে এ রকম হাজার হাজার গ্রাহকের নিজের দক্ষতা ও সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুধু দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার কারণে তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়, যার প্রতিক্রিয়া এসে পড়ে সমগ্র ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর ও আমানতকারীদের ওপর। ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সিন্ডিকেশনের উদ্ভব হয় এবং নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায় বাজার ব্যবস্থাপনা; যার পরিণতিতে দুর্ভোগের শিকার হয় সাধারণ ভোক্তারা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান। সামান্যতম আস্থাহীনতার প্রভাব পড়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর, গ্রাহকের ওপর, আমানতের ওপর এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের ওপর।

আর্থিক খাতে সুশাসন ও পেশাদারত্বের কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টি রেগুলেটর এবং ব্যাংকিং জগতের বোদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলেও তা নিশ্চিত করা যায়নি। বিভিন্ন মহলের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলেও কোনো এক অজানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি সত্যিকার অর্থে শুধু আমাদের দেশের ব্যর্থতা নয় বরং এটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক কৌশলীদের সুনিপুণ পরিকল্পনার ফসল। কারণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা থেকেও বেশি কার্যকর। তাই এটি দুরূহ একটি কাজ। তবু সুশাসনের জন্য কাজ করা অত্যন্ত জরুরি; যা ব্যাংক ও আর্থিক খাতে কিছুটা হলেও আস্থা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে। আর সুশাসন ফিরিয়ে আনবে আস্থা।

আস্থা ব্যাংকিং সেক্টরের ধারাবাহিকতাকে সুরক্ষিত করবে। সুরক্ষা থেকে ব্যবসায়ীর ধারাবাহিকতা এবং বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। একটি গতিশীল অর্থনীতি আমরা উপভোগ করতে পারব এবং জাতি ধারাবাহিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবেÑ এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।

লেখক: ব্যাংকার ও শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ব্যাংকার্স ক্লাব অব বাংলাদেশ লিমিটেড