বিশেষ সংবাদদাতা : বেনাপোল দিয়ে ভারত থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় গত তিন মাসে আমদানি করা হয়েছে ১৩ হাজার ৯৬৮ টন চাল। আমদানি স্বাভাবিক থাকলেও বেনাপোলসহ যশোরের বাজারগুলোতে দাম কমছে না। উল্টো স্থানীয় বাজারে গত সপ্তাহে প্রকারভেদে চালের দাম আগের থেকে কেজিপ্রতি এক-দুই টাকা করে বেড়েছে। এদিকে রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজারের দামের সঙ্গে পাড়া-মহল্লার দোকানে কেজিপ্রতি ১০ টাকা বা তারও বেশী পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। যা প্রান্তিক পর্যায়ে চালের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে যথাযথ বাজার তদারকি না থাকায় জেলা পর্যায়েও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আমদানিকারকরা বলছেন, ভারতে চালের দাম বেশি থাকায় আমদানিকৃত চালের দাম বেশি পড়ছে। ফলে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় দাম কমার কোনও সম্ভাবনাও দেখছেন তারা। এ অবস্থায় চাল আমদানির শুল্কমুক্ত সুবিধার সময়সীমা আবারও বাড়ানো হয়েছে। আমদানির জন্য বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত ভারত থেকে চাল আমদানি করতে পারবে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বেসরকারিভাবে নন-বাসমতি সেদ্ধ চাল ও আতপ চাল আমদানির জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে এলসি খোলার সময়সীমা আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হলো। এদিকে ভরা মৌসুমেও চালের দাম না কমায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। তাদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট গড়ে ওঠায় দাম কমছে না। বিশেষ করে বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারির ব্যবস্থা না থাকায় দাম বাড়ছে বলে জানান ক্রেতারা।
ক্রেতারা বলছেন, দেশে বর্তমানে ধান-চালের কোনও সংকট নেই। মাস খানেক আগে কৃষকের ঘরে উঠেছে আমন ধান। তারপরও সাধারণ মানুষকে বেশি দামেই চাল কিনতে হচ্ছে। এতে অনেকে আর্থিক সংকটে পড়েছেন। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের দাম এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, খেটে খাওয়া মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম বেশি হওয়ায় স্বল্পআয়ের মানুষকে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন নিত্যপণ্যসহ বাড়ছে চালের দাম। সম্প্রতি বাজারে এমন কোনও পণ্য নেই যে তার দাম বাড়েনি। আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর গত বছরের ১৭ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিন মাসে বেনাপোল দিয়ে ১৩ হাজার ৯৬৮ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। সরকার গত ১৭ নভেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয়।
এ সময়ের মধ্যে আশানুরূপ আমদানি না হওয়ায় সময় বাড়িয়ে ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। তাতেও দেশের বাজারে চালের দাম না কমায় ভারত থেকে আমদানির জন্য আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত এক মাস সময় বাড়িয়েছে সরকার। আশা করা যায়, সামনে কমবে। আমদানিকারকদের ভাষ্যমতে, ভারতে চালের দাম বেশি। এ কারণে আমদানিকৃত চাল কম দামে বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। ‘চলতি মৌসুমে ধানের দাম বেশি, যে কারণে কমছে না চালের দাম’, এমনটা বলছেন অটোরাইস মিল মালিক ও ধান ব্যবসায়ীরা। নাভারণ বাজারের সবচেয়ে বড় চালের আড়ত চৌধুরী রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী রাশেদ চৌধুরী বলেন, ‘মোটা চাল ৫১ টাকা ও স্বর্ণা মোটা চাল ৫৩ টাকা কেজি পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে। নতুন ধানের চাল বাজারে আসতে শুরু করেছে। আমদানিও স্বাভাবিক রয়েছে। সামনে দাম কমবে। যদিও এবার অতিবৃষ্টির কারণে উৎপাদন কমেছে। সে কারণে আমদানি চলমান থাকবে।’ বেনাপোল-সহ শার্শার কয়েকটি রাইস মিলে সরেজমিনে দেখা যায়, আশানুরূপ ধান কিনতে পারেননি মিল মালিকরা। দাম বাড়ার আশায় কৃষকরা ধান মজুদ রেখেছেন।
তবে মিল মালিকরা অন্য জেলা থেকে ধান কিনে আনছেন। এসব ধান থেকে চাল করতে খরচ পড়ছে ৫০ টাকার ওপরে এবং চিকন চাল খরচ পড়ছে প্রায় ৬৩ টাকার মতো। এমনটিই বলছে মিল মালিকরা। বেনাপোল বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে মোটা চাল ৫২, হীরা ধানের চাল ৪৮, ঊনপঞ্চাশ ধানের চাল ৫৬, আঠাশ ধানের ৫৯-৬০, জিরাশাইল ৭৬, মিনিকেট ৬৭, ইন্ডিয়ান মিনিকেট ৭৬, বাসমতি ৯৩-৯৫, পাইজাম ৫৭, স্বর্ণা ৫৪-৫৬ ও নাজিরশাইল ৮৩ টাকায় খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে।’ বেনাপোল বাজারে চাল কিনতে আসা জামাল হোসেন বলেন, ‘দেশে পর্যাপ্ত ধানের মজুত রয়েছে। আবার ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে। তারপরও দাম কমছে না। প্রতিবছর এই সময়ে নতুন ধান উঠলে বাজারে চালের দাম অনেক কমে আসে। কিন্তু এবার বাজারের চিত্র ভিন্ন। সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে কিনা খতিয়ে দেখা দরকার।’ আরেক ক্রেতা সম্রাট হোসেন বলেন, ‘ আমরা গরিব মানুষ। চালের দাম না কমলে কীভাবে চলবো? হয়তো সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমছে না। তাই আমি মনে করি, প্রশাসন বাজারে নজরদারি বাড়ালে দাম অনেকটা কমে আসবে।
’ বেনাপোল চেকপোস্ট কার্গো শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা আবু তাহের বলেন, আটটি চাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান গত ১৭ নভেম্বর থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৩ হাজার ৯৬৮ মেট্রিক টন চাল আমদানি করেছে। সারা দেশে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ৯২ প্রতিষ্ঠানকে। ২ লাখ ৭৩ হাজার মেট্রিক টন সেদ্ধ এবং ১ লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তাদের। অনেক প্রতিষ্ঠান এই সময়ের মধ্যে আমদানি করতে পারেনি। সরকার ২৫ দিন সময় নির্ধারণ করে দেয় আমদানিকৃত চাল বাজারজাত করার জন্য। পরে তা ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে ধীরগতিতে চলছে আমদানি। পর্যাপ্ত পরিমাণ আমদানি না হওয়ায় আরও এক মাস সময় বাড়িয়েছে সরকার। এ সময়ের মধ্যে সব চাল আমদানি হলে দাম কমবে।’